শিশির ঝরা ঘাসে
শীতের আগমনী,
শীতল শীতল মলয় আবেশে,
পাতা খসার ধ্বনি!
কবি সৌম্যকান্তি চক্রবর্তীর ভাষায়, “হেমন্ত এসে গেছে, শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে”। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে প্রকৃতির রূপের কখনও শেষ হয় না। ঋতুচক্রে বর্তমানে প্রকৃতিতে হেমন্তকাল চলছে। সন্ধ্যা থেকে শেষ রাতের হিমেল হাওয়া, কুয়াশার ছোয়া, ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশিরবিন্দু, চারপাশে পাতা ঝরার শব্দ, মাঠে সোনালী ধানের ঢেউ, এবং খেজুর গাছে গাছির ব্যস্ততা—এসবই জানিয়ে দেয় শীতের আগমনী বার্তা।
প্রকৃতির এই পরিবর্তন সবচেয়ে বেশি দেখা যায় উত্তরের জনপদগুলোতে, যেখানে শীত কিছুটা আগে আসে এবং কিছুটা দেরিতে চলে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় নাটোর জেলার লালপুর উপজেলায় শুরু হয়ে গেছে শীতের প্রস্তুতি। প্রমত্ত পদ্মার পাড়ে অবস্থিত লালপুরে খেজুর গাছের রস সংগ্রহের কাজ এখন তুঙ্গে।
সরেজমিনে উপজেলার কৃষ্ণরামপুর, ঢুষপাড়া, রহিমপুর, মোহরকয়া, মোমিনপুর, মহারাজপুর, বেড়িলাবাড়ি, আব্দুলপুর, সালামপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে দেখা যায়—গাছিরা খেজুর গাছ পরিষ্কার করে এবং কাঁটাযুক্ত ডাল কেটে নতুন কাঠের সাদা অংশ বের করছেন। ইতিমধ্যে কিছু গাছি রস সংগ্রহেও মেতে উঠেছেন। মৌমাছি গুনগুনিয়ে তাদের সঙ্গ দিচ্ছে।
আরবাব ইউনিয়নের কৃষ্ণরামপুর গ্রামের গাছি নজরুল ইসলাম (৪৩) জানান, “খেজুর গাছের কাঠ পরিষ্কার করে ৮-১০ দিন শুকাতে হয়। এরপর বিশেষ কৌশলে গাছের কিছু অংশ বিশেষ পদ্ধতিতে কেটে রস সংগ্রহের জন্য মাটির পাত্র বসাতে হয়। প্রতিদিন কাঠের কিছু অংশ চেঁছে রস সংগ্রহ করা হয়। কয়েকদিন রস সংগ্রহের পর একাধারে তিন দিন শুকাতে হয়। শুকনা কাঠের রস খুব মিষ্টি হয়।”
আরেক গাছি, রহিমপুর গ্রামের মিঠন আলী (৪০) বলেন, “প্রতিদিন প্রায় ৬০ থেকে ৬৫টি খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করতে পারি। শীত মৌসুমে একজন গাছি একটি গাছ থেকে ২০-২৫ কেজি গুড় সংগ্রহ করতে পারে।”
বড়বড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোফাজ্জল হোসেন বলেন, “লালপুরের অন্যতম সম্পদ হলো মধুবৃক্ষ খেজুর। শীত মৌসুমে উপজেলার বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হয় খেজুরের সুস্বাদু পাটালি গুড়। মধুবৃক্ষ খেজুরের রস, গুড় ও পাটালি উৎপাদনে লালপুর উপজেলার খ্যাতি দেশজুড়ে। এ অঞ্চলের খেজুর গুড় রাজশাহী, ঢাকা, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, খুলনা, দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হয়ে থাকে।”
তিনি আরও বলেন, “এজন্য অবহেলায় বেড়ে ওঠা খেজুর গাছের কদর এখন অনেক বেশি। কিছুদিন পর এসব গাছ থেকে রস সংগ্রহের পালা শুরু হবে, এবং এই জনপদে শুরু হয়েছে কর্মচাঞ্চল্য যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।”
উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের তথ্যমতে, শীতকালীন মৌসুমে প্রায় ২ হাজার গাছি পরিবার খেজুর রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির কাজ করে। লালপুর উপজেলায় প্রায় ২ লক্ষ ৯০ হাজার খেজুর গাছ রয়েছে। এই বছরে উপজেলায় ১৫০ কোটি টাকা মূল্যের ৭,২৫০ মেট্রিক টন খেজুরের গুড় উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রীতম কুমার হোড় বলেন, “নিরাপদ গুড় উৎপাদন এবং বাদুর থেকে খেজুর রসের মাধ্যমে সংক্রমিত নিপা ভাইরাস প্রতিরোধে গাছে রস সংগ্রহের পাত্র ঢেকে রেখে গুড় উৎপাদনে কৃষি বিভাগ নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।”
প্রিন্ট