ব্রিটিশ শাসন আমলে ভারতবর্ষে রেলপথ নির্মাণের সময় পদ্মা নদীর পাকশী-ভেড়ামারার সংযোগ সৃষ্টির জন্য নির্মাণ করা হয় ঐতিহাসিক হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।
১৯১৫ সালের ৪ মার্চ ঐতিহাসিক হার্ডিঞ্জ সেতু উদ্বোধনকালে সেতু প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী স্যার রবার্ট উইলিয়াম গেলস্ আবেগভরে বলেছিলেন, যে সেতু নির্মাণ করে গেলাম উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে এ সেতু চিরযৌবনা হয়ে থাকবে। কথাটি যে কতখানি সত্য, তার প্রমাণ ১০৯ বছর আগে পদ্মা নদীর বুকে তৈরি করা এই ব্রিজটি শতবর্ষ পেরিয়ে ১১০ বছরে পদার্পণ করলেও সেতুর গায়ে বার্ধক্যের কোনো ছাপ পড়েনি। অনেক শাসক-শোষক ও প্রজন্মের সাক্ষী হয়ে শতবর্ষ পেরিয়ে আজও বীরদর্পে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।
মেয়াদোত্তীর্ণ এই ব্রিজটি ১১০ বছরে পদার্পণ করলো। দিব্বি ব্রিজটি দাঁড়িয়ে আছে।সবকিচ্ছুই ঠিক ঠাক থাকায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর দিয়ে চলছে নিয়মিত ট্রেন।
১০৯ বছর আগে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা নদীর বুকে তৈরি করা হয়েছিল এই ব্রিজটি। তখন পদ্মার ছিল ভরা যৌবন। পদ্মার যৌবন এখন শেষ হতে চলেছে। কিন্তু চিরযৌবনা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পদ্মার বুকে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের অন্যতম সেতুবন্ধ তৈরি করেছে ঐতিহাসিক এই ব্রিজটি। পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলাকে সংযুক্তকারী এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ একসময়ে ছিল বাংলাদেশের দীর্ঘতম রেলসেতু।
গত ৪ মার্চ ২০২৪ সালে এর বয়স ১০৯ বছর পূর্ণ হয়েছে। এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রেলসেতু। এখনও এই ব্রিজটি দেখতে দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক মানুষ প্রতিদিনই পাকশী-ভেড়ামারায় ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ একনজর দেখার জন্য আসছেন বেড়াতে।
ঐতিহাসিক হার্ডিঞ্জ ব্রিজ স্থাপনের ইতিহাস রয়েছে। ১৮৮৯ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কলকাতার সঙ্গে আসাম, ত্রিপুরাসহ উত্তরাঞ্চলের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এই ব্রিজ তৈরির প্রস্তাব করেছিল। সে সময়ে প্রস্তাবটি কার্যকরী না হলেও কয়েক দশক পর ১৯০৯ সাল থেকে ব্রিজ নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। ব্রিজ নির্মাণের সময় ছিল ১৯০৯ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত।
পাকশী রেলওয়ে ব্রিজের বিভাগী অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ২৪ হাজার ৪০০ শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমে নির্মিত হয় ব্রিজটি। তৎকালীন হিসাব অনুযায়ী নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৩ কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার ১৬৪ রুপি। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের নাম অনুসারে ব্রিজটির নামকরণ করা হয়েছিল হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। ব্রিজের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৭৯৮.৩২ মিটার বা ৫ হাজার ৮৯৪ ফুট বা ১.৮ কিলোমিটার। এর ওপরে রয়েছে দুটি ব্রডগেজ রেললাইন। ব্রিজটির নকশা করেছিলেন আলেকজান্ডার মেয়াডোস রেন্ডেল। ব্রিজে স্প্যান রয়েছে মোট ১৫টি, প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১২০ মিটার। ঐতিহ্যবাহী এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজটি ১৯১৫ সালের আজকের এই ৪ মার্চে চালু হয়েছিল ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি বাহিনী ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্যাংক, যুদ্ধসরঞ্জামসহ সৈন্যও পারাপার করত। ১৩ ডিসেম্বর পাকবাহিনীকে কোণঠাসা করার লক্ষ্যে মিত্রবাহিনী বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করলে ১২ নম্বর স্প্যানটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বাধীনতার পর যথারীতি ভারত সরকার ব্রিজটিকে মেরামত করে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনে। এরপর ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর থেকে পুনরায় ব্রিজটির ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হয়।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর দিয়ে ‘মৈত্রী এক্সপ্রেস’সহ বিভিন্ন ট্রেন ৪০ বছর ধরে চালাচ্ছেন এল এম (ড্রাইভার) তৌহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, আগে ৬০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানো হলেও এখন ৪০ কিলোমিটার গতিতে চালানোর নির্দেশনা রয়েছে। তবে আগের মতোই চলছি, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় অস্বাভাবিক কিছু অনুভূত হয় না।
