নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের দায় এড়ানোরা সুযোগ নেই কর্তৃপক্ষের। ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। এক্ষেত্রে মানা হয়নি শিল্পনীতি অনুযায়ী বিল্ডিং কোড।
কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, ভবনে ছিল না যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। জরুরি নির্গমনের পথ ছিল বন্ধ। বিভিন্ন ফ্লোরের কেচিগেটগুলো ছিল বন্ধ। ভবনটি ছিল দাহ্য পদার্থে ঠাসা। এটি ছিল উৎপাদনমুখী কারখানা। নিয়ম বহির্ভূতভাবে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছিল গোডাউন।
এদিকে আগুন লাগার পরও শ্রমিকদেরকে ভেতরে আটকে রাখার অভিযোগ রয়েছে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
শ্রমিকরা অভিযোগ করে বলেন, ভবনটি বিল্ডিং কোড না মেনে করা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের সময় ৬ তলা ভবনটির মধ্যে ৪ তলার শ্রমিকরা কেউ বের হতে পারেননি। সিকিউরিটি ইনচার্জ ৪ তলার কেচিগেটটি বন্ধ করে রাখায় কোন শ্রমিকই বের হতে পারেনি।
তারা আরও জানান, ভবনের পঞ্চম তলায় ছিল কেমিক্যালের গোডাউন। আর কারখানা কর্তৃপক্ষের অবহেলায় এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গোডাউনের কারণে আগুন ভয়াবহ রূপ নেয়। অগ্নিকাণ্ডের সময় বহির্গমন পথ না থাকায় কারখানার ভিতরে অনেক লোক আটকা পড়ে। তাদের ভিতর থেকে বের করতে পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেয়নি কারখানা কর্তৃপক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেড এন্ড বেভারেজের ছয়তলা ভবনে থাকা কারখানাটির নিচ তলার একটি ফ্লোরে কার্টুন এবং পলিথিন তৈরির কাজ চলত। সেখান থেকেই হঠাৎ করে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। ভবনে প্রচুর পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্য থাকায় আগুনের লেলিহান শিখা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অগ্নিকাণ্ডে ভস্ম হয়ে ভবনের সবকিছু।
হঠাৎ কালো ধোয়ায় কারখানাটি অন্ধকার হয়ে যায়। আবার ওপরে কেচিগেট বন্ধ থাকায় কেউ ছাদে উঠতে পারেনি। বাঁচার আকুতি জানিয়ে তারা মোবাইল ফোনে স্বজনদের সঙ্গে শেষ কথা বলেছেন।
শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, আগুন নিভে যাবে বলে চার তলায় তালা দিয়ে ৭০ থেকে ৮০ জন শ্রমিককে ভেতরে বসিয়ে রাখা হয়। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অন্যান্য তলার শ্রমিকরা অনেকে বের হতে পারলেও চারতলার শ্রমিকরা বের হতে পারেনি। আগুনের খবর পেয়ে পাঁচ তলা থেকে কেউ কেউ লাফিয়ে পড়েন।
নিখোঁজ শ্রমিক তাছলিমা আক্তারের বাবা আক্তার হোসেন বলেন, মালিকপক্ষের দোষেই কারখানায় আগুন লাগে। এছাড়া মালিকপক্ষ শ্রমিকদের চারতলায় আটকে রেখে হত্যা করে। আমরা এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।
তিনি বলেন, কারখানাটিতে দুটি গেট থাকলেও একটি গেট কারখানা কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে রাখে। কোনো দুর্ঘটনা হলে শ্রমিকরা দ্রুতগতিতে বের হতে গেলেও শ্রমিকদের পদদলিত হওয়ার শঙ্কা থাকে।
নিখোঁজ শ্রমিক আলাউদ্দিনের ভাই নসরুল্লাহ অভিযোগ করে বলেন, হাসেম ফুড কারখানাটি অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চলতো। এ কারখানায় অগ্নি নির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এছাড়া কারখানাটিতে বেশিরভাগই শিশু শ্রমিক কাজ করতো। এছাড়া কারখানাটি খাদ্য পণ্যে অতিরিক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করতো। অতিরিক্ত কেমিক্যালের কারণে আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের এতো দেরি হয়। এছাড়া কারখানাটির ভবন থেকে বের হতে শ্রমিকদের জন্য কোন ইমারজেন্সি এক্সিটের ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
এ বিষয়ে র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, কারখানার ভিতরে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল না, গুদামের ভেতর কর্মীরা গাদাগাদি করে অবস্থান করত, আগুন লাগার পর কর্মীদের বাইরে বের হতে না দেওয়া, জরুরি নির্গমন পথ না থাকা, ছাদে ওঠার পথ বন্ধ করে রাখা ইত্যাদি অভিযোগ আমরা শুনেছি। সবকিছুই তদন্তের আওতায় থাকবে। আর এ বিষয়টি নিয়ে গুজব না ছড়ানোর জন্য অনুরোধ জানান তিনি।
কলকারখানা অধিদফতরের মহা পরিদর্শক নাসির উদ্দিন আহম্মেদ ফায়ার সার্ভিসের বরাত দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, কারখানার ভেতরে ৪ তলায় ও সিঁড়ি লোহার শিকের নেট দিয়ে আটকানো ছিল। এ কারণে কর্মীরা ছাদে উঠতে পারেনি। তারা ছাদে উঠতে পারলে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা সহজেই তাদের উদ্ধার করতে পারতেন। প্রকৃত তদন্ত হলে সবকিছু বেরিয়ে আসবে। এখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল কি না; তা আমরা খতিয়ে দেখছি।
কর্ণগোপ এলাকায় সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেড কারখানায় প্রায় সাত হাজার শ্রমিক কাজ করেন। সাততলা ভবনে থাকা কারখানাটির নিচতলার একটি ফ্লোরের কার্টন থেকে হঠাৎ আগুনের সূত্রপাত ঘটে। একপর্যায়ে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৫৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
প্রিন্ট