ঢাকা , সোমবার, ১০ মার্চ ২০২৫, ২৫ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রতিনিধি নিয়োগ
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা পত্রিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আপনি আপনার এলাকায় সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন।

নাটোরের লালপুর এখন ইমো হ্যাকারদের অভয়ারণ্য, আটকদের মুক্ত করতে আছে গোপন সংগঠন

রাশিদুল ইসলাম রাশেদঃ

 

জনপ্রতিনিধিদের ছত্রছায়া ও প্রশাসনের স্থবিরতায় নাটোরের লালপুর এখন ইমো হ্যাকারদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। নাটোরের লালপুর উপজেলাকে একসময় দেশের মানুষ চিনতো উষ্ণতম স্থান, সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাতের এলাকা এবং কাঁসা শিল্পের সুনামের কারণে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে দেশের মানুষ লালপুরকে চিনে ইমো হ্যাকিংয়ের স্বর্গরাজ্য হিসেবে। আর উপজেলার বিলমাড়িয়া ইউনিয়নকে বলা হয় এই ইমো হ্যাকিংয়ের সদর দপ্তর।

 

২০২২ – ২০২৩ সালে লালপুরে ইমো হ্যাকিং নিয়ে গণমাধ্যমে ক্রমাগত সংবাদ প্রচার হলে প্রশাসন কিছুটা নড়েচড়ে বসে। তবে ২০২৪ সাল থেকে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় লালপুর আবার ইমু হ্যাকিংয়ের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আর এ সকল অবৈধ কাজে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান, বর্তমান ইউপি সদস্য, গ্রামপুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের ছত্রছায়া আছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা যায়, এক সময় উপজেলার বিলমাড়িয়া ও দুড়দুড়িয়া ইউনিয়নের কিছু সংখ্যক কিশোর ও যুবক ইমো হ্যাকিংয়ের সাথে জড়িত থাকলেও বর্তমানে ইউনিয়ন দুটির অনেক বাড়িতে ইমো হ্যাকিং চক্রের সদস্য গড়ে উঠছে। এর প্রভাবে পাশ্ববর্তী লালপুর ও আরবাব ইউনিয়ন এবং বাঘা উপজেলার খানপুর, জোতরাঘব, সরেরহাট, চন্ডিপুর সহ আশেপাশের গ্রামগুলোতে ইমো হ্যাকিং বিস্তার লাভ করেছে।

 

উপজেলার বিলমাড়িয়া, অমৃতপাড়া, রহিমপুর, মোহরকয়া, মোমিনপুর, ভেল্লাবাড়িয়া, গন্ডবিল, পানসিপাড়া, মনিহারপুর, নওপাড়া, নাগশোষা, মহারাজপুর, দুড়দুড়িয়া, পাইকপাড়া, রামকৃষ্ণপুর এলাকা ঘুরে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, গ্রামের উঠতি বয়সী কিশোর-যুবক, ঝরে পড়া স্কুল শিক্ষার্থী ও কলেজগামী শিক্ষার্থীরা ইমো হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে টাকা উপার্জনে বেশি জড়িয়ে পড়ছে। অনেকক্ষেত্রে, অভিভাবকরাও অর্থের প্রলোভনে পড়ে তাদের এই অনৈতিক অবৈধ কাজকে সমর্থন করছেন। অনেকেই এখন এই অবৈধ ইমো হ্যাকিংকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করছে। হ্যাকিংয়ের টাকা দিয়ে কেউ কিনছেন অতিরিক্ত মূল্যে জমি -জমা, কেউ গড়েছেন বিলাসবহুল বাড়ি।

 

 

