রেল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, অবহেলা, যথাযথ তদারকি ও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে পার্বতীপুরে রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১ হাজার ৪৫০ বাসাবাড়ির দুইতৃতীয়াংশই বহিরাগতদের দখলে। হাজার কোটি টাকার সম্পদ বেহাত হয়ে গেলেও কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই।
রাজনৈতিক নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মচারী, স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা, পুলিশ, সাংবাদিক থেকে শুরু করে মাদক ব্যবসায়ী, চোরাকারবারি এসব বাসাবাড়িতে অবৈধভাবে বসবাস করছে। গড়ে উঠেছে বিভিন্ন এনজিও’র কার্যালয়, কিল্ডার গার্টেন স্কুল, মাদরাসা। রেলের বাসা দখলে দল-মত-পথ ভুলে সবাই মিলেমিশে একাকার।
বেহাত হয়ে যাওয়া কোনো কোনো এলাকা অসামাজিক কর্মকান্ড, মাদক ব্যবসায়ী, চোরাকারবারি ও বিভিন্ন অপরাধীদের নিরাপদ আস্তানায় পরিনত হয়েছে। জানা গেছে, পার্বতীপুর পৌর এলাকায় রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার জন্য সাতটি কলোনীতে ১ হাজার ৪৫০ ইউনিট বাসাবাড়ি রয়েছে।
সেগুলো হলো- হলদীবাড়ী কলোনীতে ১৬৩, বাবুপাড়ায় ৩৭৭, সাহেব পাড়ায় ১৬৮, রহমতনগরে ১৩৬, পাওয়ার হাউজ কলোনীতে ৩২১, ইসলামপুরে ৭৬ ও নিউ কলোনীতে ১৬২ ইউনিট। হলদীবাড়ী কলোনীর সবক’টিসহ সাতটি কলোনীর ৯১০ বাসাবাড়িতে নানা শ্রেণীপেশার লোকজন অবৈধভাবে বসবাস করছেন যুগ যুগ ধরে। তবে পার্বতীপুরে কর্মরত একাধিক রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীর মতে অন্তত এক হাজার বাসায় অবৈধ দখলদার রয়েছেন।
মাঝে মধ্যে হাতবদলও হয় এসব বাসা। দখল পাল্টা দখল করতে গিয়ে সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। ২০১৩ সালে নিউ কলোনীর এমএস/১-সি নম্বর বাসা দখলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সংঘর্ষে যুবদল নেতা রবিউল ইসলাম বাবুল নিহত হয়। বাসাবাড়ির চারপাশের ফাঁকা জায়গাও এখন অবৈধ দখলে চলে যাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রেল কর্মকর্তা এবং অবৈধ দখলদার জানান- কোন রেল কর্মচারী বাসা ছেড়ে দিলে স্থানীয় কয়েকজন টাউট মোটা অঙ্কের টাকায় আই ডাব্লিউ অফিসকে ম্যানেজ করে বহিরাগত লোকজনকে উঠিয়ে দেয় সেখানে। জিআরপি-নিরাপত্তা বাহিনীকেও ম্যানেজ করতে হয়। রেলের অধিকাংশ বাসা বসবাসের সম্পূর্ণ অনুপযোগী।
যারা আছেন, হাজার হাজার টাকা খরচ করে বাসাগুলো সংস্কার করে বাস করছেন। তা না হলে এসব বাসাবাড়ির ইট পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যেতনা। তারা লিজ নিয়ে বৈধ ভাবেই থাকতে চায় বলে জানান। রেলের বাসাবাড়ির তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত পার্বতীপুর আই ডাব্লিউ-ওয়ার্কস কার্যালয়ের উর্দ্ধতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (এসএসএই) মো. তহিদুল ইসলাম অভিযোগ অস্বীকার করে জানান- একশত বছর আগে নির্মিত এসব বাসাবাড়ি দীর্ঘদিনেও সংস্কার না করায় ৫০টি ইউনিট সম্পূর্ণ ধ্বসে পড়েছে। ৭’শটি ড্যামেজ হিসেবে চিহ্নিত।
তবে কোনো বাসাই ড্যামেজ ঘোষনা করা হয়নি। রেল কর্মচারীসহ নানা শ্রেণিপেশার লোকজন বাসাগুলোতে অবৈধভাবে বসবাস করছে। ৫৪০টি বাসায় রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বরাদ্দ নিয়ে বৈধভাবে রয়েছেন। তিনি বলেন, বাসা উদ্ধার করে দিবো কাকে? ভাড়া বেশী হওয়ায় রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা থাকতে চায় না।
পার্বতীপুরে যেখানে ৭/৮ হাজার টাকা হলে তিন রুম বিশিষ্ট এক ইউনিটের আধুনিক ফ্লাটবাসা ভাড়া পাওয়া যায়, সেখানে রেলের জরাজীর্ণ বাসার ভাড়া ১২/১৩ হাজার টাকা। তাছাড়া, অবৈধ দখলমুক্ত করে স্বল্প জনবল দিয়ে বিশাল এলাকার বাসাগুলো সিলগালা করেও আটকানো সম্ভব হয় না। সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী (এ.ই.এন) আবু জাফর মো. রাকিব হাসান জানান- সম্প্রতি ঝটিকা অভিযান চালিয়ে বাসাগুলো কোথায কী অবস্থায় আছে দেখা হয়।
অনেক বাসা আছে সম্পূর্ণ ড্যামেজ। যেগুলো কিছুটা ভাল, সেগুলো রিপিয়ারিং করে রেলওয়ে স্টাফ পরিবারসহ থাকার উপযোগী করা হবে। এসব বাসা থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের তালিকা হচ্ছে। শিগগির উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে।
পার্বতীপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. হাফিজুল ইসলাম প্রামানিক বলেন- রেলের কোটি কোটি টাকার সম্পদ এভাবে নষ্ট ও বেহাত হয়ে যাচ্ছে অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভ্রক্ষেপ করছে না। বাসাগুলো যদি রেলওয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করতে না পারে, তবে সেগুলো অবৈধ দখলদারদের নামে বন্দোবস্ত (লিজ) দিলেও তো বছরে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় হবে।
তিনি বলেন, বাসা ভাড়া বা লিজমানি স্থানীয় বাজার অনুযায়ীই নির্ধারণ করা উচিত। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও রাজশাহীর জায়গার মুল্য আর পার্বতীপুরের জায়গার মূল্য তো আর এক নয়।
প্রিন্ট