Hope is being able to see that there is light despite all of the darkness -Desmond Tutu
ডেসমন্ড টুটু কি কারণে বলেছিলেন, যতই অন্ধকারের রাজত্ব থাকুক, আলো দেখার আশা করতেই হবে তা আমরা জানিনা। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন খাত সম্পর্কে ধারণা থাকলে তিনি এটা বলতেন না।
‘পরিবর্তন কালের নিয়ম। আর এই অমোঘ নিয়মে দ্রুত বদলে যাচ্ছে পৃথিবী। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টে যাচ্ছে মানুষের আচরণ। অনেক কিছু বদলায়, কিন্তু বাংলাদেশের পরিবহন খাত বদলায় না, সড়ক ব্যবস্থাপনা উন্নত হয় না এবং আর কখনও হবে বলেও মনে করছি না।’
চারদিক থেকে নানা আশার কথা শোনানো হলেও আমার কেবলই, মনে হয় বাংলাদেশের সড়কে কোনদিন শৃঙ্খলা ফিরবে না। এই খাত সব ধরনের নিয়ম আর প্রথার বাইরে চলে গিয়েছে। কোন সরকারের পক্ষেই এই খাতে আর কিছু করা সম্ভব হবেনা বলে মনে করছি না।
কেন হবে না, তার ব্যাখ্যা অনেক। তার আগে একটা খবরের দিকে চেয়ে আসি। বৃহস্পতিবার খবর বেরিয়েছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন সড়কে চলাচলকারী ৩৩ শতাংশ যাত্রীবাহী বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই।
একইসঙ্গে ৫৬ শতাংশ বাসের গতি নিয়ন্ত্রক সার্টিফিকেট নেই। হাইকোর্ট ১৬ সদস্যের একটি কমিটি করে জাতীয়ভাবে সারাদেশের পরিবহনগুলোর ওপর একটি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারই আলোকে একটি প্রতিবেদন বিআরটিএ আদালতে দাখিল করেছেন। সেই প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিদিন সড়কে মৃত্যু দেখতে দেখতে এদেশের মানুষের অনুভূতিরও মৃত্যু ঘটেছে। অনেকটা রুটিন মাফিক গণমাধ্যম এইসব খবর প্রকাশ বা প্রচার করছে। সড়কে হত্যো থামছে না, কারণ সড়ক দুর্ঘটনার ভিকটিমদের বেশিরভাগই নিতান্ত দরিদ্র মানুষ।
দুই একটি ঘটনা আলোড়ন তুলে যদি কোন উচ্চ শ্রেণির কেউ মারা যায়। যে অপরাধের শিকার হয় দরিদ্র মানুষ, সেই ঘটনার কোন সমাধান হয় না। এদেশে দরিদ্র মানুষ কেবলই সংখ্যা, জীবন নয়।
সড়কের অধিকাংশ ঘটনার পরিণতি চরম বিয়োগান্তক। সংবাদের শিরোনামও হয় সেরকম। দুর্ঘটনায় আহত নিহতরা পড়ে রয়েছেন, বাস খাদে বা রাস্তায় উল্টে আছে, পাশ দিয়ে হু হু করে গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে। কারও থামার সময় নেই, ইচ্ছেও নেই। এই চেনা ছবিটা বদলায় না। সড়কে দুর্ঘটনার হিড়িক ও অসহায় মৃত্যু ঠেকানোর কোন চেষ্টা নেই, কিন্তু কথা বলে চলেছেন এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। কথা আছে, হাইওয়ে পুলিশ আছে আরও নানাকিছু আছে – এসবই সান্তনা।
কিছুদিন আগে যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলেছে, বাংলাদেশে গত বছর ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১৫ হাজার ৪৬৬ জন। সড়কে গ তির বলি এসব মৃত্যু। প্রায় সব সড়কই মরণফাঁদ।
প্রধান রাস্তাগুলিতে বিভাজন বসেছে, কিন্তু যত্রতত্র রাস্তা পার হবার কু-অভ্যাসটি দূর হয়নি মানুষের। ট্রাফিক সিগন্যাল পূর্বের তুলনায় বেড়েছে, দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সেগুলি অধিক সক্রিয়ও। ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যাও বাড়ছে। নজরদারি ক্যামেরা বসেছে অনেক সড়কে। কিন্তু সড়কে যা ইচ্ছে তা করার যে ঐক্য গড়ে তুলেছেন এদেশের পরিবহন খাতের মালিক শ্রমিকরা তার ভাঙ্গার কোন উদ্যম বা উদ্যোগ নেই কোথাও।