আইন শৃঙ্খলা বাহিনী থেকে রক্ষা পেতে সেসকল বাড়ির চারপাশে আবার লাগানো হয়েছে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা। হ্যাকিংয়ে জড়িতরা সাধারণত সারাদিন ঘুমায়। বিকাল থেকে বাজার ও বিভিন্ন চা স্টলগুলোতে তাদের আনাগোনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এসময় তারা নামি-দামি বিভিন্ন ব্র‍্যান্ডের মোটরসাইকেল নিয়ে বেপরোয়া গতিতে তাদের আড্ডা খানাগুলোতে বিশেষ করে ফাঁকা মাঠ, বাঘা উপজেলার আলাইপুর ও মিরগঞ্জের বিভিন্ন মাদক বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে যায়। মাদক সেবন শেষে তারা যাত্রা পথে বিভিন্ন চা স্টলগুলোতে যাত্রা বিরতি করে এবং দামী ব্র‍্যাণ্ডের সিগারেট ও চা খেয়ে থাকেন। তাদের সুবিধার্থে কোন কোন চা স্টলে গোপনীয় (বিশেষ) চেম্বার ও ক্যারাম খেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারা সাধারণত সমাজের সিনিয়র সিটিজেনদের অবজ্ঞার চোখে দেখে এবং অর্থের প্রভাব দেখাতে উশৃংখল আচরণ করতে দ্বিধাবোধ করে না। এমনকি টাকা দিয়ে সবাইকে কিনে নেয়ার দম্ভ করে। তারা যখন চা স্টল, সেলুন, হাট-বাজার, দোকান কিংবা মার্কেটে যান, তখন তারা দামাদামি করে কোন কিছু ক্রয় করেন না এবং অতিরিক্ত পাওনা টাকা ফেরত নেন না। খাবার হোটেলগুলোতে তাদের জন্য দেওয়া হয় বিশেষ ট্রিট। চলেন রাজকীয় স্টাইলে।

 

লালপুরের একজন ইলেকট্রিসিয়ান বলেন, তাদের গ্রাম ও পাশের গ্রামের অনেক ঝরে পড়া স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থী, ইজিবাইক ও পাওয়ার টিলার চালকরা ইমো হ্যাকিং করে এখন কোটিপতি। অথচ কয়েকমাস আগেও তারা কিংবা তাদের অভিভাবকরা দিন মজুর, ভ্যান চালানো ও ইটের ভাটায় কাজ করতো। এছাড়া তাদের অর্থ আয়ের দৃশ্যমান কোন উৎস নাই। শুধুমাত্র হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে তারা আজ কোটিপতি বনে গেছেন। তবে বর্তমানে কেউ কেউ ইমো হ্যাকিংকে আড়াল করতে লোক দেখানো বিভিন্ন ব্যবসা শুরু করেছেন।

 

অধিকাংশ হ্যাকার সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হ্যাকার বলেন, একজন হ্যাকার প্রতি মাসে গড়ে ১৫-২০ লাখ টাকা হ্যাক করে থাকেন। তারা সাধারণত প্রবাসী ও ধনী ব্যবসায়ীদের টার্গেট করেন। এজন্য তারা সামাজিক মাধ্যমে প্রথমে টার্গেটেড ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। পরে কৌশলে তাদের ইমো কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হ্যাঁক করে বিভিন্নভাবে অর্থ হাতিয়ে নেন। এক্ষেত্রে তারা বিকাশ, নগদ, রকেট সহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বর ব্যবহার করে থাকেন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্টরা একটা নির্দিষ্ট পরিমান (২০ – ৩০ %) অর্থ কমিশন নিয়ে হ্যাকারদের টাকা উত্তোলনে সাহায্য করে থাকে। এতে তারাও (এজেন্টরা) ফুলে ফেপে উঠেছেন।

 

