ঢাকা , মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
Logo বিশেষ বার্তা ! Logo টাঙ্গাইল নাগরপুরে ধলেশ্বরী নদীতে ড্রেজার বসিয়ে চলছে রমরমা বালুর ব্যবসা Logo খোকসায় জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত Logo সুবর্ণচরে রোদের মধ্যে খেলার সময় শিশুর মৃত্যু Logo চরভদ্রাসনে সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত Logo উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে – রাজবাড়ীতে ইসি আলমগীর Logo দৌলতপুরে প্রেমের টানে দুলাভাইয়ের হাত ধরে শ্যালকের বউ উধাও Logo মুকসুদপুরে কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ Logo কুষ্টিয়ার মিরপুরে নছিমনের ধাক্কায় ব্যবসায়ী নিহত Logo আলফাডাঙ্গাউপজেলাচেয়ারম্যান প্রার্থী শেখ তাহিদুর রহমান মুক্তর মতবিনিময় সভা
প্রতিনিধি নিয়োগ
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা পত্রিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আপনি আপনার এলাকায় সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন।

পদ্মায় পানি নেই, হেটে পার হচ্ছে মানুষ !

দেখে এখন চেনার উপায় নেই এটি ছিল এককালের প্রমত্তা পদ্মা। যে নদীতে প্রবাহিত হতো স্রোত ধারা এখন সেই নদীর বুকে শুধুই বিস্তৃত ধু-ধু বালির চর।

 

নদীর বুকে নৌকার পরিবর্তে চলছে গরু-ঘোড়া আর মহিষের গাড়ি। পদ্মার অনেক জায়গায় পায়ে হেঁটে নদী পারাপার হচ্ছে মানুষ। পানির প্রবাহ না থাকায় নদীপাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকা এখন হুমকির মুখে পড়েছে।

 

পদ্মায় পানি প্রবাহ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ায় সেচের পানিরও সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিরূপ প্রভাব পড়েছে প্রকৃতিতে। হারিয়ে গেছে অর্ধশতাধিক প্রজাতির মাছ। নৌ যোগাযোগও আর নেই। নদীর বুকে আবাদ হয় ধানসহ বিভিন্ন ফসলের।

 

পদ্মায় স্রোত না থাকায় প্রতি বছর লাখ লাখ টন পলি এসে জমছে পদ্মার বুকে। উৎস্য ও উজান থেকে পদ্মায় পর্যাপ্ত পানি না আসায় নদী ক্রমশ বালির নীচে চাপা পড়ছে। বাড়ছে বালুচরের বিস্তৃতি আর ঘনত্ব।

 

সে কালের পদ্মা নদী। যার বুকে এখন ঢেউয়ের পরিবর্তে শোভা পায় চিক চিকে বালুচর। মাইলের পর মাইল শুধু বালি আর বালি। সেই কাকডাকা ভোর থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত নানা পেশার মানুষ পদ্মার বালুচর দিয়ে হেঁটে হেঁটে পার হয়ে পাবনা ও কুষ্টিয়া শহরে যাতায়াত করে। সামান্য যেটুকু পানি আছে তার কোথাও হাঁটু আবার কোথাও কোমর পানি।

 

এক সময় পদ্মার বুকে ঢেউ দু’পাড়ে আছড়ে পড়ত। সেই পদ্মা এখন পানি শূন্য হয়ে খাঁ খাঁ কারবালা মরুভূমির মত। দেখে মনে হয় না যে, এক সময় এখানে পদ্মার ঢেউ ছিল। ছিল পানির উত্তাল তরঙ্গ আর বুক কাপানো ঢেউয়ের গর্জন।

 

গত পয়তাল্লিশ বছরে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে বালুচরের উচ্চতা বেড়েছে আঠারো মিটার। বর্ষা মওসুমে মাস তিনেকের জন্য নদীতে পানি থাকলেও বছরের নয় মাসজুড়েই তলানিতে থাকছে পানি। শীর্ণ খালের রুপ নিয়ে বয়ে যাচ্ছে এক সময়ের প্রমত্ত পদ্মা।

 

পদ্মা মরে যাবার সাথে সাথে শাখা প্রশাখা নদ নদী বড়াল, মরা বড়াল, মুছাখান, ইছামতি, ধলাই, হুড়া সাগর, চিকনাই, গড়াই, মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, নবগঙ্গা, চিত্রা, বেতা কালিকুমার, হরিহর, কালিগঙ্গা, কাজল, হিসনা, সাগরখালি, চন্দনা, কপোতাক্ষ, বেলাবতসহ পঁচিশটি নদ-নদীর অস্তিত্ব প্রায় বিলীন।