একেই বলে গোড়ায় গলদ। যা মন চায় তাই করার দুর্বিনীত ইচ্ছা সহজেই সফল করার কৃতিত্বের অধিকারী এই বিশাল শক্তিধর বাহিনীকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে নিয়ন্ত্রণে না আনলে কোন যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এদেশে কোনদিন কাজ করবে না। সেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই শাসন ব্যবস্থায়।
দুই চাকার বাহনগুলোর চালক ও ব্যবহারকারীদের হেলমেট ব্যবহার নিশ্চিত করা গেছে রাজধানীতে, কারণ এরা অসংগঠিত, কিছুটা শিক্ষিত এবং ততোধিক নিরীহ। প্রধান রাস্তা সমূহে অজস্র দোকান, সরাবার প্রচেষ্টা সফল হয় না। আলোর ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নেই, বৈধ এবং অবৈধ যাত্রীবাহী যান নিয়ম ভেঙ্গে অতিরিক্ত লোক নিয়ে যাতায়াত করে, কিছু বলা যায় না, কারণ এসব যানের মালিকানায় রয়েছে রাজনৈতিক নেতা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনসহ শক্তিশালী প্রতিভাবানরা।
বাংলাদেশের পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলাই নিয়ম। দূষণ হতে যাত্রী নিরাপত্তা কোনটি নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। মালিক কিংবা শ্রমিক, সবারই সব আমলে রাজনৈতিক প্রতিপত্তি থাকে এবং গত দশটি বছরে সেই ক্ষমতার প্রদর্শন ছিল আরও বেশি স্পষ্ট।
ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে তারা সরকারি পদ ও পদবী ব্যবহার করে রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করেছে, মানুষকে জিম্মি করেছে বারবার। এমনকি পুলিশের সামনে মানুষকে পোড়া মবিল দিয়ে কলংকিত করেছে, আর পুলিশ চেয়ে চেয়ে তা দেখেছে।
একটি সমস্যা ট্রাফিক পুলিশ স্বয়ং। নজরদারের উপর নজরদারির প্রয়োজন বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে। একদিকে দুর্বিনীত মালিক শ্রমিক, অন্যদিকে পুলিশের কোন কোন সদস্যের চাঁদাবাজির ব্যাপক অভিযোগ। দায়ী বাহন, মালিক ও চালককে জরিমানা করবার ক্ষেত্রেও পুলিশের অনীহা অনেক।
অন্য সমস্যাগুলোও পুলিশের তৎপরতা ও সততার সাথে জড়িত। পুরাতন, বিপজ্জনক গাড়ি বাতিল হয় না। গাড়িতে অতিরিক্ত মাল তোলা বন্ধ হয় না। ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লক্কর ঝক্কর গাড়ি চলছে দেদারসে। ধরার নাম নেই। এসবই দুর্ঘটনার কারণ।
রাজনৈতিক স্তর থেকে কেবল বাক্য শুনি আমরা। দুর্ঘটনা কমানোর কোন কৌশলই চোখে পড়ছে না। বহু দেন দরবার করে করে একটি পরিবহন আইন পাস করেছিল সরকার। কিন্তু সেটিও কার্যকর করতে পারেনি পরিবহন খাতের শ্রমিকদের উচ্ছৃঙ্খলতায়।
পরিবর্তন কালের নিয়ম। আর এই অমোঘ নিয়মে দ্রুত বদলে যাচ্ছে পৃথিবী। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টে যাচ্ছে মানুষের আচরণ। অনেক কিছু বদলায়, কিন্তু বাংলাদেশের পরিবহন খাত বদলায় না, সড়ক ব্যবস্থাপনা উন্নত হয় না এবং আর কখনও হবে বলেও মনে করছি না।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
প্রিন্ট