বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাসরত প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এ নিবন্ধিত। এক হাজার ১০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রত্যাবাসনের জন্য একটি পাইলট প্রকল্প এখন আলোচনায় রয়েছে। চীনের মধ্যস্থতায় বর্ষা মৌসুমের আগেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার।
এই কারণে রাখাইনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে শুক্রবার মিয়ানমার সফর করেন রোহিঙ্গা ও সরকারের ২৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। প্রতিনিধি দলটি শুক্রবার বিকেলে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ১৫টি গ্রাম পরিদর্শন করেন। প্রতিনিধি দলের উদ্দেশ্য ছিল প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের সহায়ক পরিবেশ আছে কি না তা দেখা।
১৫ মার্চ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু থেকে মিয়ানমারের ২২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ১৭৭টি পরিবারের ৪৮০ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই করে। ওই তালিকা থেকে ২০ সদস্যের একটি রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দল গঠন করা হয়।
তবে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রোহিঙ্গারা সেখানে প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ দেখতে পায়নি। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ আশাবাদী। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রোহিঙ্গারা ফিরে আসার পর প্রতিটি পরিবারকে মডেল ভিলেজে একটি করে বাড়ি, কৃষির জন্য জমি, সার ও বীজ দেওয়া হবে। রোহিঙ্গা মেয়েরা সেখানে স্বাধীনভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে।
বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চেয়ে মংডুর মডেল গ্রামটি অনেক ভালো। যারা মডেল ভিলেজে থাকবেন, প্রতিটি পরিবারকে (রোহিঙ্গা) চাষাবাদের জন্য এক একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হবে, রোহিঙ্গা শিশুরা স্কুলে পড়ার পাশাপাশি কাজ করার সুযোগ পাবে এবং স্বাধীনভাবে ব্যবসা করার সুযোগ পাবে।
মডেল গ্রামগুলোয় হাসপাতাল, মসজিদ ও খেলার মাঠ স্থাপন করা হচ্ছে, যা অতীতে রোহিঙ্গা বসতিগুলোয় ছিল না। রোহিঙ্গাদের সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে।
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে ফিরে আসা রোহিঙ্গাদের মাত্র তিনদিন মংডু ট্রানজিট সেন্টারে রাখা হবে। তারপর সরাসরি মডেল ভিলেজে স্থানান্তর করুন। এরপর রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন সার্টিফিকেট (এনভিসি) দেওয়া হবে।
মিয়ানমারের বাসিন্দা হিসেবে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে পারলে পর্যায়ক্রমে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ইস্যু করা হবে।
পরিদর্শনকালে রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের কয়েকজন সদস্য এনভিসির বিরোধিতা করেন এবং এনআইডি ও মডেল ভিলেজের পরিবর্তে জন্মভিটায় পুনর্বাসনের দাবি জানান।
রোহিঙ্গাদের সফরসঙ্গী বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। রাখাইনের পরিবেশ ও পরিস্থিতি খুবই ভালো দাবি করে তারা বলেন, ছয় বছর আগে রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিলেও রোহিঙ্গারা মংডু শহরে সরে আসেনি।
রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, আমরা মংডু শহরে গিয়েছিলাম এবং গ্রামেও গিয়েছিলাম। আমরা সেখানে রোহিঙ্গাদের সঙ্গেও কথা বলেছি, পরিবেশ খুবই ভালো। মংডু শহরে রোহিঙ্গারা অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কাজে ব্যস্ত।
আমরা আশাবাদী এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে দ্রুত শুরু করতে চাই। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলতে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে ফিরে আসবে।
রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের প্রধান মোহাম্মদ চালিম বলেন, রাখাইনের ১৫টি গ্রাম পরিদর্শনের পাশাপাশি রাখাইনে প্রত্যাবাসনে কতটা অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে তা দেখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলকে। কিন্তু তারা প্রত্যাবাসনের আগে নাগরিকত্ব না দিয়ে এনবিসি কার্ড (গেস্ট কার্ড) দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিতে চায়।
