এতে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে পরিবেশ ও প্রতিবেশ। আইন অমান্য করে দিনের পর দিন ইটভাটার সংখ্যা বাড়লেও প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার ছয় উপজেলায় ইটভাটার সংখ্যা ১৭০টি। এর মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে চলছে ২২টি ইটভাটা। বাকি ১৪৮টি ইটভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অধিকাংশ ইটভাটা পরিচালিত হয়। অধিকাংশ ইটভাটায় কয়লার বদলে পুড়ছে কাঠ। অবৈধভাবে কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় ২৩টি, কুমারখালীতে ২৬টি, মিরপুরে ৩০টি, ভেড়ামারায় ৩৪টি, খোকসায় ৭টি ও দৌলতপুরে ২৮টি ইটভাটা পরিচালিত হচ্ছে।
সরেজমিনে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের হাউসপুর গ্রামের কে এইচ এন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, স্কুলের ক্লাসরুম ও অফিস ঘেঁষে চলছে অবৈধ তিনটি ইটভাটা। সেখানকার আর এইচ আর বি এবং এম এ এস বি ইটভাটা বিদ্যালয়ের সীমানার সঙ্গে তৈরি করা হয়েছে। আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে প্রশাসনের চোখের সামনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে ও ঘনবসতি এলাকায় অবাধে কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরি করা হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব কয়লার বিপরীতে কাঠ পুড়ানো হচ্ছে। অবৈধ ট্রলির মাধ্যমে আশপাশের এলাকার ফসলি জমির মাটি এনে তৈরি করা হচ্ছে ইট। অবৈধ ইটভাটার কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে শিক্ষার্থীরা।
অথচ ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) ২০১৯ অনুযায়ী, বিশেষ কোন স্থাপনা, রেলপথ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিংবা অনুরুপ কোনো স্থান বা প্রতিষ্ঠান থেকে কমপক্ষে এক কিলোমিটার দূরে ইটভাটা স্থাপন করতে হবে। কিন্তু স্কুল ঘেঁষে অবৈধ ইটভাটা গড়ে তুলেছে আর এইচ আর বি প্রতিষ্ঠানটি।
-
আরও পড়ুনঃ e-Paper-04.02.2024
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলে, আমাদের স্কুলের পাশেই বড় বড় ইটভাটা করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ইটভাটাগুলো চলছে। স্কুলের পাশে ইটভাটা হওয়ায় আমাদের অনেক সমস্যা হয়। রাস্তায় মাটি পড়ে থাকে। ইটভাটার ধুলাবালি, ধোঁয়া ও কালি শ্রেণিকক্ষে চলে আসে। এতে আমাদের খুব কষ্ট হয়। ঠিকমতো পড়ালেখা করতে পারি না। এ বিষয়ে কেউ কোনো পদক্ষেপ নেয় না। বছরের পর বছর ইটভাটাগুলো এভাবেই চলে। প্রশাসনের লোকরা যদি ইটভাটা গুলো বন্ধ করে দেয় তাহলে আমাদের খুব উপকার হবে। আমরা মনোযোগ সহকারে লেখাপড়া করতে পারব।
কে এইচ এন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, অভিভাবক ও স্থানীয়রা জানান, স্কুলের শ্রেণিকক্ষ ও অফিস রুম ঘেঁষে অবৈধ ইটভাটা গড়ে তোলা হয়েছে। যেখানে গোটা মৌসুম কাঠ পুড়িয়ে ইট বানানো হচ্ছে। ভাটার কারণে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। ভাটার কালো ধোঁয়া, ধুলাবালি শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছে। এতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালির কারণে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ক্লাস করছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। অবৈধ ইটভাটার কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে শিক্ষার্থীরা ও স্থানীয়রা। ইটভাটাগুলো দ্রুত বন্ধের দাবি জানিয়েছেন তারা।
কে এইচ এন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রধান শিক্ষক সোলাইমান হোসেনের সঙ্গে দেখা করে এবিষয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। এসময় আর এইচ আর বি ভাটার মালিক হানিফ, খয়বার, রফিক মাস্টার এবং এম এ এস বি ইটভাটার মালিককে ভাটায় ও মোবাইল কলেও পাওয়া যায়নি।
কুষ্টিয়ার বিভিন্ন উপজেলার ইটভাটায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে প্রশাসনের চোখের সামনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে, ঘনবসতি এলাকায় ও ফসলের মাঠের কৃষি জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে ইটভাটা। অধিকাংশ ইটভাটায় পরিবেশ বান্ধব কয়লার বিপরীতে অবাধে কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরি করা হচ্ছে। অবৈধ ট্রলির মাধ্যমে আশপাশের এলাকার ফসলি জমির মাটি এনে তৈরি করা হচ্ছে ইট। অবৈধ ইটভাটার কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে মানুষ। শুধু তাই নয় নদী ও সরকারি জায়গায় প্রভাবশালী কয়েকজন গড়ে তুলেছেন ইটভাটা। এছাড়া সরকারি জায়গার মাটি কেটে ইট ভাটায় নিয়ে যাওয়া হয়।
কয়েকজন কৃষক বলেন, আইন আছে কিন্তু কেউ মানে না। প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন। প্রতিবছরের মতো এবারও ইট তৈরির মৌসুমে প্রতিদিন ফসলি জমির মাটি ইটভাটায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ কারণে আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এছাড়া ফসলি জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে ইটভাটা। ধোঁয়া ও ধুলাবালিরর কারণে ফসল ও পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
এবিষয়ে ইটভাটা মালিকরা কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক কয়েকজন ইটভাটা মালিক বলেন, লাইসেন্সবিহীন ইটভাটাগুলো প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চালানো হয়। তাছাড়া ভ্যাটও দেওয়া হয়। অবৈধ ইটভাটা মালিকদের অনেক টাকা খরচ করতে হয়। প্রত্যেক ইটভাটা থেকে মোটা অংকের টাকা চলে যাই একটি পক্ষের কাছে। তারা সেই টাকা দিয়ে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে। এভাবেই নির্বিঘ্নে ইটভাটা চালাই সবাই।
কুষ্টিয়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. হায়াত মাহমুদ বলেন, কৃষি জমিতে ইটভাটা নির্মাণের অনুমতি কৃষি বিভাগ থেকে দেওয়া হবে না। কৃষি জমিতে ইটভাটা হলে কৃষি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভাটায় কাঠ পোড়ানোর কারণে ফসলের ফলন বিপর্যয় ঘটে। কৃষি জমিতে ইটভাটা করলে কৃষি জমির ফলন হ্রাস পায়।
কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডা. এ এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ইটভাটার ধোঁয়া ও ধুলাবালি স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া ও ধুলাবালি শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করলে এজমা ও এলার্জি রোগ হয়। ফলে ইটভাটার আশপাশে বসবাসরত মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি দেখা যায়।
অবৈধ সব ইটভাটার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তর কুষ্টিয়া কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক হাবিবুল বাশার। তিনি বলেন, কুষ্টিয়ায় ১৭০টি ইটভাটার মধ্যে ১৪৮টি ভাটাই অবৈধ। বাকি ২২টি বৈধ। সব অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হবে।
প্রিন্ট