নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যথাসময়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য রাশিয়ার দেওয়া ঋণ পরিশোধে ইন্টার গভর্নমেন্টাল ক্রেডিট এগ্রিমেন্ট (আইজিসিএ) বা আন্তঃসরকার ঋণচুক্তি সংশোধনে সম্প্রতি রাজি হয়েছে ঢাকা ও মস্কো। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
দেশের ইতিহাসে এককভাবে সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটি বাস্তবায়নে আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা করছে রাশিয়া। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রোসাটমসহ মস্কোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের নানা নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রকল্পটি যথাসময়ে বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র জানায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে নিষেধাজ্ঞার কারণে ঋণ পরিশোধে জটিলতা তৈরি হয়। এ জটিলতা কাটাতে গত ১৫ মার্চ অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-রাশিয়া আন্তঃসরকার কমিশন (বিআর-আইজিসি) বৈঠকে এই ঋণচুক্তি সংশোধনে দুই দেশ একমত হয়। বৈঠকে আইজিসিএর আওতায় একটি আলাদা জয়েন্ট কো-অর্ডিনেশন কমিটি (জেসিসি) গঠনের বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়। জেসিসি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ দেখভাল করবে। সেই সঙ্গে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণের অর্থের ব্যবহার সংক্রান্ত সমস্যা নিরসন করবে। এ ছাড়া দু’পক্ষই আইজিসিএ সংশোধনের বিষয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে রাশিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করতে একমত হয়েছে। যা থেকে নিরাপদ এবং বিকল্প উপায়ে অঙ্গীকারকৃত (কমিটমেন্ট ফি) রাশিয়ার ঋণ বাংলাদেশ পরিশোধ করতে পারবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, ১০ থেকে ১৩ এপ্রিল ঢাকা ও মস্কোর মধ্যে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ঋণ পরিশোধের নিরাপদ উপায় নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে চীনা মুদ্রায় এ ঋণ পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এড়াতেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যেই ১২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র রোসাটমের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। আর রূপপুরের ঋণ পরিশোধ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার আহ্বান জানায় ওয়াশিংটন।
তবে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি ঢাকা। মূলত নিষেধাজ্ঞায় ডলারের ওপর বিশ্বের অনেক দেশের নির্ভরতা কমতে থাকায় যুক্তরাষ্ট্র বিকল্প উপায় খুঁজে দিতে চাচ্ছে।
রাশিয়ার ঋণ
পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে নির্মিত ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রর জন্য দুই দফায় রাশিয়া থেকে ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। প্রথম দফায় ২০১৩ সালে ৫০ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে প্রকল্পের বিস্তারিত সমীক্ষাসহ প্রাথমিক কাজ করা হয়। এই ঋণের সুদ পরিশোধ শুরু হয় ২০১৮ থেকে। ২০১৬ সালে ঋণচুক্তির আওতায় মস্কো ঢাকাকে ৪ শতাংশ সুদে ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলার (মোট ব্যয়ের ৯০ শতাংশ) ঋণ দিচ্ছে। এ ঋণের সুদ শোধ দিতে হবে ২০২৪ সাল থেকে, আর ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে ২০২৭ সাল থেকে। ২৮ বছরের মধ্যে এই ঋণ শোধ করতে হবে।
ঋণচুক্তির দফা ২-এর অনুচ্ছেদ ৫ এ বলা হয়েছে, প্রত্যেক বছরের শুরুর অন্তত ছয় মাস আগে বাংলাদেশ ও রাশিয়া নতুন বছরে রূপপুরে কত ব্যয় হবে তা নির্ধারণ করবে। যদি নির্ধারিত অর্থ ব্যয় না হয়, তাহলে ০.৫ শতাংশ হারে কমিটমেন্ট ফি দিতে হবে। ইআরডির তথ্য বলছে, ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রূপপুর প্রকল্পে ৮৪১ কোটি ডলার ব্যয়ের কথা থাকলেও খরচ হয়েছে ৫৪৬ কোটি ডলার (৬৫ শতাংশ)। যেহেতু পুরো অর্থ ব্যয় হয়নি তাই চুক্তি অনুসারে ২০২১ সাল পর্যন্ত কমিটমেন্ট ফি হিসেবে প্রায় ৭৮ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে রাশিয়া।
রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেনে জটিলতা
রাশিয়াকে ঋণের অর্থ ডলারেই পরিশোধ করা হয়। ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার কারণে গত বছর মার্চে মস্কোর সঙ্গে ঢাকার লেনদেন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালের কমিটমেন্ট ফি প্রায় ১০৫ কোটি টাকা যা এখনও পরিশোধ করা হয়নি। এ ছাড়া প্রথম দফা ঋণের ৩১ কোটি ৮০ লাখ ডলারের কিস্তি মুলতবি রয়েছে। জটিলতা নিরসনে মস্কো ডলারের পরিবর্তে তাদের মুদ্রা রুবলে ঋণের কিস্তি শোধ করতে বলে। কিন্তু ঢাকা নানা অনিশ্চতায় এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। পরে ১৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বিআর-আইজিসি চীনা মুদ্রা ইউয়ানে ঋণের কিস্তি পরিশোধের বিষয়ে সম্মত হয় দুই দেশ। আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, চীনের একটি ব্যাংকের মাধ্যমে কিস্তি পরিশোধ করবে বাংলাদেশ। আর চীনের ক্রস-বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেমের (সিআইপিএস) মাধ্যমে মস্কো অর্থ বুঝে নেবে। ওই আলোচনায় কমিটমেন্ট ফি কমানোর বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়।
মস্কোর সঙ্গে ঢাকার তৃতীয় দেশের মাধ্যমে লেনদেনও যুক্তরাষ্ট্রের বাধার মুখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ বিভাগ ১২ এপ্রিল রাশিয়ার জ্বালানি খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রোসাটমের কয়েকটি সহযোগী সংস্থাসহ মোট ৮০টি প্রতিষ্ঠানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এই নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস ১৩ এপ্রিল এক কূটনৈতিক পত্রে (নোট ভারবাল) তৃতীয় দেশের মাধ্যমে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের টাকা লেনদেনের বিষয়ে সরাসরি আপত্তি না জানালেও রূপপুরের অর্থ পরিশোধের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজের অগ্রগতি ৭০ শতাংশের বেশি। ২০২৪ সালের শেষ দিকে উৎপাদনে আসতে পারে প্রথম ইউনিট। দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৫ সলে।
প্রিন্ট