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বলছে, সেখানে যাওয়ার ছয় মাস পর নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এর জবাবে আমরা বলেছি, প্রথমে নাগরিকত্ব দিয়ে প্রত্যাবাসন শুরু করতে হবে। তবে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়াটাও জরুরি।
একটি সমগ্র জনগোষ্ঠী তাদের স্বাভাবিক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এমন একটি রাষ্ট্রে অন্যের শরণার্থী হিসেবে বছরের পর বছর ধরে অন্য দেশে বসবাস করতে পারে না। তাদের নিজেদের দেশে, তাদের ভূমিতে, তাদের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার অধিকার রয়েছে, যেখানে তারা তাদের এবং তাদের সন্তানদের জন্য একটি উন্নত জীবন এবং উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করবে।
এই কর্মসূচি দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত প্রত্যাবাসনের সূচনা হিসেবে দেখা যেতে পারে, যা ভবিষ্যতে আরও বেশি সংখ্যক প্রত্যাবাসনের জন্য আস্থা তৈরি করতে পারে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে এটি শুরু। যদি এই উদ্যোগ অব্যাহত থাকে, তবে আরও অনেকে তাদের পৈতৃক বাড়িতে ফিরে যাবে।
কক্সবাজারের ৮০ শতাংশেরও বেশি শরণার্থী বেঁচে থাকার জন্য বাহ্যিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। প্রতিটি পরিবার জনপ্রতি মাসিক এক হাজার ৩০ টাকা করে খাদ্য রেশন পায়। রোহিঙ্গারা বারবার জোর দিয়ে বলেছে, এই বরাদ্দ দিয়ে পরিবার চালানো খুবই কঠিন।
অন্যদিকে, শরণার্থীদের আগমন একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশের আয়োজক সম্প্রদায় এবং পরিবেশের উপর প্রচুর চাপ সৃষ্টি করেছে। ডব্লিউএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের মতো কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং ক্ষুধার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
এটাও সম্ভব যে রোহিঙ্গারা ভয় পাচ্ছে এবং তাদের অধিকার আরও লঙ্ঘিত হলে ফিরে যেতে অনিচ্ছুক। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হবে, অর্থায়ন, প্রশাসন, শরণার্থী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়সঙ্গত আচরণ এবং জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুসহ সম্ভাব্য বছরগুলোয় এই শরণার্থী সংকট কীভাবে মোকাবিলা করা যায়।
শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর জন্য একটি ‘পাইলট প্রত্যাবাসন প্রকল্প’ প্রয়োজন যেখানে উভয় দেশেরই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা এবং রেফারেন্স রয়েছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়ই ১৯৭৮ সাল থেকে আন্তর্জাতিক সহায়তায় এটি নিয়ে কাজ করেছে।
বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু এই বিশাল জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিন আশ্রয় দেওয়া আমাদের জন্য কঠিন। আমাদের দেশ ছোট এবং আমাদের জনসংখ্যা বিশাল। আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা এত ভালো নয় যে, আমরা দিনের পর দিন রোহিঙ্গাদের খাদ্য, আশ্রয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারি।
উল্লেখ্য, রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা দিন দিন কমে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন ইউক্রেন সংকট নিয়ে উদ্বিগ্ন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান ২০২২-এর আওতায় প্রয়োজনীয় ৮৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মাত্র ৪৩ শতাংশ ২০২২ সালে অর্থায়ন করা হয়েছে। ২০২১ সালে বিতরণ করা অর্থের পরিমাণ ছিল প্রয়োজনীয় ৯৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ৭২ শতাংশ।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৮০০টি আখড়ায় মাদক চোরাচালান পরিচালিত হয় এবং পাঁচ বছরের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে রোহিঙ্গা শিবিরে ১২৩ জন নিহত হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় অস্ত্র ব্যবসা, হত্যা, ধর্ষণ ও চাঁদাবাজি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা বাড়ছে।
উখিয়া, টেকনাফ ও ভাসানচরে রোহিঙ্গারা যেসব জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে, সেখান থেকেও পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা রয়েছে। তাদের কেউ কেউ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টাও করছেন। সমুদ্র পারাপারের সময় রোহিঙ্গাদের নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটেছে। তারা দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রবেশের চেষ্টা করছে।
