শহর থেকে আনা মালামাল চরের বিভিন্ন গ্রামে নিতে হলে প্রথমে নৌকাযোগে নির্দিষ্ট জায়গায় নামিয়ে তারপর সেই মালামাল তুলে দেওয়া হয় মহিষের গাড়িতে। নদীর তীর থেকে খাড়া ঢাল বেয়ে মহিষের গাড়ি উপরে ওঠে। তারপর ছুটে চলছে মাইলের পর মাইল।
‘মহিষের গাড়ি’ এখন কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় বালুচর দিয়ার বাহাদুরপুর নামক পদ্মার বুকে একমাত্র যানবাহন। কালের আবর্তে এই যানবাহনটির প্রয়োজন এখনো ফুরিয়ে যায়নি। পদ্মার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে উঁচু নিচু, আঁকা বাঁকা বালুময় পথে যাত্রী বা মালামাল গন্তব্যে পৌঁছাতে একমাত্র ভরসা এই ‘মহিষের গাড়ি’।
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলায় এক সময় গ্রামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী বাহন ছিল গরু বা মহিষের গাড়ি। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে গরুর গাড়ি ও গাড়িয়াল পেশা। সময়ের ব্যবধানে এখন এই গরুর গাড়ি স্থান পেয়েছে সংবাদপত্র ও বইয়ের পাতায়। উপজেলার চরাঞ্চলের গ্রামে এখনো দেখা মেলে গরু আর মহিষের গাড়ি। এসব গরুর গাড়ি যারা চালান তাদের বলা হয় গাড়িয়াল।
“ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে” রংপুর অঞ্চলের জনপ্রিয় এ ভাওয়াইয়া গানটি এক সময় মানুষের মন কেড়েছিল। মহিষের গাড়ি কিংবা গরুর গাড়িকে কেন্দ্র করে রচিত হয় এ গানটি। গানের নায়িকা তার গাড়িয়াল প্রেমিকের গাড়ির জন্য পথের পানে তাকিয়ে থাকতো। সেই কথায় জানান দিচ্ছে গানটিতে নায়িকা। সেই গান এখন শুধুই রেকর্ড মাত্র।
একটা সময় ছিল যখন গরুর গাড়ি, মহিষের গাড়ি মানুষের একমাত্র যানবাহন। বিয়ে বাড়ি কিংবা নববধূ বাবার বাড়ি যাবে, মানুষ তাদের আত্মীয় স্বজনদের বাসায় যাবে তখন মহিষের গাড়ি নিয়ে যেত। মহিষের গাড়ির চালকের আসনের পাশে থাকত মিষ্টি-মন্ডাসহ নানান খাবার। আগে-ভাগেই গাড়ি বুকিং করে রাখা হত পরে যদি না পাওয়া যায় এই ভয়ে। এ গাড়ির বিকল্প কিছু ভাবাই যেত না। মহিষের গাড়িতে কোথাও না গেলে অথবা তাতে কেউ না আসলে যেন সম্মান হানীর মত ঘটনা ঘটত।
কিন্তু কালের গর্ভে যেন হারিয়ে যেতে বসেছে এই ঐতিহ্যবাহী যানবাহনটি। তেমন আর দেখা মেলেনা গ্রামের রাস্তা-ঘাটে। বর্তমানে এ গাড়িটি কোথাও দেখলে সেলফি না তুললেই যেন নয় এমন অবস্থা।
বর্তমান প্রজন্মের কাছে মহিষের গাড়ি নিয়ে আনন্দ- স্মৃতির কোন ঘটনা বললে তাদের কাছে তা গল্পের মতো মনে হবে। কেননা এ গাড়ি নিয়ে রয়েছে তখনকার মানুষের নানা ইতিহাস-কিসসা-কাহিনী।
কথা হয় কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলার জুনিয়াদহ ইউনিয়নের নলুয়া গ্রামের মহিষের গাড়িয়াল আক্তার আলীর সাথে। তিনি জানান, আমি প্রায় ৯ বছর ধরে মহিষের গাড়ি চালাই। আমি বর্তমানে আখ পরিবহন করছি আমার গাড়ি দিয়ে। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি এ ঐতিহ্যবাহী গাড়ির চালক হিসেবে। কেননা বাঙ্গালি জাতির অনেক ইতিহাস আছে এ গাড়িকে কেন্দ্র করে। আমি যতদিন পারি এ ঐতিহ্যবাহী গাড়ি চালিয়ে যাব।
ভেড়ামারা উপজেলার পদ্মা নদীর অভ্যন্তরে বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে সরেজমিনে গেলে মহিষের গাড়ির এমন অনেক দৃশ্যই দেখা যায়।
রায়টা বাহাদুরপুর চরের মহিষের গাড়িচালক রবিউল ইসলাম রবি বলেন, আমরা চরের কৃষক। অনেক আগে থেকেই মহিষের গাড়ি চালাই। আবাদের কাজের ফাঁকে মহিষের গাড়ি চালাই।
উপজেলার রায়টা এলাকার নুর ইসলাম বলেন, আমার জমির ফসল ঘরে তোলা ও আর হাঁট-বাজারে নেওয়ার জন্যই মহিষের গাড়ি চালাই।
ভেড়ামারা সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ খলিল উল্লাহ বলেন, গরু ও মহিষের গাড়িতে চড়ে বিয়ে করতে যাওয়ার দৃশ্য আগে দেখা যেতো। এ সংস্কৃতি একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে।
প্রিন্ট