কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রায়টা পাথরঘাটা থেকে কুচিয়ামোড়া গ্রাম পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে শুধুই ধ্বংসস্তূপ। কোথাও ছাই বা কোথাও পোড়া পানগাছ কঙ্কাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পুরো এলাকার বাতাসে এখনো পোড়াগন্ধ। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় শুনসান নিরবতার মাঝে শোনা যাচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তদের আহাজারি। চোখের সামনে সবকিছু হারিয়ে বাকরুদ্ধ অনেক পরিবার। কেউবা যতটুকু বরজ বাঁচাতে পেরেছে তা থেকে একটু একটু করে বেছে তুলছেন যদি বিক্রি করা যায় এই আশায়।
সোমবার বিকেলে কুচিয়ামোড়া মাঠে গিয়ে দেখা যায়, পঞ্চাশোর্ধ এক নারী পানের বরজের সামনে আহাজারি করছেন। জানতে চাইলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার স্বামী আব্দুল রহিম আলী আট বিঘা জমিতে পানের বরজ করেছিলেন। সামনে ঈদ, কত চিন্তা-ভাবনা করে রেখেছিল আগুনে সবশেষ করে দিলো। এখন এখান থেকে খড়ি (জ্বালানি) টুকুও হবে না।
তার পাশেই কান্নায় ভেঙে পড়েন জরিনা বেগম নামের আরেক নারী। তার স্বামী বিশেষ কাজে রাজশাহী গেছেন। আগুনের খবর বিভিন্ন মাধ্যমে শুনে বার বার ফোন দিচ্ছেন, জানতে চাইছেন তার বরজের কি অবস্থা? স্ত্রী জরিনা বারবারই তাকে মিথ্যা বলছেন, যে তাদের বরজ ঠিক আছে।
পান বরজের খুঁটি ধরে বিলাপ করে জরিনা বলছেন, ‘তোমাক আমি কি জবাব দেবো। সমিতির কিস্তি কীভাবে শোধ হবি? ওরে আল্লাহ আমাদের সবকিছুই নি নিলি ক্যা?’ তার কান্নায় আকাশ বাতাশ ভারী হয়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, গত রোববার বেলা ১১টার দিকে রাইটা পাথর ঘাটা এলাকার একটি পানের বরজে হঠাৎ করেই আগুন দেখতে পান স্থানীয়রা। দ্রুত সময়ের মধ্যে আগুন বিস্তার লাভ করতে থাকে। স্থানীয় নারী-পুরুষ যে যার মতো করে চেষ্টা করে আগুন নেভাতে ব্যর্থ হন। খবর দেওয়া হয় ভেড়ামারা ফায়ার সার্ভিসকে।
ততক্ষণে আগুন তাদেরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। একে একে আগুন নেভাতে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর এবং পাবনা থেকে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট এসে কাজ শুরু করে। সঙ্গে যোগ দেন স্থানীয় কয়েকশ নারী-পুরুষ। বেলা ১১টা থেকে লাগা আগুন প্রায় ৬ ঘণ্টার চেষ্টার পর নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু ততক্ষণে কয়েক হাজার কৃষকের স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
চুয়াডাঙ্গা অঞ্চল ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক রফিকুজ্জামানের নেতৃত্বে কুচিয়ামোরা এলাকার আগুন নেভানোর কাজ করে একদল ফায়ার ফাইটার। জানতে চাইলে রফিকুজ্জামান বলেন, যেভাবে আগুন ছড়িয়ে পরছিল পর্যাপ্ত পানির অভাবে আমরা আগুনের সঙ্গে পেরে উঠছিলাম না। তবে এলাকারবাসীর সহযোগিতায় অমাদের চেষ্টা অবশেষে সফলতা পেয়েছে। আগুনের উৎপত্তির কারণ খুঁজে না পাওয়া গেলেও ধারণা করা হচ্ছে- বিড়ির আগুন থেকে এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে। তবে বিষয়টি আমরা গভীরভাবে খুঁজে দেখার চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে আমাদের একটি টিম, পুলিশ প্রশাসন কাজ করছে।
এদিকে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা নিরুপণের জন্য কাজ করছে জেলা প্রশাসন। ঘটনার তদন্তে ভেড়ামারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে উপজেলা প্রশাসন।
স্থানীয় সংসদ সদস্যের বরাত দিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আকাশ কুমার কুন্ড বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুতের পর তাদের ক্ষতিপুরণের জন্য ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, তাতে প্রায় চার হাজার কৃষক প্রত্যক্ষ এবং পরক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে, মোট ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণ করতে আরো সময় লাগবে।
আর যেসব পরিবার অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের মাঝে শুকনা খাবার এবং চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক এহেতেসাম রেজা।
উল্লেখ্য, রোবার বেলা ১১টার দিকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার বাহাদুর পুর ইউনিয়নের রাইটা পাথর ঘাটা এলাকার একটি পানের বরজ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। দেখতে দেখতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে এক বরজ থেকে আরেক বরজে। এ সময় বাতাসের তীব্রতা থাকায় দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। এতে কয়েক হাজার পানের বরজ, কলাবাগান এবং ফসলের ক্ষেত পুড়ে যায়।
প্রিন্ট