কয়েকটি জেলা থেকে তাদের গ্রেফতারও করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনাটি ছিল মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। তাদের প্রত্যাবাসন করা এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব।
রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতির কারণে শুধু আমাদের অর্থনীতির ওপরই নয়, বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যার ওপরও চাপ পড়ছে। মিয়ানমারে এখন যে সরকারই থাকুক না কেন, বাংলাদেশের উচিত মিয়ানমারের সমাজ, মিয়ানমার সরকার ও বিরোধী দলের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে কাজ করা। যাতে তারা মনে না করে যে আমরা রোহিঙ্গাদের উসকানি দিই, তাদের আশ্রয় দিই, আমরা তাদের মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাঠাই ইত্যাদি। যাতে ধারণাটি মিয়ানমারে না থাকে।
মিয়ানমারের আস্থা গড়ে তুলতে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে তাদের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু করেছে, তাদের জাতীয় দিবসে প্রতিনিধি পাঠানো, দুই দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে বৈঠক, মিয়ানমারের দুর্যোগে বাংলাদেশ ত্রাণ পাঠালেও এগুলো যথেষ্ট উদ্যোগ নয়।
এখন যেহেতু বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে গভীর সংকটের মধ্যে রয়েছে, তাই আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি প্রচেষ্টা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অনুষ্ঠিত হয় না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ২০০০ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারের সঙ্গে ১৬টি শীর্ষ পর্যায়ের সফর হয়েছে। অর্থাৎ এই গভীর সংকটে দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ে কোনো সংলাপ হচ্ছে না। এখন হঠাৎ করে তা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে সংলাপ বাড়াতে হবে।
রোহিঙ্গা ছাড়াও দুই দেশের মধ্যে আরও অনেক বিষয় রয়েছে, যা এই মুহূর্তে আরও আলোচনা করা দরকার। প্রয়োজনে অন্যান্য বিষয়ে ছাড় দিতে হবে এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিজেদের স্বার্থ আদায়ে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
তদুপরি, ‘অনুকূল পরিবেশ’ বিতর্কটিও রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট। জান্তা যেহেতু প্রত্যাবাসন করছে, তাই তারা তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিচ্ছে। রাখাইন ও মিয়ানমারের অন্যান্য স্টেকহোল্ডার, আরাকান আর্মি (এএ) এবং ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দিয়েছে।
উপরন্তু, চীন যেহেতু এই চুক্তিকে সমর্থন করছে, তাই প্রত্যাবাসনের সময় রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার জন্য একটি বাহ্যিক গ্যারান্টি প্রদানের দায়িত্বও রয়েছে। অতএব, জান্তার সাথে প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা অনুসন্ধান করা অনিরাপদ নাও হতে পারে। মনে হচ্ছে এনজিওগুলো তাদের নিজস্ব বাধ্যবাধকতার কারণে ‘প্রকল্প’ দীর্ঘায়িত করছে এবং শরণার্থী সম্প্রদায়ের দুর্দশা প্রদর্শন করে তাদের দাতাদের দমন করছে।
সংক্ষেপে বলা যায়, প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা বাংলাদেশের বোঝা কিছুটা হলেও কমিয়ে আনবে। পাইলট প্রকল্পটি বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সম্পৃক্ততাও বৃদ্ধি করবে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের এর বিরুদ্ধে যাওয়া উচিত নয়; পরিবর্তে, তাদের এগিয়ে আসা উচিত এবং বাকি শরণার্থীদের দ্রুত প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার জন্য কার্যকরভাবে জড়িত হওয়া উচিত। এনজিও এবং অ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্কগুলোরও বাধ্যতামূলকভাবে প্রতিক্রিয়া জানানোর পরিবর্তে তাদের ক্রিয়াকলাপ বাড়ানো উচিত।
দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে জান্তা মিয়ানমার রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য জান্তাকে চাপ দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বৃহৎ শক্তিগুলো তেমন কিছু করেনি। জান্তার আগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে গণতান্ত্রিক সরকারকে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়েছিল।