 

নদীতে পানি অস্বাভিক ভাবে কম থাকায় এ বছর চালু করা যায়নি গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্প। আর এতে দক্ষিণাঞ্চলের চার জেলার ৯৬ হাজার হেক্টর জমির চাষাবাদ হুমকির মুখে পড়েছে।

 

সরেজমিনে দেখা যায়, নদীর প্রায় অর্ধেকের বেশি এলাকা পার হয়ে কিছুটা পানির দেখা মিললেও সেখানে পণ্যবাহী নৌকা চলে না। আর এতে সবচেয়ে দুর্ভোগে আছে পদ্মাপাড়ের জেলেরা।

 

পদ্মাপাড়ের জেলে সাদেক আলী বলেন, জীবনে এত কম পানি এর আগে দেখিনি। গত দুই মাসে দিনে দুই কেজির বেশি মাছ ধরতে পারিনি। অন্য কাজে দক্ষতা না থাকায় অনেক কষ্ট করে চলতে হচ্ছে শতাধিক জেলে পরিবারকে।

 

জিকে প্রকল্পের পরিচালক আব্দুল হামিদ বলেন, সেচ পাম্প চালাতে কমপক্ষে সাড়ে চার মিটার উচ্চতার পানির প্রয়োজন হয়। অথচ এ বছর মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পানির উচ্চতা ছিল চার দশমিক শূন্য সাত মিটার। এছাড়া প্রকল্পের তিনটি প্রধান সেচ পাম্পের দু’টি দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট হয়ে আছে।

 

পানি পরিমাপক দফতর হাইড্রলজি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জানুয়ারির প্রথম দিন থেকেই প্রতি দফাতেই কমপক্ষে ১০ থেকে ২০ হাজার কিউসেক কম পানি পাওয়া যাচ্ছে।

 

যৌথ নদী কমিশন, বাংলাদেশের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য মতে, এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত প্রতি দফায় (প্রতি দশ দিন অন্তর) পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির প্রবাহ ছিল যথাক্রমে ৬৩ হাজার ১১৩ কিউসেক, ৪৮ হাজার ৫১৮ কিউসেক, ৪৮ হাজার ৩৫৯ কিউসেক, ৪৩ হাজার ৯২৬, ৩৪ হাজার ৬৯৭, ৩৫ হাজার ৭৫১ কিউসেক ও ৩৬ হাজার ৮১৮ কিউসেক।

গত বছর একই সময়ে পানির প্রবাহ ছিল যথাক্রমে ৮৫ হাজার ৩১৬ কিউসেক, ৭০ হাজার ৮২৭, ৬৯ হাজার ৯৯০, ৬৭ হাজার ৩৬৪, ৫৯ হাজার ৩৭৬, ৪৭ হাজার ৮৯১ কিউসেক ও ৪২ হাজার ৩৭২ কিউসেক।

 

চুক্তি অনুযায়ী ফারাক্কা পয়েন্টে প্রথম ১০ দিন ৭০ হাজার কিউসেক বা কম পানি থাকলে দুই দেশ ৫০ শতাংশ করে পানির হিস্যা পাবে। দ্বিতীয় ১০ দিন ৭০ থেক ৭৫ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহ থাকলে বাংলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক পাবে এবং অবশিষ্ট পানি ভারত পাবে। চুক্তিতে আরো বলা হয়েছে, ১১ মার্চ থেকে ১০ মে পর্যন্ত প্রতি মাসে ১০ দিনের একটি চক্র বাদ দিয়ে গ্যারান্টিযুক্তভাবে বাংলাদেশ ও ভারত ৩৫ হাজার কিউসেক করে পানি পাবে।

 

শুষ্ক মৌসুমে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিতে প্রতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গা ও বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পদ্মার পানি প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে দুই দেশ।

 

পাবনা হাইড্রলজি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, এ বছর শুরু থেকেই পদ্মার উজানে ফারাক্কায় পানির প্রবাহ কম থাকায় চুক্তি অনুযায়ী পানি পেলেও পরিমাণগত দিক থেকে পানি অনেক কম পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে পানি চুক্তি নিয়ে চিন্তাভাবনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

 

