ফরিদপুরের ভাঙ্গায় কাজী শামসুন্নেছা পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সমালোচিত সেই প্রধান শিক্ষক অরুন চন্দ্র, তাঁর স্ত্রী সঞ্চিতা দত্ত ও ধর্মীয় শিক্ষক জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে প্রতারনা করে ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে কোর্টে মামলা করলেন ওই বিদ্যালয়ের ভোকেশনাল শাখার ট্রেড শিক্ষক সাহানা পারভীন। আজ সোমবার (১০ জুন) সকালে ভুক্তভোগী সাহানা পারভীন সাংবাদিকদের কাছে এক ভিডিও বক্তব্যে প্রধান শিক্ষক অরুন চন্দ্র দত্ত তাঁর স্ত্রীসহ তিনজনের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করেন।
এ ঘটনায় আইনগত বিচারের দাবিতে গতকাল (০৯ জুন) সাহানা পারভীন ফরিদপুর বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট ৩নং আমলী আদালতের দারস্থ হন। পরবর্তিতে বিজ্ঞ আদালত তাঁর বিষয়টি আমলে নিয়ে মামলাটি তদন্তের জন্য ভাঙ্গা থানার ওসিকে নির্দেশনা দেন। (সিআর মামলা নং- ৩৫৩/২৪, তারিখঃ ০৯/০৬/২০২৪) তবে, অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক অরুন চন্দ্র দত্তের ভাস্য- তিনি সাহানা পারভীনের কাছ থেকে কোন টাকা পয়সা নেন নি। এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন তিনি।
মামলা সুত্রে জানা যায়, ভাঙ্গা কাজী শামসুন্নেছা পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভোকেশনাল শাখার ফুড প্রসেসিং এন্ড প্রিজারভেশন ট্রেড এর একজন ট্রেড ইন্সপেক্টর (ট্রেড শিক্ষক) হিসেবে গত ০৪/০৬/১৯৯৭ ইং তারিখে অত্র বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এরপর সেখানে দীর্ঘ ১০ বছর সুনামের সহিত শিক্ষকতা করেন। কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক কারনে গত ২০/০৫/২০০৭ তারিখে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। দীর্ঘদিনপর অত্র বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি ০৯/১০/২০১৮ তারিখে তাকে পুনঃবহালের জন্য নোটিশ দেয়।
কিন্তু, সাহানা পারভীনের পুনঃবহাল ও তাঁর বেতনের সরকারী অংশ প্রাপ্তীর জন্য এবং কারিগরি অধিদপ্তরে কাগজপত্র চাইলে অত্র বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অরুন চন্দ্র দত্ত, তাঁর স্ত্রী সঞ্চিতা দত্ত এবং অত্র বিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষক প্রতিনিধি মাওলানা জাকির হোসেন মাতুব্বর একত্রে যোগসুত্রে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন এবং টাকার বিনিময়ে সাহানা পারভীনের বিগত ১২ বছরের পাওনা বেতনসহ তাকে বিদ্যালয়ে পুনঃবহালের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন প্রধান শিক্ষক অরুন চন্দ্র দত্ত, তাঁর স্ত্রী ও জাকির হোসেন।
তারপর হটাৎ প্রধান শিক্ষক অরুন চন্দ্র দত্ত হটাৎ চিকিৎসার জন্য ভারতে যাবেন জানিয়ে সহানা পারভীনকে ওই ১০ লাখ টাকা দেওয়ার জন্য একাধিকবার তাগিত দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে, গত ০৭/১০/২০১৮ তারিখে সাহানা পারভীনের মানিত স্বাক্ষীগনদের নিয়ে প্রধান শিক্ষক অরুন চন্দ্র দত্তের বাসায় গিয়ে তাঁর হাতে ১০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এসময় অরুন চন্দ্র দত্ত নিজের কাছে ৫ লাখ টাকা, তাঁর স্ত্রীর কাছে ৩ লাখ টাকা ও ধর্মীয় শিক্ষক জাকির হোসেনের কাছে ২ লাখ টাকা দেয়। কিন্তু, প্রতিশ্রুতি মোতাবেক অরুন চন্দ্র দত্ত,তাঁর স্ত্রী ও জাকির হোসেন কোন কাজ সম্পাদন না করে উল্টো কালক্ষেপন করতে থাকেন।
এরপর সাহানা পারভীন তাঁর ১০ লাখ টাকা ফেরৎ চাইলে সেই টাকা দিতে অস্বীকার করেন প্রধান শিক্ষক অরুন চন্দ্র দত্ত। এক পর্যায়ে, সেই টাকা ফেরত চাওয়ার জন্য মানিত স্বাক্ষীদের নিয়ে ০৬/০৬/২০২৪ তারিখে প্রধান শিক্ষক অরু চন্দ্র দত্তের বাড়িতে যান সাহানা পারভীন। কিন্তু, টাকা দিতে অস্বীকার করেন প্রধান শিক্ষক অরুন চন্দ্র দত্ত। পরবর্তীতে, গত ০৯ জুন ২০২৪ তরিখে ভুক্তভোগী সাহানা পারভীন বিজ্ঞ আদালতের দারস্থ হন।