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে আরেক হ্যাকার বলেন, ‘আমি আগে হ্যাকিংয়ের কাজ করতাম। এখন আর করি না। তবে হ্যাকিংয়ের সাথে স্থানীয় ইউপি সদস্য ও গ্রাম পুলিশরাও জড়িত। প্রতি মাসে তাদের চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেওয়া ও আইনি ঝামেলায় ফেলানো হয়। তবে টাকা দিয়ে সবাইকে ম্যানেজ করা হয়। এজন্য হ্যাকারদের একাধিক গোপন সংগঠন রয়েছে। কেউ আটক হলে কিংবা আইনি ঝামেলায় পড়লে অন্যরা তাকে মুক্ত করে আনে। তাদের কাছে টাকা কোন ফ্যাক্ট নয়। ‘ মাদক সেবনের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, রাত জেগে কাজ করার জন্য গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল সহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য হ্যাকিংয়ের একটি অনুসঙ্গ হিসেবে সেবন করা হয়। এক্ষেত্রে হ্যাকারদের দুইভাগে ভাগ করা হয়। যারা শিক্ষানবিশ হ্যাকার, তারা সাধারণত গাঁজা সেবন করে। এবং যারা হ্যাকিংয়ে দক্ষতা অর্জন করে, তারা ফেনসিডিল ও ইয়াবা সেবন করে। হ্যাকিংয়ে প্রতি মাসে গড়ে কমপক্ষে ৫ লক্ষ টাকা আয় করতে পারলে তাকে দক্ষ হ্যাকার ধরা হয়।’

 

লালপুর থানা সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালে হ্যাকিংয়ের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ৪ টি মামলা হয়েছে। তবে ২০২৪ সাল থেকে কোন হ্যাকার আটক হননি এবং কোন মামলা হয়নি। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এমন স্থবিরতায় হ্যাকার চক্রগুলো নির্ভয়ে তাদের হ্যাকিং চালিয়ে যাচ্ছে। আর হ্যাকিংয়ের অভয়ারণ্যে সব হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে হ্যাকিংয়ের শিকার পরিবারগুলো।

 

হ্যাকিংয়ের বিষয়ে বিলমাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিদ্দিক আলী মিষ্টু সময়ের প্রত্যাশাকে বলেন , “এখনতো আইন-শৃংখলা বাহিনী সবকিছু উন্মুক্ত করে দিয়েছে। সরকার সাইবার নিরাপত্তা আইন বন্ধ করার ঘোষণা দেয়ার পর থেকে পুলিশ কোন অ্যাকশনে যাচ্ছে না। ফলে এখন অবাধে সকল হ্যাকিং কার্যক্রম চলছে।” এ সময় তিনি হ্যাকিংয়ের সাথে সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিন্টুর সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে বলেন, “হ্যাকিংয়ে জড়িতদের আশ্রয়, প্রশ্রয় ও নিরাপত্তা দিতে সাবেক চেয়ারম্যান মিন্টু ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সে অফিসে বসে থেকে এসব কাজ করতো। সে নিজেও হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, গাড়ি – বাড়ি করেছে।”

 

এ বিষয়ে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিন্টু অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, লালপুরের বিলমাড়িয়াতে ২০১৪-১৫ সাল থেকে ইমো হ্যাকিং শুরু হয়। সে সময় আমি কঠোর হাতে ইমো হ্যাকারদের দমন করার চেষ্টা করলে সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে আমার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। আমাকে ভয়ভীতি এবং হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। তারপরও আমি প্রশাসনকে অবহিত করি এবং অভিভাবক সমাবেশ করে ইমো হ্যাকারদেরকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিলাম। ইমো হ্যাকিংয়ের সঙ্গে আমার জড়িত থাকার বিষয়ে কেউ কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবেনা এবং ইমো হ্যাকিং থেকে আমি এক টাকা নিয়েছি এরকম কোন তথ্য প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না। বরং বর্তমান চেয়ারম্যান সিদ্দিক আলী মিষ্টুর ছত্রছায়াতেই এখন হ্যাকাররা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

 

এ বিষয়ে লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ নাজমুল হক সময়ের প্রত্যাশাকে বলেন, অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এদিকে র‍্যাব-৫ (নাটোর শাখা) বলেন, অতীতে আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আবার আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


প্রিন্ট
Tag :
এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ
error: Content is protected !!

