ইসমাইল হোসেন বাবুঃ
ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নির্মিত তৎকালীন সময় ১ কোটি ৮০ লাখ ৬ হাজার ৭শ’ ৯৬ টাকা ব্যয়ে ভেড়ামারা-পাকশী’র হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। কথা ছিলো এই ব্রিজের উপর দিয়ে ভারি-ভারি ট্রেন যতখুশী তত প্রতিদিন চলাচল করতে পারবে ১শ’ বছর। গ্যারান্টির সময় পার হয়ে ১১১ বছরে পদার্পণ করলো হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। কিন্তু এ পর্যন্ত কিচ্ছুই হয়নি ব্রিজটির। দীর্ঘ সময় ধরে পদ্মানদীর পানির উপর দাঁড়িয়ে থাকা এই ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, তবু এক চিলতি তার রূপ-যৌবন কমেনি!
১৯১৫ সালের ৪ মার্চ ঐতিহাসিক হার্ডিঞ্জ সেতু উদ্বোধনকালে সেতু প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী স্যার রবার্ট উইলিয়াম গেলস্ আবেগভরে বলেছিলেন, ‘যে সেতু নির্মাণ করে গেলাম, উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে এ সেতু চিরযৌবনা হয়ে থাকবে।’ কথাটি যে কতখানি সত্য, তার প্রমাণ ১১০ বছর আগে পদ্মা নদীর বুকে তৈরি করা এই ব্রিজটি শতবর্ষ পেরিয়ে ১১১ বছরে পদার্পণ করলেও সেতুর গায়ে বার্ধক্যের কোনো ছাপ পড়েনি। অনেক শাসক-শোষক ও প্রজন্মের সাক্ষী হয়ে শতবর্ষ পেরিয়ে আজও বীরদর্পে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।
মেয়াদোত্তীর্ণ এই ব্রিজটি ১১০ বছর পূর্ণ হয়ে ১১১ বছরে পদার্পণ করলেও দিব্বি ব্রিজটি দাঁড়িয়ে আছে। সবকিছুই ঠিকঠাক থাকায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর দিয়ে চলছে নিয়মিত ট্রেন।
এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রেলসেতু। এখনও এই ব্রিজটি দেখতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক মানুষ প্রতিদিনই পাকশী-ভেড়ামারায় ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ একনজর দেখার জন্য আসছেন বেড়াতে।
পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলাকে সংযুক্তকারী এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ একসময় ছিল বাংলাদেশের দীর্ঘতম রেলসেতু। বাংলাদেশের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের অন্যতম সেতুবন্ধ তৈরি করেছে ঐতিহাসিক এই ব্রিজটি। এই ব্রিজ দেখার জন্য এখন পর্যন্ত দূর-দুরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা পাকশি-ভেড়ামারা দু’পাড়ে ভীড় করে।
শ্যামলী বাংলার রূপসী পদ্মা নদীর এক তীরে ছিল সাঁড়াঘাট, অপর পাড়ে ভেড়ামারা দামুকদিয়া রায়টা ঘাট। মাঝখানে প্রশস্ত পদ্মা তার ওপর উপমহাদেশের দীর্ঘতম রেলওয়ে ব্রিজ। এরই দক্ষিণ পাশে রয়েছে লালন শাহ্ সেতু।
দর্শনার্থীরা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কাছ থেকে দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে পদ্মার দু’পাড়ে। ঈদের সরকারি ছুটির কারণে মানুষের সমাগম অনেক বেড়ে যায়। এখানে এসে যে যার মতো করে ছবি, সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে শেয়ার ও পোষ্ট করে থাকেন।
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে সেতু প্রকৌশলী দপ্তর থেকে জানা যায়, ১৯০৯ সালের প্রথম ভাগে প্রাথমিক জরিপ, জমি অধিগ্রহণ ও প্রয়োজনীয় পাথর সংগ্রহের কাজ শুরুর মধ্য দিয়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নির্মাণকাজ শুরু হয়।
মেয়াদোত্তীর্ণ এই ব্রিজটি ১১১ বছরে পদার্পণ করলো। দিব্বি ব্রিজটি দাঁড়িয়ে আছে। সবকিছুই ঠিকঠাক থাকায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর দিয়ে চলছে নিয়মিত ট্রেন।
পাকশী রেলওয়ে অফিস সূত্রে আরো জানা যায়, ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিজটি উদ্বোধন করেন। এরপর থেকে ব্রিজের ওপর দিয়ে যাত্রীবাহী গাড়ি ও ট্রেন চলাচলের জন্য তা উন্মুক্ত করা হয়। তার নামানুসারেই এর নামকরণ করা হয় ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’।
বাংলাদেশ রেলওয়ে অতিরিক্ত মহা পরিচালক (অবকাঠামো) আরিফুজ্জামান, বিভাগীয় রেলওয়ে পাকশী অফিসের ব্যবস্থাপক শাহ্ সুফী নুর মোহাম্মদ ও প্রধান প্রকৌশলী (পশ্চিম) রাজশাহী আসাদুল হকের তথ্য মতে জানা যায়, ১৯১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ২৪ হাজার ৪০০ শ্রমিক কাজ করে ১৯১৪ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ করেন। সেতুর ১৫টি স্প্যানের দুটি বিয়ারিংয়ের মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্য ৩৪৫ ফুট দেড় ইঞ্চি এবং উচ্চতা ৫২ ফুট। প্রতিটি স্প্যানের ওজন ১২৫০ টন, যা রেল লাইনসহ ১৩০০ টন। সেতুটিতে মোট ১৫টি স্প্যান ছাড়াও দুই পাড়ে তিনটি করে অতিরিক্ত ল্যান্ড স্প্যান রয়েছে।
পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও ঈশ্বরদীর ঐতিহাসিক নিদর্শন নিয়ে গবেষণাকারী প্রবীণ অধ্যাপক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ বলেন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজটির বয়স ১১০ বছর পূর্ণ হলো। শতবছর পূর্তির সময় সেতুটি পরিদর্শন করে বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, এই সেতু সঠিকভাবে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করলে এটি আরও অন্তত ২৫ বছর টিকে থাকতে পারে।
পাকশী বিভাগীয় সেতু প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন জানান, এই ব্রিজটি গত মঙ্গলবার (৪ মার্চ) ২০২৫ সালে এর বয়স ১১০ বছর পূর্ণ হয়। ১১১ বছরে পদার্পণ করলেও নির্মাণের সময় আয়ুকাল ১০০ বছর ছিল। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে এ ব্রিজ নিয়ে গবেষণা ও লৌহ কাঠামোর ধাতুর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আরও ২৫ বছর এটি চলবে বলে গবেষকরা জানান। ফলে ব্রিজটি ২০৪০ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকছে। তারপরও এ ব্রিজের পাশে নতুন আরেকটি ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। নতুন ব্রিজের সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে।
প্রিন্ট