সাহানা পারভীন সাংবাদিকদের জানান, এ বিষয়ে ইতোপূর্বে একাধিকবার স্কুলের সভাপতিকে জানানো হয়েছিলো। এছাড়াও জেলা শিক্ষা অফিস, দূর্ণীতি দমন কমিশন, ভাঙ্গা পৌর সভার মেয়রসহ উপজেলা শিক্ষা অফিসকে লিখিতভাবে জানিয়েছিলাম। কিন্তু, কেউই কোন কর্নপাত করেন নি। কারণ, ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক এক প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রছায়ায় থাকার সুবাদে, সেই সুযোগকেই অনৈতিকাজে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে আসছেন প্রধান শিক্ষক অরুন চন্দ্র দত্তসহ তাঁর সহযোগিরা। বর্তমানে, স্কুলটিতে বিভিন্ন অনিয়ম ও দূর্ণীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। তাই, অরাজনৈতিক ও দূর্ণীতিমুক্ত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার লক্ষ্যে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতন কতৃপক্ষের আন্তরীক হস্তক্ষেপ কামনা করেন এবং তাঁর সঙ্গে প্রতারণায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে একটি ন্যায় বিচারের দাবি জানান।
অভিযোগের বিষয়ে প্রধান শিক্ষক অরুন চন্দ্র দত্তের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তিনি সাহানা পারভীনের কাছ থেকে কোন টাকা পয়সা নেন নি। মোবাইলে এর বেশী তিনি কিছু বলতে পারছেন না। এ বিষয়ে জানতে স্কুলের সভাপতি ম্যাডামের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন অরুন চন্দ্র দত্ত। প্রধান শিক্ষক অরুন চন্দ্র দত্তের স্ত্রী ও ভাঙ্গা সরকারি কেএম কলেজের ম্যানেজমেন্টের শিক্ষক সঞ্চিতা দত্ত তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলার বিষয়ে তিনি দাবি করেন, তিনি সাহানা পারভীন নামে কাউকে চিনেন না। তাঁর বাড়িতে বসে কোন লেনদেন হয় নি, বরং তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে। কাজী শামসুন্নেছা পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ধর্মীয় শিক্ষক জাকির হোসেনের মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনিও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করেন।
এ বিষয়ে জানতে কাজী শামসুন্নেছা বালিকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানিজেং কমিটির সভাপতি কাজী জোবায়দা লতিফের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা ও খুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোন বক্তব্য পাওয়া যায় নি।
উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ জালাল উদ্দিন জানান, এ বিষয়টি তিনি ভাঙ্গা উপজেলায় যোগদানের পূর্বের বিষয়। যেহেতু বিজ্ঞ আদালতে মামলা হয়েছে, আদালত এ বিষয়ে যে রায় দিবেন সেটাই বাস্তবায়ন হবে বলে তিনি মনে করেন। ভাঙ্গা থানার ওসি মামুন আল রশিদ জানান, বিষয়টির তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, গত (২০ মে) বিকেলে প্রধান শিক্ষক অরুন চন্দ্রের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দূর্ণীতির তথ্য জানতে চাওয়ায় দুইজন সংবাদকর্মীকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল ও হেনস্থা করা হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। এ নিয়ে বিভিন্ন গনমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ ঘটনায় ওই দিন রাতেই ভাঙ্গা থানায় প্রধান শিক্ষক অরুন চন্দ্রের বিরুদ্ধে আইনগত বিচার দাবি করে ভাঙ্গা থানায় আরও একটি লিখিত অভিযোগ দেন মোঃ আক্তারুজ্জামান। এরপর দিন (২১ মে) ভাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক ও উপ-পরিচালক দূর্ণীতি দমন কমিশন ফরিদপুর বরাবর প্রধান শিক্ষক অরুন চন্দ্রের বিরুদ্ধে সেচ্ছাচারিতা, পরিচ্ছন্নকর্মী নিয়োগে অনিয়মসহ ব্যাপক দূর্ণীতি প্রসঙ্গে লিখিত অভিযোগপত্র দিয়েছেন হেনস্তার শিকার সাংবাদিক আক্তারুজ্জামান সোহেল।
এসব অভিযোগের বিষয়ে গত ৩০/০৫/২০২৪ তারিখে, সহকারী কমিশনার, নাঈমা নাদিয়া শিক্ষা ও কল্যাণ শাখা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, ফরিদপুর। তিনি ইতোমধ্যে বিভাগীয় তদন্তকার্যের জন্য জেলা শিক্ষা অফিসারকে নির্দেশনা দেন। এরপর গত ০৯ জুন সোমবার প্রধান শিক্ষক অরুন চন্দ্র দত্ত, তাঁর স্ত্রী সঞ্চিতা দত্ত ও জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে ফরিদপুর কোর্টে প্রতারনার মামলা করেন সাহানা পারভীন নামের এক নারী শিক্ষক।
প্রিন্ট