দেশের প্রথম রেল স্টেশন কুষ্টিয়ার ‘জগতি’। জীর্ণ স্টেশন ভবন দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত পৌঁছে গেল ট্রেন। ইতােপূর্বে বহুল প্রতীক্ষিত দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের উদ্বোধন করা হলো। তারও আগে নতুন এক যুগের সূচনা করেছে মেট্রোরেল। কিন্তু এই ট্রেন বা রেল যোগাযোগের শুরুটা আসলে কেমন ছিল? কীভাবে কোন পথে প্রথম ট্রেন এসে ঢুকেছিল বাংলায়? প্রশ্নগুলো মনে উঁকি দিয়েছে কখনো? যদি উঁকি দেয়, তবে এখন এই মুহূর্তে আসুন অতীতের সেই ট্রেনে চড়ে বসি। বহুকাল আগে শুরু হওয়া রেল যোগাযোগের একেবারে গোড়াতে গিয়ে নতুন করে আবিষ্কার করি ইতিহাসটা।
শুরু করা যাক ১৮৫৩ সাল থেকে। তখন ব্রিটিশ ভারত। ১৬ এপ্রিল থেকে মুম্বাই ও থানের মধ্যে যাতায়াত শুরু করল বাষ্পচালিত রেলগাড়ি। এর ঠিক পরের বছর ১৮৫৪ সালের ১৫ আগস্ট রেল গাড়িতে চড়ার সুযোগ পেয়ে গেল বাঙালি। এই বাঙালি বলতে কলকাতার বাঙালি। কলকাতার হাওড়া থেকে ওই বছর হুগলি পর্যন্ত যাতায়াত শুরু করল ট্রেন। তবে প্রায় একই সময় পরিকল্পনা করা হলেও, পূর্ব বাংলা, মানে, আজকের বাংলাদেশ অংশে ট্রেন এসেছিল আরও কয়েক বছর পর।
যতদূর জানা যায়, ১৮৫২ সালে প্রথমবারের মতো আজকের বাংলাদেশ অংশে রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু হয়। তৎকালীন সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল জেপি কেনেডি ব্রিটিশ সরকারের কাছে এ সংক্রান্ত একটি পরিকল্পনা তুলে ধরেন। তার পরিকল্পনা মতো, রেললাইন বসবে গঙ্গা নদীর পূর্ব তীরে। এ তীর ধরে এগিয়ে সুন্দরবন হয়ে ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে ট্রেন। তবে নতুন এক বাস্তবতা সামনে আসায় এ পরিকল্পনা আর আলোর মুখ দেখেনি। পরে ১৮৫৫ সালে বাংলায় নিযুক্ত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশল কোরের মেজর অ্যাবার ক্রমবি মাঠ পর্যায়ের একটি জরিপ পরিচালনা করেন। রেলপথ নির্মাণের সম্ভব্যতা যাচাই করতে যা যা প্রয়োজন সবই করেন তিনি।
ভূপ্রকৃতি, বাণিজ্য, সামরিক সুবিধা ইত্যাদি আমলে নিয়ে প্রস্তুত করা রিপোর্ট ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঠানো হয়। সরকারও বাংলায় রেলপথ স্থাপনের ব্যাপারে একমত পোষণ করে। সে লক্ষ্যে পরবর্তী দু বছর ধরে চলে সমীক্ষা। আর বড় অগ্রগতির খবর আসে ১৮৫৭ সালে। ওই বছর লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে। এ রেলওয়েই বাংলায় প্রথমবারের মতো রেলপথ স্থাপনের দায়িত্ব পায়। পশ্চিম বাংলা এবং পূর্ব বাংলায় প্রায় একই সময়ে কাজ শুরু হয়। কাজ শেষে ১৮৬২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন করা হয় কলকাতা-রানাঘাট সেকশন। কিছুদিন পর ১৫ নভেম্বর রানাঘাট থেকে দর্শনা হয়ে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেলপথ উন্মোচন করা হয়। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো রেল পরিষেবার সূচনা ঘটে এই ভূখ-ে। একই দিন এ সেকশনে পোড়াদহ, চুয়াডাঙ্গা, দর্শনা ও জগতি স্টেশন উদ্বোধন করা হয়। তবে শেষ স্টেশন জগতিই পায় প্রথম স্টেশনের স্বীকৃতি।
অনেকে জেনে অবাক হবেন যে, এখনো টিকে আছে জগতি স্টেশন। টিকে আছে বলতে, অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়নি। বর্তমান কুষ্টিয়া শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে মহামূল্যবান এই স্মারক ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্টেশনটি পরিত্যক্ত প্রায়। কখনো সখনো ট্রেন এসে থামে। প্রাচীন স্থাপনার সংস্কার করা হয় না। এত বড় ইতিহাস! ইতিহাসটি বাঁচিয়ে রাখার বা আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার কোনো উদ্যোগ নেই। তবুও লাল রঙের জরাজীর্ণ ভবন নিজের সবটুকু শক্তি দিয়েই যেন ধরে রেখেছে অতীত গৌরব।
ইতিহাসটিতে ফেরা যাক, বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, জগতি স্টেশন থেকে পরে ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণ করা হয় পদ্মার পাড় পর্যন্ত। এই সেকশনেও রেলপথ নির্মাণের দায়িত্ব পায় ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে। জগতি থেকে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণ শুরু হয় ১৮৬৯ সালে। ১৮৭১ সালে শেষ হয়। ১ জানুয়ারি এ সেকশনে ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করা হয়। ফলে কলকাতা থেকে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
ইতিহাসটি বলছে, উদ্বোধনের দিন থেকেই ইস্ট বেঙ্গল এক্সপ্রেস নামের একটি ট্রেন কলকাতা থেকে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত নিয়মিত চলাচল করত। মাঝখানে পড়ত কুষ্টিয়া, কুষ্টিয়া কোর্ট, চড়াইকল কুমারখালী, খোকসা, মাছপাড়া, পাংশা, কালুখালী জংশন, বেলগাছি, ও সূর্যনগর গোয়ালন্দ বাজার। তখন যাত্রীরা কলকাতা থেকে গোয়ালন্দ ঘাটে এসে নামত। পরে স্টিমারে করে পদ্মা পার হয়ে পৌঁছত ঢাকায়।
এদিকে, ১৮৮৪ সালে ঢাকা স্টেট রেলওয়ে কোম্পানি নারায়ণগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করে। ফলে গোয়ালন্দ ঘাট থেকে যাত্রীরা স্টিমারে করে নারায়ণগঞ্জে চলে আসতেন। নারায়ণগঞ্জ স্টেশন থেকে ট্রেনে পৌঁছতেন ঢাকায়। আগের রাতে কলকাতা থেকে রওনা করে দুপুরের আগেই ঢাকায় পৌঁছে যেতেন যাত্রীরা। এভাবে তিন দিনের পরিবর্তে ১৭ ঘণ্টায় ঢাকায় পৌঁছার নতুন উদাহরণ সৃষ্টি হয়।
ব্রিটিশ ভারত থেকে পাকিস্তান, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের জন্ম। এসব পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন আসতে থাকে রেলেও। বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ে সেই অতীত ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় দেশের নানা অংশে সম্প্রসারিত হওয়া রেল লাইন ছুঁয়ে দিয়েছে সর্ব দক্ষিণে গর্জন করা জলরাশিকেও। আর মেট্রোরেল তো নতুন এক বিপ্লবের সূচনা করেছে। এই অগ্রগতির কালে অতীতের সেই গৌরববের কথাও নিশ্চয়ই মনে রাখব আমরা।
প্রিন্ট