জাপানকে তিনি প্রথম জেনেছিলেন সেই শৈশবে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় বাবার চাকরির সুবাদে। নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের আবাসিক ভবনে থাকতেন তাঁরা। ভেড়ামারা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি জাপানি সহায়তায় তৈরি হচ্ছিল। তাই সে সময় বেশ কয়েকজন জাপানি প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদ সেখানে কর্মরত ছিলেন। শিশু শাহরিয়ার আহমেদ তখন প্রাথমিক স্কুলের ছাত্র। জাপানিদের কর্মনিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে শৈশবেই প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। এমনকি কখনো সুযোগ হলে জাপান নামের দেশটিতে লেখাপড়া করবেন বলে মনে মনে ঠিক করেন।
শৈশবের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন শাহরিয়ার। জাপানে যে শুধু লেখাপড়া করেছেন তা নয়, লেখাপড়া শেষ করে দেশটিতে তিনি গবেষণা এবং শিক্ষকতায় যুক্ত থেকেছেন। পেশাগত দক্ষতা ও পারদর্শিতার মধ্যে দিয়ে শিক্ষকতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে তিনি পৌঁছেছেন। এ যেন শৈশবে দেখা স্বপ্নের মধুর বাস্তবায়ন। এ বছর এপ্রিল মাসে নিইগাতা জেলার সানজো শহরে চালু হওয়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রসর গবেষণার ওপর আলোকপাত করা একেবারে নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে প্রেসিডেন্ট পদে নিয়োগ দিয়েছে। বাংলাদেশি একজন শিক্ষাবিদ ও গবেষকের জন্য এ বিরল এক অর্জন।
জাপানের সরকারি কিংবা বেসরকারি, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই ভাইস চ্যান্সেলরের কোনো পদ নেই এবং প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী। ফলে এই দায়িত্ব অনেকটাই বিস্তৃত এবং একই সঙ্গে হচ্ছে চ্যালেঞ্জিং। সানজো সিটি বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিশিক্ষার একটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নগর প্রশাসনের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত বলে অন্য অর্থে এটা হচ্ছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
শাহরিয়ার আহমেদ জাপানে আসেন ১৯৮৮ সালে। তখন তিনি কলেজ পর্যায়ের লেখাপড়া শেষ করা এক তরুণ। জাপানের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে লেখাপড়া করতে হলে জাপানি ভাষা জানা প্রয়োজন। তাই তিনি ভর্তি হয়েছিলেন টোকিওতে জাপানি ভাষা শেখার একটি স্কুলে। ভাষা রপ্ত হওয়ার পর তিনি ভর্তি হন তাকুশোকু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। চার বছরের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা শেষ করে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন এবং এরপর পিএইচডি পর্যায়ের ডিগ্রি লাভের জন্য ভর্তি হন টোকিও দেনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বাংলাদেশি প্রেসিডেন্ট শাহরিয়ার আহমেদ। ছবিঃ সংগৃহীত।
বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিকে জাপানি ভাষায় বলা হয় দেনকি। বিজ্ঞানচর্চার সেই বিশ্ববিদ্যালয় বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনের একটি সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর পর্যায়ের গবেষণায় নিয়োজিত থাকার সময় শাহরিয়ার আহমেদ কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড নিয়ে কাজ করেছেন। কৃত্রিম হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতা, বিশেষ করে মানবদেহে এটা ব্যবহারের সময় রক্তকণিকা ভেঙে যাওয়ার সমস্যা সমাধান করে নেওয়ায় তাঁর উদ্ভাবন ছিল ব্যতিক্রমী এক অর্জন। পিএইচডি শেষ করার পর একই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতার সুযোগ হয় তাঁর। এরপর নিইগাতার সাঙ্গিও বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েক বছর শিক্ষকতা করে পরে তিনি যোগ দিয়েছিলেন ওকিনাওয়ার আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটে। সেখান থাকা অবস্থায় এ বছর এপ্রিল মাসে চালু হওয়া নিইগাতা জেলার সানজো বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের পদ তিনি গ্রহণ করেছেন এবং নতুন এই বিদ্যাপীঠকে প্রযুক্তিশিক্ষার ক্ষেত্রে জাপানের একটি ব্যতিক্রমী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলায় তিনি এখন সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত আছেন।
জাপানে সাত শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিদেশি প্রেসিডেন্ট আছেন, সে রকম বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে মাত্র আটটি। তবে সানজো বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য সাতটি হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সেদিক থেকে প্রথমবারের মতো সরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হয়ে শাহরিয়ার আহমেদ অন্য অর্থে জাপানের শিক্ষা খাতের আন্তর্জাতিক পথে যাত্রা শুরুর প্রতিনিধিত্ব করছেন।
