রাশিদুল ইসলাম রাশেদ, লালপুর (নাটোর) প্রতিনিধি
“নাচছে ঢেঁকি পায়ের তালে
ধান কুটতেছে বধূ,
গাইছে সবে নবান্নের গীত
ঝরছে মুখে মধু।”
উপরের চরণগুলোতে কবি ‘সেলিম হোসেন’ গ্রাম-বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য – নবান্নের কর্মযজ্ঞ ও রূপ বৈচিত্র্য ফুটিয়ে তুলেছেন।
কবির কবিতার মত নবান্ন এখন অনেকটাই কাগজ-কলম ও প্রাতিষ্ঠানিক উৎসবে পরিণত হয়েছে । বাংলাদেশকে বলা হয় উৎসবের দেশ। এ দেশে যতগুলো উৎসব হয় সেগুলোর মধ্যে অন্যতম নবান্ন উৎসব। নবান্নের এই সময়ে শিশিরভেজা প্রকৃতি এসে জানিয়ে দেয় হেমন্ত এসে গেছে। কিছুদিন পরেই শীত আসবে। একসময় হেমন্তকালের এ উৎসব ছিল সর্বজনীন। কিন্তু কালক্রমে হারিয়ে যেতে বসেছে নবান্ন উৎসব ।
জানা যায়, হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই নবান্ন উৎসবের সূচনা হয়। নবান্ন অর্থ ‘নতুন অন্ন’ পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব। নবান্ন হলো নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে ফসল তোলার পরদিনই নতুন ধানের নতুন চালে ফিরনি-পায়েশ অথবা ক্ষীর তৈরি করে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে বাড়িতে ডেকে এনে খাওয়ানো হয়। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃপুরুষ অন্ন প্রার্থনা করে থাকেন। এই কারণে হিন্দুরা পার্বণ বিধি অনুযায়ী নবান্নে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করে থাকেন। শাস্ত্রমতে, নবান্ন শ্রাদ্ধ না করে নতুন অন্ন গ্রহণ করলে পাপের ভাগী হতে হয়। [সূত্র: ইউকিপিডিয়া]
ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে নবান্নকে কেন্দ্র করে বাঙালিরা উৎসবে মেতে ওঠে । অগ্রহায়ণে নবান্ন কিষান-কিষানির জন্য নিয়ে আসে খুশির বার্তা। দীর্ঘদিন অক্লান্ত পরিশ্রমে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে একবুক উচ্ছ্বাস নিয়ে ঘরে তোলে নতুন ফসল। নবান্ন উৎসব তাদের সব দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। গ্রাম বাংলায় নতুন এক আবহের সৃষ্টি হয়। নবান্ন উপলক্ষে আগের দিন প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় আতপ চালের গুঁড়া গুলিয়ে আলপনা আঁকা হয়। মুসলিমরা নতুন ধান কেটে বউ, মেয়ে-জামাইসহ স্বজনদের দাওয়াত করে আনেন। তাদের নিয়েই চলে পিঠা উৎসব। নতুন চাল ঢেঁকি দিয়ে গুঁড়া করে তৈরি করা হয় হরেক রকম পিঠা। ভাপা, চিতই, দুধপুলি, পুলিপিঠা, পায়েস, সেমাই, ক্ষীর, খই, মুড়ি আরো কত কী! শীতের আগমনীতে খেজুর রস দিয়ে তৈরি করা হয় এসব সুস্বাদু পিঠা। বাড়ির আঙিনায়, স্কুলের মাঠে কিংবা নদীর ধারে, হাটে কিংবা বড় কোন বটগাছের নিচে খোলা মাঠে যাত্রা, নাটক, জারি-সারি, বাউল ও পালাগানের আসর বসে। কোথাও কোথাও গ্রাম্য মেলার দেখা মিলে। নবান্ন ঘিরে মেলায় দেখা যায় নাগরদোলা, পুতুলনাচ, বায়োস্কোপসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।
ঋতুচক্রে নাটোরের লালপুরেও বরাবরের মত শুরু হয়েছে আমন ধান কাটা উৎসব । এ উপজেলায় ১টি পৌরসভা, ১০টি ইউনিয়ন এবং ছোট বড় ২২০টি গ্রাম রয়েছে। হেমন্তের আমন ধান কাটা শুরু হলে একসময় গ্রামের চারিদিকে নবান্ন উৎসবের আমেজ বিরাজ করত। কিন্তু বর্তমানে আমন ধান কাটা শুরু হলেও এ উপজেলার গ্রামগুলো থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্য ও সবচেয়ে প্রাচীনতম উৎসব নবান্ন ।
