এই মজুরি প্রত্যাখ্যান করেছে শ্রমিক সংগঠনগুলো। শ্রমিক নেতারা বলেন, এটা মালিকদের একপক্ষীয় প্রস্তাব। আশা করি প্রধানমন্ত্রী আরো সুবিবেচনা করবেন।
তবে নিম্নতম মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, ‘শিল্পের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে মালিকপক্ষের প্রস্তাবিত এই মজুরি গ্রহণযোগ্য। তবে দর-কষাকষিতে আমাদের সর্বশেষ দাবি ছিল মজুরি ১৩ হাজার টাকা করা। আমার বিশ্বাস, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং মালিকরা প্রস্তাবিত মজুরি গেজেট হওয়ার আগে বিবেচনায় নেবেন।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লা, বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান, বিকেএমইএর সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ।
এর আগে দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় নিম্নতম মজুরি বোর্ডের কার্যালয়ে পোশাক খাতের জন্য গঠিত নিম্নতম মজুরি বোর্ডের ষষ্ঠ সভায় মালিকপক্ষ ১২ হাজার ৫০০ টাকার ন্যূনতম মজুরির প্রস্তাব করে। নিম্নতম মজুরি বোর্ড এটি চূড়ান্ত করে।
শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত মজুরির বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকারের দেওয়া প্রস্তাবিত মজুরি উচ্চ ব্যয়ের এ সময়ের জন্য কোনোভাবেই সন্তোষজনক নয়। এটি শ্রমিকদের মূল দাবির ধারেকাছেও নেই। তবে ঘোষিত মজুরি চূড়ান্ত নয়, এটি একটি প্রস্তাব। এই খসড়া প্রস্তাব নিয়ে সরকারপ্রধানের সঙ্গে আলোচনা করলে তিনি উপযুক্ত মজুরি ঘোষণা করবেন বলে আশা করি।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, শ্রম আইন অনুসারে গেজেট প্রকাশের আগে এই খসড়া প্রস্তাব আগামী ১৪ দিনের জন্য সাধারণ জনগণের মতামতের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত। তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য সিপিডির ১৭ হাজার ৫৬৮ টাকা মজুরির প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য সমাধানের জন্য বিবেচনা করা যেতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আগামী ১৪ দিনের মধ্যে মজুরির বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। শ্রমিকদের মজুরিকাঠামোতে পাঁচটি গ্রেড থাকবে। সরকার শ্রমিকদের ফ্যামিলি কার্ডের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে।
২০১৩ সালে পোশাক খাতের নিম্নতম মজুরি ৭৬ শতাংশ বাড়িয়ে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা করেছিল নিম্নতম মজুরি বোর্ড। এরপর ২০১৮ সালে নিম্নতম মজুরি তার চেয়ে প্রায় ৫১ শতাংশ বাড়ানো হয়। তখন নিম্নতম মজুরি দাঁড়ায় আট হাজার টাকা।
পোশাক শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের জন্য গত এপ্রিলে সরকার নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করে। গত ২২ অক্টোবর বোর্ডের চতুর্থ সভায় শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা ন্যূনতম মজুরির প্রস্তাব দেন। এর বিপরীতে মালিকপক্ষ প্রায় অর্ধেক বা ১০ হাজার ৪০০ টাকার মজুরির প্রস্তাব দেয়। এই মজুরি প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ হয়ে শ্রমিকরা পরদিন আন্দোলনে নামেন। প্রথমে গাজীপুরে আন্দোলন শুরু হলেও পরে তা আশুলিয়া-সাভারে ছড়ায়।
সংবাদ সম্মেলনে আসার আগে শ্রম প্রতিমন্ত্রী সচিবালয়ে তাঁর দপ্তরে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী বলেন, মজুরি বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী, মালিক ও শ্রমিক পক্ষকে নিয়ে সর্বনিম্ন মজুরি ঘোষণা করা হলো।
সংবাদ সম্মেলনে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘মালিকপক্ষ সব সময় সহনশীল। মালিকপক্ষের সামনে দিয়ে যখন শ্রমিকরা ভাঙচুর করে, আমরা কিন্তু কখনো আমাদের শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাই না। শ্রমিকরা কাজ করেনি, তার পরও ফ্যাক্টরি বন্ধ রেখেছি, আমরা যথেষ্ট সহনশীল।’
তিনি বলেন, নতুন বেতন ডিসেম্বর মাস থেকে কার্যকর হবে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে যখন বেতন দেওয়া হবে তখন শ্রমিকরা নতুন কাঠামোতে বেতন পাবেন। ডিসেম্বরের বেতন নতুন বেতনের আলোকে হবে। গেজেট এখনই করতে দেবে, কোনো সংশোধন থাকলে ১৪ দিনের মধ্যে করবে। এরপর আরেকটি সভায় চূড়ান্ত হবে মজুরি।
ঘোষিত মজুরিতে শ্রমিকরা হতাশ
