১৯৭৯ সালের এসএসসি সার্টিফিকেট অনুযায়ী ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ৮ বছরের শিশু ছিলেন শেখ আতাউর রহমান। কিন্তু সেই তথ্য তিনি গোপন করে ভোটার আইডি কার্ডে বয়স বাড়িয়ে হয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বিগত ১৪ বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা নিচ্ছেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে এক ছেলেকে দিয়েছেন সরকারি চাকুরী। দীর্ঘদিন ধরেই বিষয়টি নিয়ে এলাকায় চলছে কানাঘুষা, বইছে নিন্দার ঝড়।
জানা যায়, শেখ আতাউর রহমান নরসিংদী জেলার বেলাবো উপজেলার ধুকুন্দি গ্রামের মৃত আসমত আলীর ছেলে। ১৯৭৯ সালে শিবপুর উপজেলাধীন জয়নগর আলহাজ্ব আফসার উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে
তৃতীয় বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করেন তিনি। তার পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল শিবপুর, রোল নং- ৪৬৬২৮, রেজি নং-১৭৩১২/৭৬, বিভাগ- বিজ্ঞান ।
তার জন্ম তারিখ ০৩/০১/১৯৬৩। অর্থাৎ ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ৮ বছর। কিন্তু এই তথ্য গোপন করে ভোটার আইডি কার্ডে বয়স বৃদ্ধি করে খেতাব নিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ২০০৯ সাল থেকে তিনি নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন। এলাকাবাসীর প্রশ্ন, যিনি বয়স কমিয়ে পরীক্ষা দিতে পারেন তিনি বয়স
বাড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধা কেন হতে পারবেন না। এলাকাবাসী বিষয়টি জানতে পেরে তার বিরুদ্ধে লিফলেট বিতরণ করেছে। তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে চলছে গণস্বাক্ষর।
বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এলাকার সচেতন মহল। অভিযোগ রয়েছে, তার ছেলে অলি মাহমুদ ওরফে ভাস্কর অলি বর্তমানে নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও জেলা যুবলীগের গ্রন্থ ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। যদিও শেখ মো. আতাউর রহমান বর্তমান আমলাব ইউনিয়ন বিএনপি’র কর্মী বলে বিএনপি নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে।
এদিকে অভিযোগ রয়েছে, ভাতা এবং সনদ ঠিক রাখার জন্য সরকার পরিবর্তন হলেই খোলস পাল্টান শেখ আতাউর রহমান। এ বিষয়ে বেলাবো উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মনিরুজ্জামান খান বলেন, শেখ আতাউর রহমান ও তার ছেলেরা দিনে আওয়ামী লীগ রাতে বিএনপি। বাপ-বেটা সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন কর্মকান্ডে লিপ্ত। তারা অসামাজিক লোক। তাদের সালিশ দরবারে ডাকা হলেও তারা উপস্থিত হন না। আবার দরবার ডাকা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আতাউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা নন, তিনি দুই নাম্বার মুক্তিযোদ্ধা। ধান্দাবাজি হল ওদের
বাপ-বেটার ব্যবসা। জানা যায়, ২০১৬ সালের আমলাব ইউনিয়ন বিএনপির কমিটিতে তিনি ছিলেন সম্মানিত সদস্য। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আমলাব ইউনিয়নের সাবেক বিএনপির সভাপতি এবং সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ।
তিনি বলেন, আমার সাথে দীর্ঘ দিন বিএনপি রাজনীতি করেন আতাউর রহমান। কিন্তু বর্তমানে শুনি তিনি আওয়ামী লীগ করেন। অর্থাৎ ব্যক্তি স্বার্থের জন্য সেই তথ্যও গোপন করছেন তিনি। এখন পরিচয় দেন