কালের পরিক্রমায়, এখন শুধু কার্তিকের শেষে আর অগ্রহায়ণের শুরুতে কিছু প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোতে নবান্ন উৎসব পালন করা হয়। বলা চলে, গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যকে প্রদর্শন করানো হয়। সেখানে প্রান্তিক কৃষক – কৃষাণীদের শ্রম, অশ্রু, আনন্দ, আবেগ-ভালোবাসা অনেকটা অনুপস্থিত থাকে। এখন আর নবান্নকে ঘিরে উৎসবের সেই আমেজটা দেখা যাচ্ছে না। বাড়িতে পিঠাপুলি তৈরি হলেও গ্রামের সবাই মিলে একসঙ্গে ভাগাভাগি করে খাওয়া, বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে পরম যত্নে খাওয়ানো, রঙিন কাগজে গ্রাম সাজানো, আলপনা আকা আর দেখা যাচ্ছে না।
উৎসব উপলক্ষে এখন আর জারি-সারি, পালাগান, যাত্রা, নাটক, গ্রাম্য মেলা, পুতুলনাচ, বায়োস্কোপ দেখা যায় না বললেই চলে। নতুন আলফা প্রজন্মের কাছে এগুলো আস্তে আস্তে রূপকথার গল্পের মতো হয়ে যাচ্ছে । আধুনিকতার যান্ত্রিক ছোয়ায় মানুষের মনের খোরাক, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এখন গৌন বিষয়ে পরিনত হচ্ছে।
এদিকে উপজেলায় শ্রী শ্রী গোসাঁই এর আশ্রমে প্রতি বছর ১লা অগ্রহায়ণে নবান্ন উৎসব পালন করা হলেও এবছর তা করা হয়নি। তাদের সাথে যোগাযোগ করলে জানানো হয় যে ৩রা ডিসেম্বর এবছরের নবান্ন উৎসব করা হবে । এছাড়া উপজেলার অনান্য সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো থেকেও এবছর নবান্ন উৎসব পালনের ব্যাপারে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি ।
অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী পূজা রানী দাশ বলেন, ‘আমরা ১লা অগ্রহায়নে বাড়িতে নবান্ন করেছি । তবে সবাই একসাথে করা হয়নি । সবাই একসাথে করলে অনেক মজা হতো।‘
নবান্ন উৎসব পালন বিষয়ে কথা হয় উপজেলার অন্যতম বর্ষীয়ান, উধনপাড়া গ্রামের ১১০ বছর বয়সী রহমত হালসানার সাথে । তিনি বলেন, ‘আগের দিনের মতো অঘ্রাণ মাসে ঢেঁকিতে চিড়া কোটা, সকাল সাঝে মেয়েদের খই ও মুড়ি ভাজা, ফাঁপাপুলি, পলিপিঠা খাওয়ার ধুম এখন আর নেই। যে যার মত পারে, যখন ইচ্ছা তখন করে আর খায়। নবান্নের হিসাব নাই।’
সাংস্কৃতিক কর্মী আ: রশিদ বলেন, ‘আগে নবান্ন উপলক্ষে যাত্রাপালা, নাটক ও গান হতো । আমরা গ্রামের মানুষ মহা আনন্দে গান গাইতাম, নাচতাম, অভিনয় করতাম । এখন সেই অয়োজনও নাই, রোমাঞ্চও নাই।’
উপজেলার বাহাদুরপুরের সাওতাল পল্লী (পাহাড়ি) গিয়ে গতকাল কথা হয় শ্রী লঘু, শ্রী সুরেন ও সারথি দেবীর সাথে । তারা বলেন, আগে মুরব্বিরা ছিলো, নানান নিয়মকানুন মেনে তারা নবান্ন পালন করতেন। এখন মুরব্বিরা নাই, যারা আছে দায়িত্ব নিতে চান না। এখন সব সময় ধান হয়, যার যখন ইচ্ছে হয় পিঠাপুলি, ক্ষির-পায়েশ করে খাই। আগের মত সবাই একসাথে একই দিনে নবান্নের উৎসব পালন করা হয় না। তবে উদ্যোগ নিয়ে উৎসবটি জাগ্রত করলে সবাই আবার অংশগ্রহণ করবে। ঐতিহ্য বেঁচে থাকবে।
আরও পড়ুনঃ রাজশাহীতে ডিগ্রী ছাড়াই চিকিৎসা সেবা, জরিমানা ১০ হাজার টাকা
নব্বইয়ের দশকেও মহাসমারোহে নবান্ন পালিত হতো। সেসব এখন অতীত । এখন শুধু মানস পটে ভেসে উঠে বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর সেই সময়ের রঙিন দিনগুলো।
পরিশেষে বলতেই হচ্ছে, ‘নবান্নের সেই দিনগুলি আজ আর নেই।’
প্রিন্ট