পাবনার চাটমোহরের গভীর-অগভীর নলকূপ মালিকরা সেচ চার্জ বাবদ নির্ধারিত টাকা না নিয়ে বছরের পর বছর ধরে কোথাও চার ভাগের এক ভাগ কোথাও পাচ ভাগের এক ভাগ ধান নিয়ে ঠকিয়ে আসছেন হাজার হাজার কৃষককে। এ বিষয়ে কৃষক
বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রতিবাদ করলেও সুফল পাচ্ছেন না। এ নিয়ে কৃষকের সাথে সেচ যন্ত্রের মালিকপক্ষের প্রায়শই বাক বিতন্ডার সৃষ্টি হচ্ছে।
জানা গেছে, চাটমোহরে বিএডিসির পানাসী প্রকল্পের অধীনে ৭০ টি এবং বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কতৃপক্ষের অধীনে ৫৭ টি গভীর নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে ২৩ টি নলকূপ বিভিন্ন কারণে বন্ধ রয়েছে। চালু থাকা ১০৪ টি গভীর নলকূপসহ অন্যান্য ব্যক্তি মালিকানাধীন গভীর-অগভীর নলকূপের মালিকপক্ষ উপজেলা সমন্বয় ও সেচ কমিটির সভার সিদ্ধান্ত না মেনে, সেচ চার্জ বাবদ টাকা না নিয়ে কৃষকের নিকট থেকে চার ভাগের এক ভাগ, কোথাও পাচ ভাগের এক ভাগ হিসেবে ধান নিয়ে বছরের পর বছর হাজার হাজার কৃষককে ঠকিয়ে আসছেন।
বিএডিসির সহকারী প্রকৌশলী ফারুক আহম্মেদ জানান, বিএডিসির পানাসী প্রকল্পের অধীনে ৭০ টি গভীর নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে ৫০ টি চলমান রয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকা, ট্রান্সফরমার চুরি হয়ে যাওয়া, মালিকগন ইচ্ছা করে আবাদ না করা অথবা গভীর নলকূপ এলাকার কৃষকেরা অন্য ফসলের আবাদ করার মতো কারণে ২০ টি গভীর নলকূপ বন্ধ রয়েছে। প্রতিটি গভীর নলকূপের আওতায় ৬০ একর বা এর কিছু কম বেশি জমি রয়েছে। প্রিপেইড সিস্টেমে গভীর নলকূপ মালিকেরা প্রতি ঘন্টা চালানো বাবদ সরকারকে ১শ টাকা করে দেন।
২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী উপজেলা সমন্বয় ও সেচ কমিটির সভায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সভাপতি উপজেলা সমন্বয় ও সেচ কমিটি সৈকত ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় গভীর নলকূপের ক্ষেত্রে বিঘা প্রতি ইরি/বোরো মৌসুমে ১৯০০ টাকা, আমন মৌসুমে ১০০০ টাকা, উভয় মৌসুম একত্রে ২৯০০ টাকা, অগভীর নলকূপের ক্ষেত্রে বিঘা প্রতি প্রতি ইরি/বোরো মৌসুমে ১৯৫০ টাকা, আমন মৌসুমে ১০০০ টাকা, উভয় মৌসুম একত্রে ২৯৫০ টাকা, রবি মৌসুমে রসুন, গম, পিয়াজ ইত্যাদি আবাদে বিঘা প্রতি তিনটি সেচের ক্ষেত্রে ১০০০ টাকা এবং চারটি সেচের ক্ষেত্রে ১৩০০ টাকা সেচ চার্জ ধার্য করা হয়।
কিন্তু কাগজ কলমে এ সিদ্ধান্ত থাকলেও বাস্তবে চাটমোহরের গভীর ও অগভীর নলকূপ মালিকরা এ সিদ্ধান্ত না মেনে অধিকাংশ কৃষকদের নিকট থেকে চার ভাগের এক ভাগ ধান আদায় করে নিচ্ছেন। বিঘা প্রতি ২৪ মন ধান হলে গভীর নলকূপ মালিকরা পাচ্ছেন ৬ মন ধান যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৫ হাজার টাকা। কয়েকটি গভীর নলকূপের মালিক পক্ষ পাচ ভাগের এক ভাগ ধান নিচ্ছেন। সেসব ক্ষেত্রেও ঠকছেন কৃষক। রবি মৌসুমেও সেচ যন্ত্রের মালিকরা বেশি টাকা নিয়ে থাকেন কৃষকের এমন অভিযোগ ও রয়েছে।
