আব্দুল হামিদ মিঞাঃ
নিজের শরীরে লোহার বড়শি ফুটিয়ে খোলা মাঠে ‘চড়ক’ গাছে ঘুরপাক খেয়ে নেচে গেয়ে তা পালন করা হলো চড়ক’ উৎসব। সোমবার (১৪-০৪-২০২৫)উপজেলার আড়পাড়া-শ্রীরামপাড়া মাঠে সেই এলাকায় বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আদিবাসিরা শিব পূঁজাকে কেন্দ্র করে নিজের শরীরে লোহার বড়শি ফুটিয়ে ‘চড়ক’ উৎসব পালন করে। তাদের পরিবারের মঙ্গল কামনায় বংশ পরম্পরায় এটি পালন করে আসছে বলে জানা গেছে। উৎসবকে কেন্দ্র করে মাঠের চারিদিকে বসেছিল বিভিন্ন পণ্যের দোকান।
.
বাঘা উপজেলা থেকে ৬ কিলোমিটার দুরে আড়পাড়া-শ্রীরামপাড়া গ্রাম। সরেজমিন ‘চড়ক’ ঘুরে আনন্দ বেদনার নানা দৃশ্য চোখে পড়েছে। প্রথমত পূঁজার ঘরে খালি গায়ে মূল সন্ন্যাসিকে মাটিতে শোয়ানোর পর ৪জন শক্ত সমর্থ মানুষ দুই হাত দুই পা চেপে ধরে আঙ্গুলের মতো মোটা লম্বা দুটি লোহার বড়শি মেরুদন্ডের দুই পাশে ফুটিয়ে দিল। সংগে সংগে শরীর থেকে বেরিয়ে এলো রক্ত। এরপর বড়শিতে নুতুন একটি গামছা বেঁধে সন্ন্যাসীকে শুন্যে তুলে ধরে চড়ক গাছের ৩০ ফুট ওপরে ঝুলিয়ে একে একে সাত পাক ঘুরানোর পর, অন্য সঙ্গীরা মাটিতে নামিয়ে বড়শি খুলে দেয়। এভাবেই হাতে দড়ি নিয়ে বড়শি বিদ্ধ শরীর নিয়ে ‘চড়ক’ গাছে ঘুরপাক খায় মূল সন্নাসী। এর এক দিকে থাকে বড়শি বিদ্ব বিহীন আরেকজন মানুষ। এইদিন বিকেল সাড়ে ৫ টা থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত এভাবেই ঘুরানো হলো ৪জনকে।
তারা জানান, মন শান্ত আর প্রানেভক্তি মানে ‘চড়ক’ ঘোরা কোনো কষ্টের বিষয় নয়। ভগবান সংগে থাকলে ব্যাথা লাগবে কেন। তবে এতটুকু বোঝা গেছে বড়শি বিদ্ধের যন্ত্রনা তারা সহ্য করলেও অভিভাবকরা প্রিয় সন্তানের সে যন্ত্রনা ভোগ করেছেন। উৎসবে মেতে উঠা অনেকেই দেখা গেছে নেশাজাতীয় দ্রব্য পাণ করা অবস্থায়।
.
ভাই বোনদের সাথে ‘চড়ক’ মেলায় এসেছিলেন আড়াই বছর বয়সের সাদ। তার সাথে ছিল,বোন ইলমা ও সহোদর ভাই জুয়েল। তারা জানান, শরীরে বড়শি ফুটিয়ে শূণ্যে ঘোরানোর যন্ত্রনা ভালো না লাগার মধ্যে ছিল ।
পূঁজা সম্পর্কে জানা যায়, শিব ভক্ত বান রাজা তার সঙ্গীদের নিয়ে শিবকে পাওয়ার জন্য প্রার্থনায় মত্ত হয়ে নিজের শরীর থেকে রক্ত বের করে তা শিবের উদ্দেশ্য নিবেদন করেন।এতে শিব খুশি হয়। এ কারনেই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি সম্প্রদায়ের আদিবাসি বা শৈব সম্প্রদায়ের মানুষ শিবকে খুিশ করার জন্য শরীরের রক্ত ঝরিয়ে খোলা মাঠে ‘চড়ক’ উৎসবের আয়োজন করে আসছে।
.
এ সম্পর্কে নাটোরের লালপুরের অরবৃন্দ ঠাকুর জানান, আদিবাসীদের ধর্ম বিশ্বাসে ছেলেমেয়েদের চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আদিবাসীরা শিব পূঁজার ধর্মীয় আচরণের মাধ্যমে “চড়ক’ উৎসব পালন করে থাকেন। বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আদিবাসি সাঁওতাল, ওরাঁও, মাহাতো, তাদের নিজ নিজ রীতিতে প্রতিবছর এ উৎসবে মেতে ওঠেন। যারা পূজায় অংশগ্রহণ করেন তাদের আমিষ খাবার, হলুদ, তেল ও সবরকম মসলাজাতীয় খাদ্য পরিহার করতে হয়।
.
সেখানকার সমাজ প্রধান রুপকুমার জানান, শত শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে শিব পূঁজায় নিজেরাই এর আয়োজন। অনেকে মন বাসনা পূর্ণের জন্য মানত করেন। গল্প আছে-এখানে মানত করলে কঠিন রোগ থেকে মুক্তি মেলে। নেশাজাতীয় দ্রব্য পাণ সম্পর্কে তিনি বলেন, আনন্দের জন্য তারা তালের রস পাণ করে থাকেন। এই আয়োজনে তেমন কোন অনুমতি লাগেনা বলে জানান । স্থানীয় বাসিন্দা,বাঘা থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক জুয়েল রানা বলেন, তাদের উৎসবকে সহযোগিতা করা হয়েছে।
চড়ক পূজার মেলা প্রাঙ্গনে কথা হলে বাঘা থানার পরিদর্শক (তদন্ত( সুপ্রভাত মন্ডল জানান, মেলা ঘুরে দেখে তিনি খুশি হয়েছেন এবং মেলার পরিবেশ খুবই সুন্দর ছিল বলে জানিয়েছেন। অফিসার ইনচার্জ আফম আছাদুজ্জামান জানান, এ বিষয়ে কেউ কিছু জানায়নি।
প্রিন্ট