নতুন মজুরিকাঠামোতে হতাশা ব্যক্ত করেছেন শ্রমিক নেতারা। গার্মেন্টস শ্রমিক জোট বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আশরাফুর ইসলাম বলেন, ‘১২ হাজার ৫০০ টাকায় শ্রমিকরা কিভাবে খুশি হবে? দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরি হলে চার সদস্যের একটি পরিবারের তিন বেলা খাবার কোনো রকমে হয়। ন্যূনতম ১৫ হাজার হলেও কোনো রকমে চলত। গত পাঁচ বছরে ইনক্রিমেন্ট বেড়ে অনেকের মজুরি ৯ হাজার টাকার বেশি হয়ে গেছে। ওই হিসাবে বাড়বে মাত্র তিন হাজার টাকা, যা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। আজ বুধবার বিকেলে সব জোট ঢাকায় বসে এ বিষয়ে শ্রমিকদের সিদ্ধান্ত জানাবে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে মজুরি আরো বৃদ্ধির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আবেদন জানাই।’
বাংলাদেশ শিল্প গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাসুদ রানা বলেন, ‘আমরা খুবই হতাশ। কারণ জিনিসপত্রের দামের সঙ্গে নতুন মজুরির সামঞ্জস্য নেই। আমাদের দাবি ছিল বেসিকের ৬৫ শতাংশ অন্যান্য ভাতা। সেটা সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ১০ শতাংশ দাবি ছিল। আগের ৫ শতাংশই বহাল রাখা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ মজুরিকাঠামো হাতে পেয়ে এবং অন্য নেতাদের সঙ্গে বসে এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
শুক্রবার শ্রমিকদের একাংশের প্রতিবাদ সমাবেশ
ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি প্রত্যাখ্যান করেছেন শ্রমিকদের একাংশের নেতারা। তাঁরা এই মজুরি ২৫ হাজার টাকা করার দাবি পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে যৌক্তিক মজুরি না বাড়ানোর প্রতিবাদে আগামী শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছেন।
গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রসহ আরো কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন এই কর্মসূচির ঘোষণা দেয়।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, ‘গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা করার ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করছি। মজুরি বৃদ্ধির আমাদের যে দাবি, সেটি সরকারকে পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘আগামী শুক্রবার আমরা প্রতিবাদ সমাবেশ করব।’
গাজীপুরে দুটি বাস পোড়ালেন শ্রমিকরা
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, সকাল থেকে কোনাবাড়ী ও আশপাশের এলাকার বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা কোনাবাড়ী উড়াল সেতুর নিচে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। সকাল ১০টার দিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে তাঁরা অবরোধের চেষ্টা চালান। পুলিশ তাঁদের মহাসড়ক থেকে সরাতে গেলে উভয় পক্ষে কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। এ সময় ছত্রভঙ্গ হয়ে কিছু শ্রমিক কোনাবাড়ী উড়াল সেতুর অদূরে আজমেরী পরিবহনের দুটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেন। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছেন। আগুনে বাস দুটির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ওই সড়কে যানবাহন চলাচল শুরু হয়।
এ ব্যাপারে গাজীপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. মাহবুব হোসেন বলেন, দুটি বাস পোড়ানোর সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে।
এদিকে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুরের লিডা ও ফর্টিস কারখানায় ঢুকে কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর এবং দাহ্য পদার্থ ঢেলে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. মোশারফ হোসেন রিপন ওরফে রিপন মাহমুদকে (২৭) গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এই তথ্য জানিয়ে পুলিশ কমিশনার মো. মাহবুব হোসেন গতকাল সকালে নিজ কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, এ ঘটনায় নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে রিপন মাহমুদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কারখানার সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ ও প্রযুক্তির মাধ্যমে শনাক্ত করে গত সোমবার রাতে ঢাকার হাজারীবাগ এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ কমিশনারের তথ্য মতে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রিপন স্বীকার করেছেন উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে সহযোগীদের নিয়ে তিনি এই শ্রমিক আন্দেলনে যোগ দেন এবং কালিয়াকৈর ও কোনাবাড়ীর কারখানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন।
প্রিন্ট