রাশিদুল ইসলাম রাশেদ, লালপুর (নাটোর) প্রতিনিধি
পৌষ ও মাঘ মাসকে শীতকাল হলেও, এ বছর পৌষ মাস আসার আগেই তীব্র শীত জেঁকে বসেছে নাটোরের উষ্ণতম উপজেলা লালপুরে। তাপমাত্রা নেমে গেছে ১২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা চলতি মৌসুমে লালপুরের সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড। তীব্র শীত, ঝোড়ো বাতাস, ঘন কুয়াশা এবং মাঝে মাঝে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। বিশেষত, ছিন্নমূল এবং নিম্ন আয়ের খেটে-খাওয়া মানুষরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন। শীত ও কনকনে ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে হতদরিদ্র মানুষজন খড়কুটো জ্বালিয়ে উষ্ণতা নিচ্ছেন।
এছাড়া, ঘন কুয়াশার কারণে রাস্তায় বিভিন্ন যানবাহনকে আলোগুলো জ্বালিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বোরো ধানের বীজতলা নিয়ে। শীতের প্রকোপে ঠাণ্ডাজনিত শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া এবং ডায়রিয়ার প্রকোপও বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিদিনই ঠাণ্ডাজনিত কারণে বহু শিশু হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছে।
লালপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্যে জানা যায়, বুধবার সকাল ৯টা পর্যন্ত হাসপাতালে শিশু ও ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ১২টি শিশু ভর্তি ছিল। গত কয়েকদিনে সর্দি, জ্বর, নিউমোনিয়া এবং ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। শয্যা সংকটের কারণে অনেক রোগীকে ওয়ার্ড এবং করিডরের মেঝেতে জায়গা দিতে হয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. সুরুজ্জামান শামীম জানান, “হঠাৎ বৈরী আবহাওয়ার কারণে শিশু এবং বয়স্করা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। শীত বাড়ায় শিশু ও বয়স্কদের ঘরের বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।”
এদিকে, এ বছর এখন পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনো শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়নি। মঙ্গলবার রাত ১১টায় লালপুরের আব্দুলপুর জংশন স্টেশন, আজিমনগর রেল স্টেশন এবং লালপুর বাজারে ছিন্নমূল মানুষদের শীতের কষ্ট সহ্য করতে দেখা যায়। তাদের গায়ে কেবল পাতলা কম্বল বা চাদর ছিল।
আবহাওয়া পরিস্থিতি:
ঈশ্বরদী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবহাওয়াবিদ হেলালউদ্দিন জানান, দক্ষিণপূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় একটি লঘুচাপ বিরাজমান রয়েছে, যার প্রভাবে বাংলাদেশে তাপমাত্রা কমছে। বুধবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া, আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে।
কুয়াশার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে, যা দুপুর পর্যন্ত কোথাও কোথাও অব্যাহত থাকতে পারে। রাত এবং দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
আবহাওয়া অফিসের তথ্যে জানা যায়, তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তা মৃদু শৈত্যপ্রবাহ, ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি হলে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ, ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি হলে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ এবং ৪ ডিগ্রির নিচে নেমে গেলে তা অতি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে গণ্য হয়।
কৃষকের দুরবস্থা:
সকালে কৃষ্ণরামপুর গ্রামের ভ্যানচালক শরিফুল ইসলাম বলেন, “দুপুর হয়ে গেলেও রোদ উঠছে না। কনকনে বাতাসের কারণে খুব ঠাণ্ডা লাগছে। ঠান্ডায় হাত-পা শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন ঠাণ্ডায় যদি গায়ে কম্বল দিয়ে শুয়ে থাকতে পারতাম তবে ভালো লাগত। কিন্তু পেটের খিদে নিয়ে কি আর বাড়িতে আরামে থাকতে পারি?”
উপজেলার বিলমাড়িয়া ইউনিয়নের রহিমপুর গ্রামের কৃষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “দুইদিন ধরে বৃষ্টির মতো কুয়াশা পড়ছে। এমন কুয়াশায় কাজ করা যায় না। গতকাল সারাদিন রোদ উঠেনি। বর্তমানে মাঠে কাজ করা খুব সমস্যা।”
হাসেমপুর গ্রামের কৃষক সুশান্ত পাল বলেন, “কয়েকদিন ধরে খুব ঠাণ্ডা পড়ছে। মাঠে কাজ করা যাচ্ছে না। এর সাথে আবার ঘন কুয়াশায় বোরো ধানের বীজতলা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি।”
কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ:
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রীতম কুমার হোড় জানান, এ বছর উপজেলায় ১০৫৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে শীত ও ঘন কুয়াশায় বীজতলা যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য কৃষকদের রাতে পানি দিয়ে বীজতলা ঢেকে রাখার এবং সকালে পলিথিন তুলে বীজতলা রক্ষার জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুনঃ ভুল ও সরল মনকে দায়ী করে ২০ লাখ টাকাসহ বিমান বন্দরে আটকের ব্যাখা দিলেন যমেক অধ্যক্ষ
তীব্র শীত এবং ঘন কুয়াশায় লালপুরে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, আর বিশেষত খেটে-খাওয়া মানুষ এবং কৃষকদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে।
প্রিন্ট