শুকনো মওসুম শুরুর আগেই শুকিয়ে গেছে পদ্মা। গত বর্ষায় পদ্মায় বান ডাকেনি। বলা যায় মরে গেছে পদ্মা। ফারাক্কার গেট গলিয়ে আসেনি পানি। প্রায় প্রতিবছর ভারতের মালদা ও বিহারের বন্যা ঠেকাতে ফারাক্কার সবকটি গেট খুলে দেয়া হয়। হু হু করে আসে পানি। ক্ষনিকের জন্য পদ্মা ও তার শাখা নদীগুলো প্রান পায়। এবারের চিত্র ভিন্ন। বৃষ্টিপাতের পরিমাণও ছিল কম। ফলে পানি কমেছে। বেড়েছে চরের বিস্তৃতি। খাল সদৃশ্য রূপ নিয়ে ধীরলয়ে বয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের লাইফ লাইনটি। কোথাও হাঁটু পানি আবার কোথাও খানিকটা পানির বিস্তৃতি দৃশ্যমান।

 

শুকনো মওসুম শুরুর সাথে সাথেই তাপমাত্রাও বাড়ছে। এখনই তাপমাত্রা প্রায় চল্লিশ ডিগ্রী ছুঁই ছুঁই। পদ্মার বুকজুড়ে বিশাল বালিচর যেন তপ্ত বালির কড়াই। বইছে লু হাওয়া। আবহাওয়া বৈরী হয়ে উঠছে। এবার পদ্মা ও শাখা নদীগুলো না ভরায় পানির স্তর রিচার্জ হয়নি। ফলে পঞ্চাশ ষাট ফুট নেমে গেছে পানির স্তর। কৃষি ও জীবন জীবীকার প্রয়োজনে পাতাল থেকে পানি উঠানো চলছেই। বরেন্দ্র অঞ্চলজৃুড়েই শুরু হয়েছে পানির হাহাকার। অনেক স্থানেই গভীরনলকুপেও পানি উঠছে না।

 

মরন বাঁধ ফারাক্কার কারনে গত পঞ্চাশ বছরে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে বালুচরের উচ্চতা বেড়েছে আঠারো মিটার। বর্ষা মওসুমে মাস তিনেকের জন্য নদীতে পানি থাকলেও বছরের নয় মাসজুড়েই তলানিতে থাকছে পানি। শীর্ণ খালের রূপ নিয়ে বয়ে যাচ্ছে এক সময়ের প্রমত্ত পদ্মা। পদ্মা মরে যাবার সাথে সাথে শাখা প্রশাখা নদ নদী বড়াল, মরা বড়াল, মুছাখান, ইছামতি, ধলাই, হুড়া সাগর, চিকনাই, গড়াই, মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, নবগঙ্গা, চিত্রা, বেতা কালিকুমার, হরিহর, কালিগঙ্গা, কাজল, হিসনা, সাগরখালি, চন্দনা, কপোতাক্ষ, বেলাবতসহ পঁচিশটি নদ-নদীর অস্তিত্ব প্রায় বিলীন।

 

ঈশ্বরদীর হার্ডিঞ্জ পয়েন্ট পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় ব্রীজের পনেরটি পিলারের মধ্যে সাতটির নীচ দিয়ে পানির প্রবাহ রয়েছে। ভেড়ামারা পয়েন্টের পাঁচটি পিলারে দ্রুত পানি কমছে।

 

হার্ডিঞ্জ ব্রীজ ও লালনশাহ ব্রীজের নীচে ফসলের ক্ষেত আর ড্রেজার দিয়ে বালি তোলার বিশাল কর্মকান্ড। ব্রীজের নীচে বসেছে বিভিন্ন রকমের মিনি ফাষ্টফুড আর চা সিঙ্গাড়ার হোটেল। এদের একজন রানা সরদার বলেন, শীত মৌসুমে অনেকেই নদীর জেগে ওঠা চরে বেড়াতে আসে। নদীর একেবারে তীরের চা বিক্রেতা রতন বলেন, সেই বর্ষার সময় কদিনের জন্য পানি উঠেছিল। আর এখন ত্রিশফুট নীচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর কিনারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি ছোট পরিমাপক বসানো রয়েছে। সেখানে প্রতিদিন পানির মাপ নেয়া হয়। পানি কমার দিকে রয়েছে।

 

 

গঙ্গার পানি নিয়ে ত্রিশ বছর মেয়াদী গ্যারান্টিক্লজহীন চুক্তি করলেও বাংলাদেশ কখনোই তার পানির নায্য হিস্যা পায়নি। চুক্তির নামে হয়েছে শুভংকরের ফাঁকি। পদ্মা অববাহিকার কোটি কোটি মানুষ তাদের ইচ্ছের পুতুলে পরিণত হয়েছে। শুকনো মৌসুমে পানি না দিয়ে শুকিয়ে মারা। আর বর্ষার সময় ওপারের বন্যার চাপ সামলাতে ফারাক্কার সব গেট খুলে দিয়ে এপারে ডুবিয়ে মারার খেলা চালিয়ে যাচ্ছে।

Tag :
এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

বিশেষ বার্তা !

error: Content is protected !!

