ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে মেয়েকে আনতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের গুলিতে সগিরা মোর্শেদ সালাম খুন হওয়ার ঘটনাটি ছিল বেশ আলোচিত। ৩৫ বছর আগের ঘটনাটি পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে এই হত্যাকান্ডে অভিযুক্ত দুজনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছে আদালত। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা খুনের পরিকল্পনাকারীসহ তিনজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
গতকাল বুধবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩-এর বিচারক মোহাম্মদ আলী হোসাইন এ রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড আসামি আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান ও মারুফ রেজাকে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ড অনাদায়ে আরও ৬ মাস কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। তবে নিহত সগিরা মোর্শেদের ভাশুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদ ওরফে শাহীনসহ মন্টু মন্ডল নামে একজনকে খালাস দিয়েছে আদালত।
গত ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায়ের জন্য তারিখ ৮ ফেব্রুয়ারি ধার্য করেছিল আদালত। তবে ওই দিন রায় প্রস্তুত না হওয়ায় ২০ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করা হয়। তবে ২০ ফেব্রুয়ারি ধার্য তারিখে রায়ের তারিখ পিছিয়ে ১৩ মার্চ ধার্য করে আদালত।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই সগিরা মোর্শেদ সালাম রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় বেইলি রোডের ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে সারাহাত সালমাকে আনতে যান। স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছালে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন তিনি। আত্মরক্ষায় একপর্যায়ে সগিরা মোর্শেদ দৌড় দিলে তাকে গুলি করা হয়। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পথে সগিরা মোর্শেদ মারা যান। ঘটনার দিনই রমনা থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন নিহত নারীর স্বামী সালাম চৌধুরী।
হত্যাকান্ডে প্রত্যক্ষদর্শী এক রিকশাচালক ঘটনায় দুজনের জড়িত থাকার কথা বললেও মিন্টু ওরফে মন্টু নামের একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি মন্টুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়। সাতজনের সাক্ষ্য গ্রহণের পর সাক্ষীদের বক্তব্যে আসামি মন্টু ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদুল হাসানের নিকটাত্মীয় মারুফ রেজার নাম আসে।
রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালের ২৩ মে বিচারিক আদালত এ মামলায় অধিকতর তদন্তের আদেশ দেয়। এই আদেশের বিরুদ্ধে মারুফ রেজা হাইকোর্টে আবেদন করলে ১৯৯১ সালের ২ জুলাই হাইকোর্ট রুল দিয়ে অধিকতর তদন্তের আদেশ স্থগিত করে। পরে স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানো হলে মামলার কার্যক্রম থমকে যায়। দীর্ঘদিন স্থগিতাদেশ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয় রাষ্ট্রপক্ষ। ২০১৯ সালের ২৬ জুন হাইকোর্ট মামলার অধিকতর তদন্তের আদেশের ওপর দেওয়া স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে। একই সঙ্গে ৬০ দিনের মধ্যে ওই মামলার অধিকতর তদন্ত শেষ করতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দেয়।
তদন্ত শেষে পিবিআই চারজনের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। পিবিআই তখন জানায়, মূলত পারিবারিক দ্বন্দ্ব থেকে হত্যার পরিকল্পনা করেন আসামিরা। পরিকল্পনামাফিক তা বাস্তবায়নের জন্য সন্ত্রাসীদের ভাড়া করা হয়। স্ত্রীর দ্বারা প্ররোচিত হয়ে ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে শায়েস্তা করতে ২৫ হাজার টাকায় বেইলি রোড এলাকার সন্ত্রাসী মারুফ রেজাকে ভাড়া করেছিলেন ডা. হাসান। মারুফকে সহযোগিতার জন্য স্ত্রীর ভাই রেজওয়ানকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তিনি। একই বছরের ২ ডিসেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু করে আদালত। ১৭ জনের সাক্ষ্য শেষে গতকাল এ রায় হলো।
আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল ও ফারুক আহাম্মদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান।
সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলায় রায়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন বলে জানিয়েছে তার পরিবার। মামলার বাদী সগিরা মোর্শেদের স্বামী আব্দুস সালাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুজনের রায়ে সন্তুষ্ট আর দুজনের রায়ে সন্তুষ্ট নই। আমরা আপিল করব।’ সগিরার মেয়ে সামিয়া সাবা চৌধুরী তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘পরিকল্পনাকারী কীভাবে খালাস পায়? আমরা রায়ে সন্তুষ্ট না। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।’
আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিচারকালে সাক্ষ্য গ্রহণে পারিবারিক বিরোধের বিষয়টি উঠে আসেনি। মামলার বাদী সগিরার স্বামীও বিরোধের বিষয়টি বলেননি। রাষ্ট্রপক্ষ এসব বিষয় জোরালোভাবে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে।’