আলিফ হোসেনঃ
রাজশাহীর তানোর প্রচন্ড খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের অর্ন্তভুক্ত।অধিকাংশ এলাকা প্রচন্ড খরাপ্রবণ হওয়ায়, এখানে বাণিজ্যিক ভাবে সজিনা, তাল ও খেজুর চাষের উজ্জ্বল সম্ভবনা রয়েছে। জানা গেছে, খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে খরা সহিষ্ণু তাল, খেজুর ও সজিনা চাষের উপযোগী। এসব এলাকার রাস্তার দুই ধারে পরিকল্পিতভাবে তাল, খেজুর ও সজিনা গাছ লাগিয়ে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি কৃষকরা সহজেই আয় করতে পারেন হাজার হাজার টাকা। তাল ও খেজুর গাছের রস, খেজুর, তালকুর (কাঁচা তাল) ও সজিনা ডাটা বিক্রি করে স্বাবলম্বি হতে পারেন হাজার হাজার কৃষক। তাল ও খেজুর গাছের ডাল থেকে জ্বালানী, তাল গাছ থেকে ঘরের তীর, পাইড়, ডুঙ্গাসহ বিভিন্ন ধরণের পণ্য সামগ্রী বানিয়ে এ অঞ্চলের মানুষ ব্যবহার করে থাকে। এছাড়াও তাল ও খেজুরের রস থেকে তৈরী গুড় ও সজিনা ডাটা দেশের বিভিন্ন এলাকা এমনকি বিদেশে রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যেতে পারে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও স্থানীয় কৃষিবিদগণ।
জানা গেছে, দেশে ২টি জাত আছে, একটি হালো সজিনা ও আর একটি নজিনা। সজিনার ফুল আসে জানুয়ারীতে আর নজিনা ফুল আসে মার্চ মাস থেকে। তবে সব ফুল থেকে ফল হয় না। একটি থোকায় সর্বাধিক ১৫০টি মত ফুল ধরে। ফুল ৪০ সেন্টিমিটার থেকে ৮০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। ফুল ফুটার ২ মাস পর ফল তোলা যায়। একটি বড় গাছে ৪শ’ থেকে ৫শ’ ফল ধরে। প্রতিটি ফলে ৩০ থেকে ৪০ টি বীজ হয়। দেশে সাধারণ ডাল কেটে ডাল রোপন করে সজিনা গাছ লাগানো হয়। ভারত থেকে হাইব্রিড সজিনার জাত এদেশে এসেছে। এ জাতের বীজ বপন করে লাগাতে হয়। হাইব্রিড জাতের সজিনা গাছে দু’বার ফুল আসে। ফেব্রুয়ারী-মার্চ ও জুন-জুলাই মাস।
জানা গেছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নে খেজুর গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। খেজুর গাছের পাতা দিয়ে পাটি ও বিভিন্ন ধরনের শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। এবং রস থেকে গুড় উৎপাদন। একটি পূর্ণবয়স্ক খেজুর গাছ দিনে দুই থেকে চার লিটার রস দিতে পারে। সপ্তাহে দুই-তিনদিন বিরতি দিয়ে এভাবে শীত মৌসুমে প্রায় দুমাস রস পাওয়া যায়
স্থানীয়রা জানান, আগে শীত এলে সহজেই মিলতো খেজুরের রস। একটা সময় খেজুরের রস বিক্রি করে অনেকে জীবীকা নির্বাহ করতেন।কিন্ত্ত কালের বিবর্তনে তা হারিয়ে গেছে। এখন কোথাও খেজুরের গাছ বা গাছির তেমন সন্ধান পাওয়া যায় না। খুঁজতে খুঁজতে তিন চার গ্রাম ছাড়িয়ে হয়তো একজন গাছির সন্ধান পাওয়া যায়। তবে খেজুর রসের চাহিদা প্রচুর। সিরিয়াল দিয়ে আগে অর্ডার করে রাখতে হয়। প্রতি হাড়ি (চার-পাঁচ কেজি) বিক্রি হয় দেড়শ’ থেকে দুশ’ টাকায়। তাও রস পেতে প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার মতো তৎপরতা চালাতে হয়।
স্থানীয়রা বলেন, খেজুর গাছ কমে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো, অনেকেই বেশ চড়া দামে ইটভাটার মালিকদের কাছে গাছ বিক্রি করে দেন এবং তারপর নতুন করে আর কেউ খেজুর গাছ লাগান না। তাছাড়া গ্রামীণ সড়কের সংস্কার কাজের কারণেও অনেক স্থানে খেজুর গাছ উজাড় হয়ে গেছে। তানোরের আদর্শ ও কৃষিতে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত কৃষক নূরমোহাম্মদ (৫৫) বলেন, সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার ধারে বাণিজ্যিকভাবে তাল, খেজুর ও সজিনা চাষ করে হাজার হাজার কৃষক স্বাবলম্বি হতে পারেন।
স্থানীয় কৃষিবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তালের আদিবাস মধ্যে আফ্রিকায়। এর ইংরেজি নাম প্লামইয়ারা প্লাম। তালের বৈজ্ঞানিক নাম বারোসাস ফ্ল্যাবিলিফার। এটি প্লামী পরিবারের খেজুর, নারিকেল,সুপারি, বাহারি পাম পরিবারভুক্ত গাছ। তাল গাছ আঁটি বা বীজ থেকে হয়। একটি তাল গাছ কমপক্ষে বারো বছর পর ফল দেয় ও প্রায় ১০০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। একটি তাল গাছ ১৫০ থেকে ২০০টি ফল দেয় ও প্রায় ১০০০ লিটার রস পাওয়া যায়। এসব রস থেকে প্রায় ১২০ থেকে ১৩০ কেজি গুড় পাওয়া যায়। এছাড়াও পাকা তাল বিভিন্ন প্রকার পিঠা তৈরীতে ব্যবহার করা হয়। স্থানীয় কৃষক ও তাল গাছ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার হাট-বাজারে তালকুর (কাঁচা তাল) বিক্রি হয় একটাকা চোখ হিসেবে। পাকা তাল বিক্রি হয় ৩০ টাকা থেকে ৫০ টাকায়। তালের রস বিক্রি হয় ২৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে। তালের গুড় বিক্রি হয় ৭০ টাকা থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে। আর তাল গাছ বিক্রি হয় সাইজ অনুযায়ী ২০ হাজার টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকায়।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, রাজশাহী অঞ্চলে প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমিতে তাল গাছ রয়েছে। এখান থেকে তাল উৎপাদন হয় প্রায় ২৬ হাজার মেট্রিক টন। সব থেকে বড় কথা তাল গাছ গরু-ছাগলে খায় না। প্রায় অযত্ন অবহেলার মধ্যে তাল গাছ বড় হয়। তাল গাছের ডাল, তালের রস,তাল ও তালকুর সব কিছুই কৃষক সহজে বিক্রি করতে পারে।
তাল গাছের ডাল কৃষকরা জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। তালের রস থেকে গুড় তৈরী করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি ও বিদেশে রপ্তানি করা যেতে পারে। চিনি ও আখের গুড়ের চেয়ে তালের গুড় সস্তায় বিক্রি করা সম্ভব। এই অঞ্চলের রাস্তার দুই ধারে পরিকল্পিতভাবে তাল, খেজুর ও সাজিনা গাছ লাগিয়ে কৃষকরা হাজার হাজার টাকা আয় করে স্বাবলম্বি হতে পারেন।
প্রিন্ট