গত ২০১৫ সালে ঐতিহ্যবাহী এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজের শতবর্ষ পূরণ হয়। পাকশী বিভাগীয় প্রকৌশলী (২) বীরবল মন্ডল জানান, ২০১৫ সালে শতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার প্রাক্কালে এক গবেষণায় বলা হয়েছে, লৌহকাঠামোর রাসায়নিক ধাতুর গুণাবলি আরও ২৫ বছর বলবত থাকবে। ফলে ব্রিজ ২০৪০ সাল পর্যন্ত কার্যকরী থাকছে। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ব্রিজ রং করার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয়। ইতিমধ্যেই সরকার হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ৩০০ মিটার অদূরে উজানে নতুন করে আরেকটি ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করছে।
শৈল্পিক কারুকার্যে খচিত বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক বাহক লাল রঙা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ১০৯ বছর পেরিয়ে এখনো দর্শনার্থীদের মন আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করে চলেছে। ব্রিজটির পাশ দিয়েই ২০০৪ সালে তৈরি হয়েছে ‘লালন শাহ সেতু’ নামে একটি সড়কসেতু, যা পদ্মার বুকে ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের সঙ্গে এক অপরূপ সৌন্দর্যে মিলেমিশে রয়েছে।
ভেড়ামারার পি ডাবলু আই সাইফুল ইসলাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১২নন্বর গার্ডার তৎকালিন সময় পূনরায় মিরামত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত আর শতবর্ষের গৌরব নিয়ে আজও পদ্মার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক হার্ডিঞ্জ ব্রিজের বয়স গত ৪মার্চ শনিবার ১০৯ বছর পূর্ণ হয়েছে। সময় সীমা বেধে দেওয়া ১শ’বছরের ব্রিজটির মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। অতিরিক্ত ৯ বছর চলছে। আরো কত বছর এই ব্রিজটির উপর দিয়ে ট্রেন চলবে কেউ বলতে পারে না।
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে সেতু প্রকৌশলী দপ্তর থেকে জানা যায়, ১৯০৯ সালের প্রথম ভাগে প্রাথমিক জরিপ, জমি অধিগ্রহণ ও প্রয়োজনীয় পাথর সংগ্রহের কাজ শুরুর মধ্য দিয়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নির্মাণকাজ শুরু হয়।
রেলওয়ে অফিস সূত্রে আরো জানা যায়, ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিজটি উদ্বোধন করেন। এরপর থেকে ব্রিজের ওপর দিয়ে যাত্রীবাহী গাড়ি ও ট্রেন চলাচলের জন্য তা উন্মুক্ত করা হয়। তার নামানুসারেই এর নামকরণ করা হয় ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) নুর মোহাম্মদ জানান, সেতুর ১৫টি স্প্যানের দুটি বিয়ারিংয়ের মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্য ৩৪৫ ফুট দেড় ইঞ্চি এবং উচ্চতা ৫২ ফুট। প্রতিটি স্প্যানের ওজন ১২৫০ টন, যা রেল লাইনসহ ১৩০০ টন। সেতুটিতে মোট ১৫টি স্প্যান ছাড়াও দুই পাড়ে তিনটি করে অতিরিক্ত ল্যান্ড স্প্যান রয়েছে। এদের দুটি বিয়ারিংয়ের মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্য ৭৫ ফুট। এভাবে সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য ৫৮৯৪ ফুট বা এক মাইলের কিছু বেশি। ১৯১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ২৪ হাজার ৪০০ শ্রমিক কাজ করে ১৯১৪ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ করেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনা বাহিনীকে রুখতে মিত্রবাহিনীর যুদ্ধ বিমান থেকে বোমা ফেলা হয় পাকশী হার্ডিঞ্জ সেতুর ওপর। এই বোমার আঘাতে সেদিন সেতুর ১২ নম্বর গার্ডার ভেঙে যায়। আরও বেশকিছু গার্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ভারত সরকার সেতুর ১২ নাম্বার গার্ডারের অনুরূপ আরেকটি স্প্যান স্থাপন করে দেয়।
তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে দাঁড়িয়ে হার্ডিঞ্জ সেতু পার হয়ে রেলযোগাযোগ পুনঃস্থাপন কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। সে সময়ে এক বাণীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, এ সেতুর পুনর্র্নিমাণ জাতীয় পুনর্গঠন কাজে আত্মপ্রত্যয় ও নিষ্ঠার সঙ্গে কর্তব্য পালনের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে অন্য সবাইকে অনুপ্রাণিত করুক এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার মৈত্রীর বন্ধন ও যৌথ প্রচেষ্টার সার্থক স্বাক্ষর হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকুক।
ভেড়ামারা সরকারী মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ (অব:) আব্দুর রাজ্জাক রাজা ও পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও ঈশ্বরদীর ঐতিহাসিক নিদর্শন নিয়ে গবেষণাকারী প্রবীণ অধ্যাপক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ বলেন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজটির বয়স ১০৯ বছর পূর্ণ হলো। শতবছর পূর্তির সময় সেতুটি পরিদর্শন করে বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, এই সেতু সঠিকভাবে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করলে এটি আরও অন্তত ২৫ বছর টিকে থাকতে পারে।
এই ব্রিজটি ৪ মার্চ ২০২৪ সালে এর বয়স ১০৯ বছর পূর্ণ হলো। এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রেলসেতু। এখনও এই ব্রিজটি দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক মানুষ প্রতিদিনই পাকশী ও ভেড়ামারাতে আসেন।
প্রিন্ট