নাটোরের লালপুর এখন ইমো হ্যাকারদের অভয়ারণ্য, আটকদের মুক্ত করতে আছে গোপন সংগঠন

আপডেট টাইম : ১০ ঘন্টা আগে
রাশিদুল ইসলাম রাশেদ, লালপুর (নাটোর) প্রতিনিধি :

রাশিদুল ইসলাম রাশেদঃ

 

জনপ্রতিনিধিদের ছত্রছায়া ও প্রশাসনের স্থবিরতায় নাটোরের লালপুর এখন ইমো হ্যাকারদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। নাটোরের লালপুর উপজেলাকে একসময় দেশের মানুষ চিনতো উষ্ণতম স্থান, সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাতের এলাকা এবং কাঁসা শিল্পের সুনামের কারণে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে দেশের মানুষ লালপুরকে চিনে ইমো হ্যাকিংয়ের স্বর্গরাজ্য হিসেবে। আর উপজেলার বিলমাড়িয়া ইউনিয়নকে বলা হয় এই ইমো হ্যাকিংয়ের সদর দপ্তর।

 

২০২২ – ২০২৩ সালে লালপুরে ইমো হ্যাকিং নিয়ে গণমাধ্যমে ক্রমাগত সংবাদ প্রচার হলে প্রশাসন কিছুটা নড়েচড়ে বসে। তবে ২০২৪ সাল থেকে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় লালপুর আবার ইমু হ্যাকিংয়ের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আর এ সকল অবৈধ কাজে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান, বর্তমান ইউপি সদস্য, গ্রামপুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের ছত্রছায়া আছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা যায়, এক সময় উপজেলার বিলমাড়িয়া ও দুড়দুড়িয়া ইউনিয়নের কিছু সংখ্যক কিশোর ও যুবক ইমো হ্যাকিংয়ের সাথে জড়িত থাকলেও বর্তমানে ইউনিয়ন দুটির অনেক বাড়িতে ইমো হ্যাকিং চক্রের সদস্য গড়ে উঠছে। এর প্রভাবে পাশ্ববর্তী লালপুর ও আরবাব ইউনিয়ন এবং বাঘা উপজেলার খানপুর, জোতরাঘব, সরেরহাট, চন্ডিপুর সহ আশেপাশের গ্রামগুলোতে ইমো হ্যাকিং বিস্তার লাভ করেছে।

 

উপজেলার বিলমাড়িয়া, অমৃতপাড়া, রহিমপুর, মোহরকয়া, মোমিনপুর, ভেল্লাবাড়িয়া, গন্ডবিল, পানসিপাড়া, মনিহারপুর, নওপাড়া, নাগশোষা, মহারাজপুর, দুড়দুড়িয়া, পাইকপাড়া, রামকৃষ্ণপুর এলাকা ঘুরে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, গ্রামের উঠতি বয়সী কিশোর-যুবক, ঝরে পড়া স্কুল শিক্ষার্থী ও কলেজগামী শিক্ষার্থীরা ইমো হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে টাকা উপার্জনে বেশি জড়িয়ে পড়ছে। অনেকক্ষেত্রে, অভিভাবকরাও অর্থের প্রলোভনে পড়ে তাদের এই অনৈতিক অবৈধ কাজকে সমর্থন করছেন। অনেকেই এখন এই অবৈধ ইমো হ্যাকিংকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করছে। হ্যাকিংয়ের টাকা দিয়ে কেউ কিনছেন অতিরিক্ত মূল্যে জমি -জমা, কেউ গড়েছেন বিলাসবহুল বাড়ি।

 

 