কিছুদিন আগে ব্যস্ততার মধ্যেও সময় করে গণমাধ্যমের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে নতুন একটি দিক হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির বাস্তব ব্যবহারের শিক্ষা শিক্ষার্থীদের হাতেকলমে লাভের সুযোগ করে দেওয়া। নিইগাতা জেলার সানজো এবং পাশের শহর সুবামে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের অগ্রসরমাণ প্রযুক্তির শিল্প এলাকা হিসেবে পরিচিত।
বিস্তৃত সেই এলাকার ১০৩টি ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারমূলক সম্পর্ক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে নিয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজ করার মধ্যে দিয়ে প্রযুক্তির বাস্তব প্রয়োগ সম্পর্কেও বিস্তারিত জানার সুযোগ পাবে, যা একই সঙ্গে জাপানের শিল্প খাত ও বিশ্ববিদ্যালয়—উভয়ের জন্য উপকারী হয়ে উঠবে বলে শাহরিয়ার আহমেদ মনে করেন। তাঁর মতে, এটা ঠিক ইন্টার্ন ধরনের কাজ নয়, বরং এটা হচ্ছে ক্যাম্পাসের বাইরে প্রশিক্ষণ। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের ল্যাবরেটরিতে করতে হচ্ছে, সানজো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাজে জড়িত হওয়ার মধ্য দিয়ে করে নিতে পারবে।
প্রথম বছর ৮১ জন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে এবং এরা সবাই জাপানি। তবে শাহরিয়ার আহমেদ মনে করছেন, দুই থেকে তিন বছর পর বিদেশি ছাত্র গ্রহণের ব্যবস্থা তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় করতে পারবে এবং সেই সুযোগ দেখা দিলে বাংলাদেশের ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আকৃষ্ট করার উদ্যোগ তিনি অবশ্যই নেবেন। যেকোনো উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে গণ্য হওয়ায় বিদেশি ছাত্রদের জন্য দোয়ার উন্মুক্ত করার মধ্যে দিয়ে সেই বৈচিত্র্যের পথে বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাবে বলে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস।
জাপানের জীবনের কোন দিকগুলো তাঁকে আকৃষ্ট করছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে শাহরিয়ার আহমেদ বলেন, ৩২ বছরের প্রবাসজীবনে জাপানিদের নিষ্ঠা ও সততার পাশাপাশি মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের যে সংস্কৃতি এই দেশে প্রতিনিয়ত তিনি দেখছেন, জাপানি জীবনের সেই সব দিক তাঁকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করছে।
তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশের বাইরে তাঁর অবস্থান। চারপাশে কাজের পরিবেশেও দেশের সঙ্গে সম্পর্ক তেমন নেই। আর এখন মা–বাবা দুজনেই প্রয়াত হওয়ায় আগের মতো স্বল্প বিরতিতে দেশে তাঁর খুব একটা যাওয়া হয় না। তবে এরপরও দেশ তাঁর মনের গভীরে অবশ্যই জায়গা করে আছে। যেমন ওকিনাওয়ায় কাটানো জীবনের উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘ওকিনাওয়ার রাত আমার খুব পছন্দ। নির্জন সে রকম রাতে আমি যখন হেঁটে যেতাম। বাতাসে ভেসে আসত সেই শৈশবের ভেড়ামারার বাতাসের ঘ্রাণ।’
বাংলাদেশের খাবার খেতে মন চাইলে নিজেই তিনি রান্না করে নেন। বিশেষ করে নিইগাতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন শাকের মতো নানা ধরনের লতাগুল্ম সহজেই পাওয়া যায়, সময় হলে নিজেই যেগুলো তিনি রান্না করেন। পারিবারিক জীবনে তাঁর স্ত্রীও জাপানে বসবাসরত একজন বিদেশি। দক্ষিণ কোরিয়ার সেই রমণীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় দুজনেই ছাত্র থাকা অবস্থায়।
শাহরিয়ার আহমেদ একজন বিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞান গবেষণা ও শিক্ষা—দুই দিক থেকেই বিরল সাফল্য তিনি অর্জন করেছেন। সাক্ষাৎকারের শেষের দিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ মানুষ সামাল দিতে পারবে কি না, আর পারলেও কত দিন লাগতে পারে—এমনটা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ধরনের মহামারি অতীতেও এসেছে এবং মানুষ তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। ফলে এবারও এর কোনো ব্যতিক্রম হবে না। তবে তাঁর ধারণা, ভাইরাসের বিস্তার সামাল দিতে আরও বছর দুয়েক সময় লাগবে। কেননা প্রযুক্তি, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও সেই সঙ্গে সামাজিক মূল্যবোধ ও সচেতনতার সমন্বয় ঘটানো হচ্ছে সময়সাপেক্ষ। টিকা অবশ্যই ভাইরাস সামাল দেওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে ভাইরাসের দ্রুত রূপান্তর বলে দিচ্ছে টিকাই চূড়ান্ত সমাধান নয়। নতুন ওষুধ আবিষ্কার এবং এর সহজলভ্যতার দিকগুলোও হিসাবের মধ্যে নেওয়া প্রয়োজন এবং এ কারণেই তিনি মনে করছেন ভাইরাস প্রতিরোধ সত্যিকার অর্থে কার্যকর হতে কিছুটা সময়ের দরকার হবে।
লক্ষ্য অর্জনে মানুষ প্রতিকূলতার মধ্যেও নিষ্ঠাবান থেকে গেলে সাফল্য যে জীবনে ধরা দিতে পারে, তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত শাহরিয়ার আহমেদ। জাপানে তিনি এসেছিলেন মনের গভীরে প্রযুক্তিবিদ হওয়ার স্বপ্ন লালন করে। জাপানি ভাষার স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ের শিক্ষা গ্রহণের কঠিন জীবনে কখনো হাল ছেড়ে দেননি। জাপানে নিজের পরিচয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশকেও তিনি তুলে এনেছেন অনন্য এক উচ্চতায়।
প্রিন্ট