অপর দিকে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সহকারী প্রকৌশলী শাহাদত হোসেন জানান, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কতৃপক্ষের অধীনে চাটমোহরের ৫৭ টি গভীর নলকূপের মধ্যে ৫৪ টি সচল রয়েছে। মালিক পক্ষ প্রিপেইড সিস্টেমে প্রতি ঘন্টায় ১১০ টাকা খরচ করে গভীর নলকূপ গুলো চালান। বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, তার চুরি হলে এর দায় মালিক পক্ষের। আর নলকূপ যন্ত্র নষ্ট হলে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কতৃপক্ষ মেরামত করে দেয়।
প্রথম ১ হাজার ঘন্টা চালানোর জন্য অপারেটকে ঘন্টা প্রতি দশ টাকা এবং উদ্বৃত্ত যত ঘন্টা চালানো প্রয়োজন হয় তার জন্য অপারেটরকে ১২ টাকা ঘন্টা হিসেবে টাকা দেয় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কতৃপক্ষ। প্রত্যেকটি গভীর নলকূপের অধীনে সাধারণত ৬০ একর জমি থাকে। পানির অপচয় রোধে ২ হাজার ফিট বা তার চেয়েও বেশি আন্ডার গ্রাউন্ড পাইপ লাইন স্থাপন করে দেয়া হয়।
উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়নের জগতলা গ্রামের কৃষক তোফাজ্জল হোসেন জানান, চলতি বছরে আমি প্রায় দশ বিঘা জমিতে ইরি-বোরা ধান আবাদ করেছি। সেচ যন্ত্রের মালিকরা চার ভাগের এক ভাগ ধান জমি থেকে কেটে নিয়েছেন। কিছু ধান কম নিতে বললেও তারা আমার কোন কথাই শোনেনি।
তোফাজ্জল হোসেনের মতো হাজার হাজার কৃষকের নিকট থেকে ধান আদায় করছেন গভীর অগভীর নলকূপ মালিক পক্ষ।
উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়নের কুবিরদিয়ার মৌজায় বিএডিসির অধীনে যৌথ ভাবে একটি গভীর নলকূপ পরিচালনা করেন সুরুজ সরকার এবং আরো কয়েকজন।
বিএডিসির সহকারী প্রকৌশলী ফারুক আহম্মেদ জানান, আমরা সব সময় সেচ চার্জ বাবদ গভীর অগভীর নলকূপ মালিকদের ধার্যকৃত টাকা নিতে বলি। ধান নেওয়ার কোন বিধান নেই। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সহকারী প্রকৌশলী শাহাদত হোসেন জানান, সেচের বিনিময়ে কৃষকের নিকট থেকে ধান নেওয়ার কোন বিধান নেই। প্রিপেইড কার্ডের মাধ্যমে কৃষকের পানি নেওয়ার কথা। কৃষকেরাও নিয়মের বাইরে চলে। সেচ যন্ত্রের মালিকপক্ষ জোর করে কৃষকের নিকট থেকে ধান আদায় করছেন এমন অভিযোগ পেলে আমরা প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করবো।
চাটমোহর উপজেলা সমন্বয় ও সেচ কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার সৈকত ইসলাম জানান, গত ২৫ ফেব্রুয়ারী উপজেলা সমন্বয় ও সেচ কমিটির সভায় সেচ চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে। কোন গভীর-অগভীর নলকূপ মালিক পক্ষ সভার সিদ্ধান্ত অমান্য করে অতিরিক্ত টাকা আদায় অথবা টাকা না নিয়ে কৃষককে ধান দিতে বাধ্য করতে পারেন না। কোন গভীর-অগভীর নলকূপ মালিক পক্ষ অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে, ধান দিতে বাধ্য করছে, কৃষকের এমন অভিযোগ পেলে এবং সে অভিযোগ সত্য হলে প্রয়োজনে নলকূপের লাইসেন্স বাতিল করা হবে।
প্রিন্ট