দেশে বর্তমানে ৩৮ ধরনের সেবায় আয়কর রিটার্নের প্রমাণপত্র জমা দেয়া বাধ্যতামূলক। আসন্ন বাজেটে এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আরো নতুন ছয় সেবা। সব মিলিয়ে আগামী অর্থবছর থেকে মোট ৪৪ ধরনের সেবা নিতে আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দিতে হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন যেসব সেবা নিতে আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেয়া বাধ্যতামূলক হতে পারে সেগুলো হলো স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি ও কার্ট্রিজ পেপারের ভেন্ডর বা দলিল লেখক হিসেবে নিবন্ধন ও লাইসেন্স বা তালিকাভুক্তি ও তা বহাল রাখা; ভূমি, ভবন এবং অ্যাপার্টমেন্ট লিজ রেজিস্ট্রেশন; পৌরসভা এলাকায় ১০ লাখ টাকা মূল্যের জমি বিক্রয়, হস্তান্তর বা লিজ রেজিস্ট্রেশন; ট্রাস্ট, ফান্ড, ফাউন্ডেশন, এনজিও, মাইক্রোক্রেডিট অর্গানাইজেশন, সোসাইটি এবং সমবায়ের ব্যাংক হিসাব খোলা ও চালু রাখা; সিটি করপোরেশন এলাকায় বাড়ি ভাড়া বা লিজ গ্রহণকালে বাড়ির মালিকের এবং কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক পণ্য বা সেবা সরবরাহ গ্রহণকালে সরবরাহকারীর বা সেবা প্রদানকারীর ক্ষেত্রে।
কর-জিডিপি অনুপাতের দিক থেকে নিচের সারি অবস্থানের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সর্বশেষ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) ঋণ দেয়ার সময় কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে। বর্তমানে দেশে কর-জিডিপির অনুপাত ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে এনবিআরকে এ অনুপাত তুলতে হবে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকার এখন এ লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আয়কর থেকে আগামী তিন অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৪ লাখ ৯৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
এনবিআর-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে এরই মধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এছাড়া রাজস্ব আদায় বাড়াতে আরো কিছু সংস্কার ও পদক্ষেপের বিষয়েও আইএমএফকে জানিয়েছে এনবিআর। গত কয়েক বছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। তাই আইএমএফের প্রোগ্রামের আওতায় বাড়তি রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, কিছু সংস্কার পদক্ষেপ নিলেই তা পূরণ করা সম্ভব। এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে ই-পেমেন্ট, ই-রিটার্ন ফিলিং, ই-টিডিএস, ই-অফিস ম্যানেজমেন্ট ও ই-টিআইএন সিস্টেম। এসব খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও দক্ষ জনবল নিয়োগ করলে এনবিআরের রাজস্ব আদায় বাড়বে।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৩১ লাখ ৯৬ হাজার ৭১৬ রিটার্ন জমা পড়েছে। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে রিটার্ন জমা পড়েছে ২৫ লাখ ৫৪ হাজার ২১৫। সে হিসাবে এক বছরেরও কম সময়ে সাত লাখের বেশি রিটার্ন জমা পড়েছে। এনবিআর কর্মকর্তারা বলেন, রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেয়ার আওতা বাড়লে মোট রাজস্বে আয়করের অংশ বাড়বে।
এনবিআর মনে করছে, বর্তমানে ৩৮ ধরনের সেবায় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেয়া বাধ্যতামূলক করায় আয়করদাতার সংখ্যা বেড়েছে। এর আওতা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। একই সঙ্গে এনবিআর ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের সঙ্গে যৌথভাবে ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) চালুর বিষয়টিও কর আহরণ বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।
ভ্যাটমুক্ত হতে যাচ্ছে অনলাইন মার্কেটপ্লেস: বেশ কয়েক বছর ধরেই অনলাইন মার্কেটপ্লেসে ব্যবসার ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছিলেন ই-কমার্স খাতের ব্যবসায়ীরা। অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতের ব্যবসায়ীদের বিক্রয়ের ওপর মূসক বা ভ্যাট পরিশোধের বাধ্যবাধকতা তুলে নেয়া হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার আগামী বাজেটে অনলাইন মার্কেটপ্লেস এবং খুচরা ব্যবসার শ্রেণীবিন্যাস করে একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। এর মাধ্যমে অনলাইন মার্কেটপ্লেসগুলোর ডিজিটাল ব্যবসার ওপর ভ্যাট মওকুফ করা হতে পারে। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, অনলাইন মার্কেটপ্লেস কোম্পানিগুলো পরিষেবা প্রদানের ওপর ভ্যাট দিয়ে থাকে। একই সঙ্গে নিজস্ব পণ্য বা পরিষেবা বিক্রির ক্ষেত্রেও ভ্যাট পরিশোধ হয়ে থাকে।
সরকারের নতুন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, এটি করদাতাদের হয়রানি কমাবে এবং এ খাতে বিদেশী বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে। এছাড়া এ খাতের ব্যবসায়ীরা ডেলিভারি চার্জের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহার বা ১৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলেও মনে করেন।
এর আগে খাতসংশ্লিষ্টরা এনবিআরের প্রাক-বাজেট আলোচনাসহ বিভিন্ন সময়ে অনলাইন মার্কেটপ্লেস এবং খুচরা ব্যবসার শ্রেণীবিন্যাসসহ এ জাতীয় বিধান অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছিলেন। বর্তমানে অনলাইন মার্কেটপ্লেসগুলোকে তাদের সাইট ব্যবহার করে করা প্রতিটি বিক্রয়ের ওপর ভ্যাট দিতে হচ্ছে। যদিও ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের বক্তব্য হলো তারা পণ্য ও পরিষেবা বিক্রি করছেন না। তারা শুধু ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সংযোগ তৈরি করে দিচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিডিজবসডটকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহপ্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘বর্তমানে প্রচলিত ব্যবসা এবং অনলাইন মার্কেটপ্লেসের মধ্যে ভ্যাট বিধানের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য নেই। তবে প্রকৃতপক্ষে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। ই-কমার্স কোম্পানিগুলো তাদের মার্কেটপ্লেসের মাধ্যমে বিক্রেতা ও ক্রেতাদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করলেও তারা এখন ভ্যাট দায় নিতে বাধ্য। সরকার যদি বাজেটে এটা সংশোধন করে তবে এ খাতকে উৎসাহিত করতে সহায়তা করবে।’
তিনি বলেন, ‘ডেলিভারি চার্জের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে, যা ডেলিভারিকে ব্যয়বহুল করে তোলে এবং গ্রাহকদের আরো চাপের মধ্যে ফেলে। কারণ ঢাকার বাইরে বিপুলসংখ্যক ক্রেতা বসবাস করছেন যাদের ১ হাজার টাকার পণ্য ক্রয়ের জন্য প্রায় ১৫০-২০০ টাকা অতিরিক্ত ডেলিভারি চার্জ দিতে হয়। উচ্চমূল্যস্ফীতির মধ্যে ভোক্তাদের বোঝা কমাতে, অনলাইন বিক্রিকে জনপ্রিয় করতে এবং ডিজিটালাইজেশনে সহায়তা করতে এই ভ্যাট প্রত্যাহার বা কমিয়ে ৫ শতাংশ করা উচিত।’
প্রিন্ট