ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অবৈধ বাংলাদেশি মুসলিমদের জন্য কোনো সুখবর নয়। আগামী চার বছর তাদেকে সুখবরের বদলে আতঙ্কেই দিন কাটাতে হবে বলে মতামত দিয়েছেন বাংলাদেশি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। তিনি প্রেসিডেন্ট পদে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হবার পর যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বৃহত্তম অভিবাসী প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার ঘোষণা দেন। বাংলাদেশি পর্যবেক্ষকদের মতে ট্রাম্পের অভিবাসী প্রত্যাবাসনের ঘোষণায় বাংলাদেশিদের মুসলিমদের জন্য কিছুটা হলেও প্রভাব পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি এলাকার বাংলাদেশি অভিবাসী আইনজীবী মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, বাংলাদেশি মুসলিমদের জন্য ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়া কোনো সুখবর নয়। তিনি মুসলিম বিরোধী এবং অভিবাসী বিরোধী। যারা মামলায় হেরেও বছরের পর বছর এখানে বসবাস করছেন তাদের জন্য হবে দুঃস্বপ্ন। ট্রাম্পের অভিবাসন নীতিগুলি সমস্ত অভিবাসীদের জন্য খুব কঠোর এবং কঠিন হবে। তবে ছোট ব্যবসার পাশাপাশি উচ্চ আয়ের পরিবারের জন্য ভাল হবে।
কানেকোটিকাট অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত বিশ্বখ্যাত ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী ড. গোলাম চৌধুরী ইকবাল বলেন, ট্রাম্পের পুনরায় প্রেসিডেন্ট হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। তার অভিবাসন নীতির কড়াকড়ির কারণে গ্রিন কার্ড, ভিসা প্রক্রিয়া এবং অভিবাসীদের আইনি মর্যাদায় জটিলতা বাড়তে পারে। সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় ট্রাম্প প্রশাসনের আগের ব্যর্থতার নজির রয়েছে। যা বাংলাদেশি অভিবাসীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করতে পারে।
এছাড়াও মার্কিন প্রশাসনে ভারতীয় লবির শক্তিশালী অবস্থানের কারণে বাংলাদেশি স্বার্থে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কিছু মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আচরণে ‘প্যাথলজিক্যাল নার্সিসিজম’ বা বিপজ্জনক ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্যের লক্ষণ রয়েছে। ট্রাম্পের এই ‘প্যাথলজিক্যাল নার্সিসিজম’ বৈশিষ্ট্য বিশ্ব রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে, যা অভিবাসীদের নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে উল্লেখ করেন ড. গোলাম।
বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তারিক হাসান বলেন, অভিবাসীদের অনুপস্থিতির বড় প্রভাব পড়বে মার্কিন অর্থনীতিতে। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, যদি অভিবাসীদের পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়, তাহলে ধরে নিন মাথাপিছু জিডিপি পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ কমে যাবে। অর্থাৎ কিছু মানুষ কমে যাওয়ার (অভিবাসীদের অনুপস্থিতি) যে প্রভাব, তার প্রতিফলন ঘটবে জিডিপিতে।
তার গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে তারিক হাসান বলেছেন, অভিবাসন উদ্ভাবনী শক্তিতে ইন্ধন যোগায়, উৎপাদনশীলতা বাড়ায় এবং এটা কিন্তু শুধুমাত্র কোনও একটা বিশেষ সেক্টরেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রসঙ্গত, অভিবাসীরা তুলনামূলকভাবে কম বয়সী এবং তাদের কাজ করার সম্ভাবনা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিভিল সেক্টরে কর্মরত তিন কোটি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ১৯ শতাংশই অভিবাসী।
মার্কিন সরকারি সংস্থা ‘ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিসটিক্স’- এর তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমশক্তিতে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে অভিবাসীদের হার আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি।
কংগ্রেশনাল বাজেট অফিসের অনুমান অনুযায়ী, ২০২২ থেকে ২০৩৪ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আসা ১৬ বছর বা তার বেশি বয়সী অভিবাসীদের প্রায় ৯১ শতাংশের বয়স ৫৫ বছরের কম হবে, যা যুক্তরাষ্ট্রে বয়স্কদের মোট জনসংখ্যার ৬২ শতাংশ। অর্থ ব্যবস্থা ভূমিকা পালন করে এমন সেক্টর যেমন কৃষি- সম্পূর্ণরূপে অভিবাসী শ্রমিকদের উপর নির্ভরশীল। মার্কিন শ্রম মন্ত্রণালয়ের জাতীয় কৃষি শ্রমিক জরিপ অনুযায়ী, ৭০ শতাংশ শ্রমিক অভিবাসী। যদিও এদের মধ্যে অনেক শ্রমিকের কাছে এখনও পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট নথিপত্র নেই। আমেরিকান ইমিগ্র্যান্ট কাউন্সিলের (এআইসি) গবেষণা নির্দেশকের দায়িত্বে রয়েছেন নান ব্যুরো। তিনি অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটা সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন।
তার মতে, অভিবাসীদের সরিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো কৃষিকাজ করা, ফল এবং শাক সবজি তোলা আর উৎসবের মৌসুমে ক্রমবর্ধমান বাজারের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিক পাবেন না ক্ষেতের মালিকরা।
অন্যদিকে, যারা অভিবাসনের সমালোচনা করেন, তাদের একটা যুক্তি হলো, বিদেশ থেকে আসা বিপুলসংখ্যক শ্রমিক কম মজুরিতে কাজ করতে প্রস্তুত এবং এর ফলে মার্কিন নাগরিকরাও কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন আর ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া ২০১৪ সালে অর্থনীতিতে অভিবাসনের প্রভাব নিয়ে ২৭টি গবেষণার পর্যালোচনা করেছে। এই পর্যবেক্ষণ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী নাগরিকদের বেতনের উপর অভিবাসনের গড় প্রভাব প্রায় শূন্যের সমান।
সাম্প্রতিক সময়ে ইস্টার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে একটা গবেষণা করা হয়েছে। সেই গবেষণা বলছে, অভিবাসীর সংখ্যা বাড়লে তা মজুরি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যদিও পরিসংখ্যানের দিক থেকে তা একেবারে ক্ষুদ্র।
নিউ ইয়র্কের মূলধারার রাজনীতিবিদ ব্যবসায়ী ও বিএনপি নেতা গিয়াস আহমেদ বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশি তথা মুসলিম কমিউনিটি এবারের নির্বাচনে একটি বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন। বেশির ভাগ বাংলাদেশি এবং অন্যান্য মুসলিম কমিউনিটি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে। মুসলিম কমিউনিটি ঐক্যবদ্ধ ভাবে ভোট প্রদান করে এবারে সর্বপ্রথম তাদের শক্তি প্রদর্শন করেছে যা ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী বিজয়ী ভাষণে উল্লেখ করেছেন। এই প্রথম আমেরিকার ইতিহাসে কোন প্রেসিডেন্ট মুসলিম ভোটের কথা স্বীকার করে বক্তব্য দেন। এবারে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমদের শ্লোগান ছিল ‘মুসলিম ভোট ম্যাটারস’। ইজরাইল কর্তৃক গাজায় গণহত্যার জন্য তিনি জো বাইডেন প্রশাসনকে দায়ী করেন। তাই এবার মুসলিম ভোট কমলা হ্যারিসের দিকে যায়নি।
প্রিন্ট