আইন শৃঙ্খলা বাহিনী থেকে রক্ষা পেতে সেসকল বাড়ির চারপাশে আবার লাগানো হয়েছে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা। হ্যাকিংয়ে জড়িতরা সাধারণত সারাদিন ঘুমায়। বিকাল থেকে বাজার ও বিভিন্ন চা স্টলগুলোতে তাদের আনাগোনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এসময় তারা নামি-দামি বিভিন্ন ব্র‍্যান্ডের মোটরসাইকেল নিয়ে বেপরোয়া গতিতে তাদের আড্ডা খানাগুলোতে বিশেষ করে ফাঁকা মাঠ, বাঘা উপজেলার আলাইপুর ও মিরগঞ্জের বিভিন্ন মাদক বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে যায়। মাদক সেবন শেষে তারা যাত্রা পথে বিভিন্ন চা স্টলগুলোতে যাত্রা বিরতি করে এবং দামী ব্র‍্যাণ্ডের সিগারেট ও চা খেয়ে থাকেন। তাদের সুবিধার্থে কোন কোন চা স্টলে গোপনীয় (বিশেষ) চেম্বার ও ক্যারাম খেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারা সাধারণত সমাজের সিনিয়র সিটিজেনদের অবজ্ঞার চোখে দেখে এবং অর্থের প্রভাব দেখাতে উশৃংখল আচরণ করতে দ্বিধাবোধ করে না। এমনকি টাকা দিয়ে সবাইকে কিনে নেয়ার দম্ভ করে। তারা যখন চা স্টল, সেলুন, হাট-বাজার, দোকান কিংবা মার্কেটে যান, তখন তারা দামাদামি করে কোন কিছু ক্রয় করেন না এবং অতিরিক্ত পাওনা টাকা ফেরত নেন না। খাবার হোটেলগুলোতে তাদের জন্য দেওয়া হয় বিশেষ ট্রিট। চলেন রাজকীয় স্টাইলে।

 

লালপুরের একজন ইলেকট্রিসিয়ান বলেন, তাদের গ্রাম ও পাশের গ্রামের অনেক ঝরে পড়া স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থী, ইজিবাইক ও পাওয়ার টিলার চালকরা ইমো হ্যাকিং করে এখন কোটিপতি। অথচ কয়েকমাস আগেও তারা কিংবা তাদের অভিভাবকরা দিন মজুর, ভ্যান চালানো ও ইটের ভাটায় কাজ করতো। এছাড়া তাদের অর্থ আয়ের দৃশ্যমান কোন উৎস নাই। শুধুমাত্র হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে তারা আজ কোটিপতি বনে গেছেন। তবে বর্তমানে কেউ কেউ ইমো হ্যাকিংকে আড়াল করতে লোক দেখানো বিভিন্ন ব্যবসা শুরু করেছেন।

 

অধিকাংশ হ্যাকার সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হ্যাকার বলেন, একজন হ্যাকার প্রতি মাসে গড়ে ১৫-২০ লাখ টাকা হ্যাক করে থাকেন। তারা সাধারণত প্রবাসী ও ধনী ব্যবসায়ীদের টার্গেট করেন। এজন্য তারা সামাজিক মাধ্যমে প্রথমে টার্গেটেড ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। পরে কৌশলে তাদের ইমো কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হ্যাঁক করে বিভিন্নভাবে অর্থ হাতিয়ে নেন। এক্ষেত্রে তারা বিকাশ, নগদ, রকেট সহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বর ব্যবহার করে থাকেন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্টরা একটা নির্দিষ্ট পরিমান (২০ – ৩০ %) অর্থ কমিশন নিয়ে হ্যাকারদের টাকা উত্তোলনে সাহায্য করে থাকে। এতে তারাও (এজেন্টরা) ফুলে ফেপে উঠেছেন।

 