পদ্মায় পানি নেই, হেটে পার হচ্ছে মানুষ !

আপডেট টাইম : ০৮:৫৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ এপ্রিল ২০২৪

দেখে এখন চেনার উপায় নেই এটি ছিল এককালের প্রমত্তা পদ্মা। যে নদীতে প্রবাহিত হতো স্রোত ধারা এখন সেই নদীর বুকে শুধুই বিস্তৃত ধু-ধু বালির চর।

 

নদীর বুকে নৌকার পরিবর্তে চলছে গরু-ঘোড়া আর মহিষের গাড়ি। পদ্মার অনেক জায়গায় পায়ে হেঁটে নদী পারাপার হচ্ছে মানুষ। পানির প্রবাহ না থাকায় নদীপাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকা এখন হুমকির মুখে পড়েছে।

 

পদ্মায় পানি প্রবাহ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ায় সেচের পানিরও সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিরূপ প্রভাব পড়েছে প্রকৃতিতে। হারিয়ে গেছে অর্ধশতাধিক প্রজাতির মাছ। নৌ যোগাযোগও আর নেই। নদীর বুকে আবাদ হয় ধানসহ বিভিন্ন ফসলের।

 

পদ্মায় স্রোত না থাকায় প্রতি বছর লাখ লাখ টন পলি এসে জমছে পদ্মার বুকে। উৎস্য ও উজান থেকে পদ্মায় পর্যাপ্ত পানি না আসায় নদী ক্রমশ বালির নীচে চাপা পড়ছে। বাড়ছে বালুচরের বিস্তৃতি আর ঘনত্ব।

 

সে কালের পদ্মা নদী। যার বুকে এখন ঢেউয়ের পরিবর্তে শোভা পায় চিক চিকে বালুচর। মাইলের পর মাইল শুধু বালি আর বালি। সেই কাকডাকা ভোর থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত নানা পেশার মানুষ পদ্মার বালুচর দিয়ে হেঁটে হেঁটে পার হয়ে পাবনা ও কুষ্টিয়া শহরে যাতায়াত করে। সামান্য যেটুকু পানি আছে তার কোথাও হাঁটু আবার কোথাও কোমর পানি।

 

এক সময় পদ্মার বুকে ঢেউ দু’পাড়ে আছড়ে পড়ত। সেই পদ্মা এখন পানি শূন্য হয়ে খাঁ খাঁ কারবালা মরুভূমির মত। দেখে মনে হয় না যে, এক সময় এখানে পদ্মার ঢেউ ছিল। ছিল পানির উত্তাল তরঙ্গ আর বুক কাপানো ঢেউয়ের গর্জন।

 

গত পয়তাল্লিশ বছরে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে বালুচরের উচ্চতা বেড়েছে আঠারো মিটার। বর্ষা মওসুমে মাস তিনেকের জন্য নদীতে পানি থাকলেও বছরের নয় মাসজুড়েই তলানিতে থাকছে পানি। শীর্ণ খালের রুপ নিয়ে বয়ে যাচ্ছে এক সময়ের প্রমত্ত পদ্মা।

 

পদ্মা মরে যাবার সাথে সাথে শাখা প্রশাখা নদ নদী বড়াল, মরা বড়াল, মুছাখান, ইছামতি, ধলাই, হুড়া সাগর, চিকনাই, গড়াই, মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, নবগঙ্গা, চিত্রা, বেতা কালিকুমার, হরিহর, কালিগঙ্গা, কাজল, হিসনা, সাগরখালি, চন্দনা, কপোতাক্ষ, বেলাবতসহ পঁচিশটি নদ-নদীর অস্তিত্ব প্রায় বিলীন।

 

নদীতে পানি অস্বাভিক ভাবে কম থাকায় এ বছর চালু করা যায়নি গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্প। আর এতে দক্ষিণাঞ্চলের চার জেলার ৯৬ হাজার হেক্টর জমির চাষাবাদ হুমকির মুখে পড়েছে।