এই মুহূর্তে, জান্তা আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতায় রয়েছে, যদিও এটি দেশে একটি গুরুতর বৈধতা সংকট এবং প্রতিরোধের মুখোমুখি। তবে মিয়ানমারে এটিই একমাত্র আনুষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ ছয় বছর ধরে দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপক্ষীয় ও বহুপাক্ষিকভাবে একটি কার্যকর সমাধানের চেষ্টা করেছে। তা কোনো প্রচেষ্টা ছাড়েনি, তবুও কিছুই খুঁজে পায়নি।
এখন যেহেতু চীন জাতিসংঘের অনুমোদন নিয়ে এই চুক্তির মধ্যস্থতা করছে, তাই বাংলাদেশ আগ্রহের সাথে এই উদ্যোগটি অনুসন্ধান করতে চায় কারণ কিছুই না হওয়ার চেয়ে ভাল কিছু হওয়া। উপরন্তু, বাংলাদেশ জান্তা প্রশ্নে উদাসীন থাকতে পারে না। দ্বিপাক্ষিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক ইস্যুর কারণে বাংলাদেশকে মিয়ানমারের কর্তৃত্ব অর্থাৎ বর্তমানে জান্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হয়।
বিশ্বমঞ্চে রোহিঙ্গাদের অভিভাবক বাংলাদেশ যখন রোহিঙ্গাদের তাদের জন্মভূমিতে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তখন এনজিওগুলো আমাদের সময়ের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর জন্য যথেষ্ট কাজ করছে না। তাই চীনের সম্পৃক্ততা এবং জান্তার সদিচ্ছাকে বাংলাদেশের জন্য বোঝা ভাগাভাগি হিসেবে দেখা যেতে পারে।
যারা ছয় বছরে কোনো ফলাফল দেখতে পায়নি, তারা বিকল্পটি অনুসন্ধান করা ছাড়া আর কিছু করতে পারে না। তহবিল হ্রাস, শিবিরের অবস্থার অবনতি, ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতা এবং আয়োজক সম্প্রদায়ের উপর শরণার্থীদের বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশকে বোঝা কমাতে মরিয়া হোস্টে পরিণত করেছে, যেখানে এর আন্তর্জাতিক অংশীদাররা কেবল একটি নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে তাদের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন করছে। তবে কিছু বিষয়ও সমাধান করা উচিত—
১) রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অবশ্যই নিরাপদ, ক্রমাগত, মর্যাদাপূর্ণ এবং টেকসই হতে হবে, যা মিয়ানমারকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।
২) মিয়ানমারের উচিত ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করা। রোহিঙ্গাদের অবশ্যই মিয়ানমারের বৈধ জাতিগত গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
৩) রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ এলাকা নিশ্চিত করতে হবে।
৪) কফি আনান কমিশনের (রাখাইন রাজ্য বিষয়ক উপদেষ্টা কমিশন) প্রয়োজনীয়তা বা প্রস্তাব এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৪, ৭৫ ও ৭৬তম অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবগুলো অবশ্যই পূরণ করতে হবে।
৫) তবে বিশ্লেষকরা বাংলাদেশকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন, যদি মিয়ানমার এখন ৭০০ জন ফেরত নিতে চায়। তাদের কথা পালন করতে হবে। মিয়ানমারকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে তারা বাংলাদেশে আটকে পড়া সব রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফিরিয়ে নেবে।
৬) তাদের অবশ্যই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে যে প্রক্রিয়াটি একটি ক্রমাগত প্রক্রিয়া হবে। পর্যায়ক্রমে সব রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন করা হবে।
৭) মিয়ানমারকে অবশ্যই বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হিসেবে কাজ করতে হবে। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের পক্ষে তাদের প্রতিবেশী পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। মূলত মিয়ানমার ও বাংলাদেশকে অবশ্যই প্রতিবেশী চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমার ও বাংলাদেশকে অবশ্যই তাদের সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এই আঞ্চলিক মানবিক সংকট সমাধানে উপকৃত হতে পারে।
৮) বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচকভাবে সম্পৃক্ত হতে মিয়ানমারের সদিচ্ছা থাকতে হবে। বিশ্ব রোহিঙ্গা সংকটের একটি ফলপ্রসূ ও টেকসই সমাধান দেখতে চায়। বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান অপরিহার্য হবে।
তবে মিয়ানমারের প্রস্তাবিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া অবশ্যই সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে, ক্রমাগত, টেকসই হতে হবে।
প্রিন্ট