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে আরেক হ্যাকার বলেন, ‘আমি আগে হ্যাকিংয়ের কাজ করতাম। এখন আর করি না। তবে হ্যাকিংয়ের সাথে স্থানীয় ইউপি সদস্য ও গ্রাম পুলিশরাও জড়িত। প্রতি মাসে তাদের চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেওয়া ও আইনি ঝামেলায় ফেলানো হয়। তবে টাকা দিয়ে সবাইকে ম্যানেজ করা হয়। এজন্য হ্যাকারদের একাধিক গোপন সংগঠন রয়েছে। কেউ আটক হলে কিংবা আইনি ঝামেলায় পড়লে অন্যরা তাকে মুক্ত করে আনে। তাদের কাছে টাকা কোন ফ্যাক্ট নয়। ‘ মাদক সেবনের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, রাত জেগে কাজ করার জন্য গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল সহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য হ্যাকিংয়ের একটি অনুসঙ্গ হিসেবে সেবন করা হয়। এক্ষেত্রে হ্যাকারদের দুইভাগে ভাগ করা হয়। যারা শিক্ষানবিশ হ্যাকার, তারা সাধারণত গাঁজা সেবন করে। এবং যারা হ্যাকিংয়ে দক্ষতা অর্জন করে, তারা ফেনসিডিল ও ইয়াবা সেবন করে। হ্যাকিংয়ে প্রতি মাসে গড়ে কমপক্ষে ৫ লক্ষ টাকা আয় করতে পারলে তাকে দক্ষ হ্যাকার ধরা হয়।’

 

লালপুর থানা সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালে হ্যাকিংয়ের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ৪ টি মামলা হয়েছে। তবে ২০২৪ সাল থেকে কোন হ্যাকার আটক হননি এবং কোন মামলা হয়নি। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এমন স্থবিরতায় হ্যাকার চক্রগুলো নির্ভয়ে তাদের হ্যাকিং চালিয়ে যাচ্ছে। আর হ্যাকিংয়ের অভয়ারণ্যে সব হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে হ্যাকিংয়ের শিকার পরিবারগুলো।

 

হ্যাকিংয়ের বিষয়ে বিলমাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিদ্দিক আলী মিষ্টু সময়ের প্রত্যাশাকে বলেন , “এখনতো আইন-শৃংখলা বাহিনী সবকিছু উন্মুক্ত করে দিয়েছে। সরকার সাইবার নিরাপত্তা আইন বন্ধ করার ঘোষণা দেয়ার পর থেকে পুলিশ কোন অ্যাকশনে যাচ্ছে না। ফলে এখন অবাধে সকল হ্যাকিং কার্যক্রম চলছে।” এ সময় তিনি হ্যাকিংয়ের সাথে সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিন্টুর সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে বলেন, “হ্যাকিংয়ে জড়িতদের আশ্রয়, প্রশ্রয় ও নিরাপত্তা দিতে সাবেক চেয়ারম্যান মিন্টু ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সে অফিসে বসে থেকে এসব কাজ করতো। সে নিজেও হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, গাড়ি – বাড়ি করেছে।”

 

এ বিষয়ে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিন্টু অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, লালপুরের বিলমাড়িয়াতে ২০১৪-১৫ সাল থেকে ইমো হ্যাকিং শুরু হয়। সে সময় আমি কঠোর হাতে ইমো হ্যাকারদের দমন করার চেষ্টা করলে সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে আমার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। আমাকে ভয়ভীতি এবং হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। তারপরও আমি প্রশাসনকে অবহিত করি এবং অভিভাবক সমাবেশ করে ইমো হ্যাকারদেরকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিলাম। ইমো হ্যাকিংয়ের সঙ্গে আমার জড়িত থাকার বিষয়ে কেউ কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবেনা এবং ইমো হ্যাকিং থেকে আমি এক টাকা নিয়েছি এরকম কোন তথ্য প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না। বরং বর্তমান চেয়ারম্যান সিদ্দিক আলী মিষ্টুর ছত্রছায়াতেই এখন হ্যাকাররা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

 

এ বিষয়ে লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ নাজমুল হক সময়ের প্রত্যাশাকে বলেন, অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এদিকে র‍্যাব-৫ (নাটোর শাখা) বলেন, অতীতে আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আবার আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


প্রিন্ট