 

সরেজমিনে দেখা যায়, নদীর প্রায় অর্ধেকের বেশি এলাকা পার হয়ে কিছুটা পানির দেখা মিললেও সেখানে পণ্যবাহী নৌকা চলে না। আর এতে সবচেয়ে দুর্ভোগে আছে পদ্মাপাড়ের জেলেরা।

 

পদ্মাপাড়ের জেলে সাদেক আলী বলেন, জীবনে এত কম পানি এর আগে দেখিনি। গত দুই মাসে দিনে দুই কেজির বেশি মাছ ধরতে পারিনি। অন্য কাজে দক্ষতা না থাকায় অনেক কষ্ট করে চলতে হচ্ছে শতাধিক জেলে পরিবারকে।

 

জিকে প্রকল্পের পরিচালক আব্দুল হামিদ বলেন, সেচ পাম্প চালাতে কমপক্ষে সাড়ে চার মিটার উচ্চতার পানির প্রয়োজন হয়। অথচ এ বছর মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পানির উচ্চতা ছিল চার দশমিক শূন্য সাত মিটার। এছাড়া প্রকল্পের তিনটি প্রধান সেচ পাম্পের দু’টি দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট হয়ে আছে।

 

পানি পরিমাপক দফতর হাইড্রলজি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জানুয়ারির প্রথম দিন থেকেই প্রতি দফাতেই কমপক্ষে ১০ থেকে ২০ হাজার কিউসেক কম পানি পাওয়া যাচ্ছে।

 

যৌথ নদী কমিশন, বাংলাদেশের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য মতে, এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত প্রতি দফায় (প্রতি দশ দিন অন্তর) পদ্মা নদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির প্রবাহ ছিল যথাক্রমে ৬৩ হাজার ১১৩ কিউসেক, ৪৮ হাজার ৫১৮ কিউসেক, ৪৮ হাজার ৩৫৯ কিউসেক, ৪৩ হাজার ৯২৬, ৩৪ হাজার ৬৯৭, ৩৫ হাজার ৭৫১ কিউসেক ও ৩৬ হাজার ৮১৮ কিউসেক।

গত বছর একই সময়ে পানির প্রবাহ ছিল যথাক্রমে ৮৫ হাজার ৩১৬ কিউসেক, ৭০ হাজার ৮২৭, ৬৯ হাজার ৯৯০, ৬৭ হাজার ৩৬৪, ৫৯ হাজার ৩৭৬, ৪৭ হাজার ৮৯১ কিউসেক ও ৪২ হাজার ৩৭২ কিউসেক।

 

চুক্তি অনুযায়ী ফারাক্কা পয়েন্টে প্রথম ১০ দিন ৭০ হাজার কিউসেক বা কম পানি থাকলে দুই দেশ ৫০ শতাংশ করে পানির হিস্যা পাবে। দ্বিতীয় ১০ দিন ৭০ থেক ৭৫ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহ থাকলে বাংলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক পাবে এবং অবশিষ্ট পানি ভারত পাবে। চুক্তিতে আরো বলা হয়েছে, ১১ মার্চ থেকে ১০ মে পর্যন্ত প্রতি মাসে ১০ দিনের একটি চক্র বাদ দিয়ে গ্যারান্টিযুক্তভাবে বাংলাদেশ ও ভারত ৩৫ হাজার কিউসেক করে পানি পাবে।

 

শুষ্ক মৌসুমে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিতে প্রতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গা ও বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পদ্মার পানি প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে দুই দেশ।

 

পাবনা হাইড্রলজি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, এ বছর শুরু থেকেই পদ্মার উজানে ফারাক্কায় পানির প্রবাহ কম থাকায় চুক্তি অনুযায়ী পানি পেলেও পরিমাণগত দিক থেকে পানি অনেক কম পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে পানি চুক্তি নিয়ে চিন্তাভাবনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

 

শুকনো মওসুম শুরুর আগেই শুকিয়ে গেছে পদ্মা। গত বর্ষায় পদ্মায় বান ডাকেনি। বলা যায় মরে গেছে পদ্মা। ফারাক্কার গেট গলিয়ে আসেনি পানি। প্রায় প্রতিবছর ভারতের মালদা ও বিহারের বন্যা ঠেকাতে ফারাক্কার সবকটি গেট খুলে দেয়া হয়। হু হু করে আসে পানি। ক্ষনিকের জন্য পদ্মা ও তার শাখা নদীগুলো প্রান পায়। এবারের চিত্র ভিন্ন। বৃষ্টিপাতের পরিমাণও ছিল কম। ফলে পানি কমেছে। বেড়েছে চরের বিস্তৃতি। খাল সদৃশ্য রূপ নিয়ে ধীরলয়ে বয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের লাইফ লাইনটি। কোথাও হাঁটু পানি আবার কোথাও খানিকটা পানির বিস্তৃতি দৃশ্যমান।