আওয়ামী লীগের লোক হিসাবে। কেননা তারই ছোট ছেলে অলি মাহমুদ ওরফে ভাস্কর অলি নরসিংদী জেলা যুবলীগের গ্রন্থ ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী সদস্য। তাই তিনি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও এলাকায় আধিপত্য ঠিক রাখার জন্য ডিগবাজি মেরেছেন। আওয়ামী পরিবারের সদস্য পরিচয় দিয়ে একের পর এক অপকর্ম করে যাচ্ছে বাপ-বেটা। অভিযোগ রয়েছে, জোরপূর্বক আপন ছোট ভাইয়ের জমি দখল করেছেন তিনি। এ নিয়ে হয়েছে মামলাও চলছে। বেলাব থানা এম মুকাদ্দমা নং- ৬৫/২৩ । একাধিকবার সালিশ দরবার ডাকলেও উপস্থিত হন নি আতাউর রহমান ও তার ছেলে ভাস্কর অলি ।
জানা যায়, সরকারি উন্নয়নমূলক রাস্তার কাজে বাধা দিয়ে চাঁদা দাবি করেছেন ভাস্কর অলি। ফলে চাঁদাবাজির মামলা। বেলাব থানা সি আর মামলা নং ৩২৬/ ২৩। অভিযোগ রয়েছে, ভাস্কর অলি ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যান বানানোর কথা বলে হাতিয়ে নিয়েছেন লক্ষ লক্ষ টাকা। স্থানীয় একাধিক ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য প্রার্থীর অভিযোগ, ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যান বানানোর কথা বলে হাতিয়ে নিচ্ছে ভাস্কর অলি লক্ষ লক্ষ টাকা।
এর মধ্যে বারৈচা গ্রামের দুলালকে মেম্বার বানানোর কথা বলে ১ লক্ষ টাকা নেয় ভাস্কর অলি, কিন্তু সেটা পারেনি। চর উজিলাবো ইউনিয়নের বেলায়েত হোসেন বুলবুলকে চেয়ারম্যান বানানোর কথা বলে হাতিয়ে নিয়েছে ১০ লক্ষ টাকা। চেয়ারম্যান বানানো তো দূরের কথা আজ পর্যন্ত টাকাটাও ফেরত দিচ্ছে না ভাস্কর অলি।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, পুত্র ভাস্কর অলি বিভিন্ন কথা বলে মানুষের কাছ থেকে টাকা এনে সেই টাকা খরচ করে ধুকুন্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের হয়েছে সভাপতি। বিদ্যালয়ের সভাপতি হওয়ার পরে বিদ্যালয়ের নতুন বই চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করা হলেও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি। তার এক ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে স্কুলের ক্লাস বন্ধ করে প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে অনুষ্ঠান করে তিনি। বিষয়টি নিয়ে সে সময় ব্যাপক সমালোচনা হয়। বাপ-বেটার এ ধরনের অপকর্মে অতিষ্ঠ বেলাব বাসী।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নরসিংদী জেলা যুবলীগের এক নেতা বলেন, অলি কিসের নেতা, তেলবাজী ও চাটুকারিতে হলো তার প্রধান কাজ। জালিয়াতি ও প্রতারণা হলো তার পেশা। তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
সরেজমিনে শেখ আতাউর রহমানের বাড়িতে গিয়ে কথা বললে তিনি বয়সের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে বয়স কমিয়ে তিনি পরীক্ষা দিয়েছিলেন বলে দাবি করেন।
বিতর্কিত মুক্তিযোদ্ধা শেখ আতাউর রহমানের বিষয়ে কথা হয় বেলাবো উপজেলা নির্বাহী অফিসার আয়েশা জান্নাত তাহেরার সাথে। তিনি জানান, ডকুমেন্টগুলি দেখে আমি অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিব।
ভাস্কর অলির বিষয়ে কথা হয় নরসিংদী জেলা যুবলীগের সভাপতি বাবু বিজয় কৃষ্ণ ঘোস্বামীর সাথে। তিনি জানান, চাঁদাবাজির সাথে সংশ্লিষ্ট কেউ যুবলীগে থাকতে পারবে না। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদিকে শেখ আতাউর রহমান ও তার ছেলে ভাস্কর অলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট দাবি স্থানীয় ও ভুক্তভোগীদের। তাদের আমলনামা যাচাই-বাছাই করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিবেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এমনটাই প্রত্যাশা বেলাব বাসীর।
প্রিন্ট