 

শুকনো মওসুম শুরুর সাথে সাথেই তাপমাত্রাও বাড়ছে। এখনই তাপমাত্রা প্রায় চল্লিশ ডিগ্রী ছুঁই ছুঁই। পদ্মার বুকজুড়ে বিশাল বালিচর যেন তপ্ত বালির কড়াই। বইছে লু হাওয়া। আবহাওয়া বৈরী হয়ে উঠছে। এবার পদ্মা ও শাখা নদীগুলো না ভরায় পানির স্তর রিচার্জ হয়নি। ফলে পঞ্চাশ ষাট ফুট নেমে গেছে পানির স্তর। কৃষি ও জীবন জীবীকার প্রয়োজনে পাতাল থেকে পানি উঠানো চলছেই। বরেন্দ্র অঞ্চলজৃুড়েই শুরু হয়েছে পানির হাহাকার। অনেক স্থানেই গভীরনলকুপেও পানি উঠছে না।

 

মরন বাঁধ ফারাক্কার কারনে গত পঞ্চাশ বছরে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে বালুচরের উচ্চতা বেড়েছে আঠারো মিটার। বর্ষা মওসুমে মাস তিনেকের জন্য নদীতে পানি থাকলেও বছরের নয় মাসজুড়েই তলানিতে থাকছে পানি। শীর্ণ খালের রূপ নিয়ে বয়ে যাচ্ছে এক সময়ের প্রমত্ত পদ্মা। পদ্মা মরে যাবার সাথে সাথে শাখা প্রশাখা নদ নদী বড়াল, মরা বড়াল, মুছাখান, ইছামতি, ধলাই, হুড়া সাগর, চিকনাই, গড়াই, মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, নবগঙ্গা, চিত্রা, বেতা কালিকুমার, হরিহর, কালিগঙ্গা, কাজল, হিসনা, সাগরখালি, চন্দনা, কপোতাক্ষ, বেলাবতসহ পঁচিশটি নদ-নদীর অস্তিত্ব প্রায় বিলীন।

 

ঈশ্বরদীর হার্ডিঞ্জ পয়েন্ট পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় ব্রীজের পনেরটি পিলারের মধ্যে সাতটির নীচ দিয়ে পানির প্রবাহ রয়েছে। ভেড়ামারা পয়েন্টের পাঁচটি পিলারে দ্রুত পানি কমছে।

 

হার্ডিঞ্জ ব্রীজ ও লালনশাহ ব্রীজের নীচে ফসলের ক্ষেত আর ড্রেজার দিয়ে বালি তোলার বিশাল কর্মকান্ড। ব্রীজের নীচে বসেছে বিভিন্ন রকমের মিনি ফাষ্টফুড আর চা সিঙ্গাড়ার হোটেল। এদের একজন রানা সরদার বলেন, শীত মৌসুমে অনেকেই নদীর জেগে ওঠা চরে বেড়াতে আসে। নদীর একেবারে তীরের চা বিক্রেতা রতন বলেন, সেই বর্ষার সময় কদিনের জন্য পানি উঠেছিল। আর এখন ত্রিশফুট নীচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর কিনারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি ছোট পরিমাপক বসানো রয়েছে। সেখানে প্রতিদিন পানির মাপ নেয়া হয়। পানি কমার দিকে রয়েছে।

 

 

গঙ্গার পানি নিয়ে ত্রিশ বছর মেয়াদী গ্যারান্টিক্লজহীন চুক্তি করলেও বাংলাদেশ কখনোই তার পানির নায্য হিস্যা পায়নি। চুক্তির নামে হয়েছে শুভংকরের ফাঁকি। পদ্মা অববাহিকার কোটি কোটি মানুষ তাদের ইচ্ছের পুতুলে পরিণত হয়েছে। শুকনো মৌসুমে পানি না দিয়ে শুকিয়ে মারা। আর বর্ষার সময় ওপারের বন্যার চাপ সামলাতে ফারাক্কার সব গেট খুলে দিয়ে এপারে ডুবিয়ে মারার খেলা চালিয়ে যাচ্ছে।