আজ ৮ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, মিরপুর ও দৌলতপুর উপজেলা হানাদার মুক্ত দিবস। দীর্ঘ টানা ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রামের পর এই দিনে হানাদার মুক্ত হয় ঐ তিন উপজেলায়। ১৯৭১ সালের এ দিনে বহু ত্যাগের বিনিময়ে কুষ্টিয়ার ৩টি থানা শত্রুমুক্ত করে ৮ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন।এ দিনটি পাকহানাদার মুক্ত দিবস হিসেবে ৩টি থানায় ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়।
প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক সংগঠক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ ঘটনার বর্ণনায় বলেন, ‘আমরা তখন বাঘইল গ্রামে পাকশী পেপার মিল ব্যাগাজ ইয়ার্ডের কাছে অবস্থান নিয়েছিলাম । দুপুর ১২টার দিকে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর বিমান অনেকক্ষণ আকাশে মহড়া দিচ্ছিল।
প্রথমে পরপর তিনটি এবং কিছুক্ষণ পর আরেকটি বিমান থেকে বোমা বিস্ফোরণের প্রচন্ড শব্দ পাওয়া যায়। শব্দে মাটি কেঁপে ওঠে। শব্দের পর চরের প্রচন্ড ধুলা ও ধোঁয়া এলাকায় ছড়িয়ে যায়। পরে আমরা গিয়ে দেখি ব্রিজের ১২ নম্বর স্প্যানের পশ্চিম ভাগের অংশ পানির নিচে পড়ে আছে। সেদিন আরেকটি বোমা ফেলা হয়েছিল পাকশী রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রায় ৫০ গজ দূরে ব্রিজের পশ্চিমে বালুচরের মধ্যে। আরেকটি বোমা পড়েছিল রেললাইনের ওপর। বিমান থেকে ফেলা একটি বোমা বালুর ওপর পড়ায় সেটি বিস্ফোরিত হয়নি। পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বালুর ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সেই বোমার খোলসটি পাকশী রেলওয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থাপকের কার্যালয়ের সামনে সংরক্ষণ করে রাখা হয়।
পাকিস্তানি সেনাদের ফেলে যাওয়া একটি ট্যাংক সে সময় ব্রিজের ওপর পড়ে ছিল। ব্রিজ ভেঙে যাওয়ার কারণে পাকিস্তানি সেনারা সেটি পার করতে পারেনি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উত্তর-দক্ষিণবঙ্গের সাথে পাকহানাদার বাহিনীর রেলওয়ে যোগাযোগ বন্ধ করতে ভারতীয় মিত্রবাহীনির একটি বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করা হয়। বোমার আঘাতে ধ্বংস হয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের স্প্যানের একটি অংশ। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর। কুষ্টিয়া-ভেড়ামারা এবং পাবনার পাকশী এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ছিল। পাক হানাদার বাহিনী এই খবর জানার পর তাদের সমর শক্তি বৃদ্ধি করতে রেলওয়ে ব্রিজ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিলে তৎকালীন ইপিআর এর ওয়ারলেস থেকে বিষয়টি অবহিত করা হয় বলে জানা যায়। এই খবর পাওয়ার পর মিত্র বাহিনীর একটি যুদ্ধ বিমান থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর বোমা নিক্ষেপ করা হলে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১২ নম্বর স্প্যান ভেঙ্গে পড়ে। যোগাযোগ বিচ্ছন্ন হয়ে যায়। রণকৌশলে মুক্তিযোদ্ধারা আরও এগিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদশীরা বলেন, বোমা আঘাতে ১২ নম্বর গাডার স্প্যানটি ভেঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল। দেশ স্বাধীনের পরে ভারত সরকারের সহযোগিতায় প্রথম হার্ডিঞ্জ ব্রিজের স্প্যান নির্মিত হয়।
এ্যাডঃ আলম জাকারিয়া টিপু,বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা ভেড়ামারা উপজেলার সাবেক কমান্ড বলেন, ১৯৭১ সালের এই দিনেই পাকহানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে মিত্র বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধা কুষ্টিয়ার ভেড়ামারাকে শত্রæ মুক্ত করা হয়। এই দিন ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর আবুল মঞ্জুর নেতৃত্বে জেলা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা রাশেদুল আলমের নেতৃত্বে ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে ভোর ৭টার সময় ভেড়ামারা ফারাকপুর রেলগেটের সন্নীকটে পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। প্রায় ৭ ঘণ্টাব্যাপী এ যুদ্ধে প্রায় ৯জন পাকসেনা নিহত হয়। এই ঘটনার পর ঐদিন তারা সন্ধ্যার আগেই ভেড়ামারা থেকে ভয়ে পালিয়ে যায়। ৮ই ডিসেম্বর মুক্তিপাগল মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে ভেড়ামারায় প্রবেশ করতে থাকেন। পরে বিভিন্ন বয়সের হাজারও নারী-পুরুষ রাস্তায় নেমে ব্যাপক আনন্দ উল্লাস করতে থাকে দিনভর।
বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা মিরপুর উপজেলার সাবেক কমান্ড বলেন,শহীদ সিপাহী মহিউদ্দিনের কবরের পাশে মিরপুর উপজেলার শহীদ স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। ৮ ডিসেম্বর ভোরেই ৯ এর গ্রুপ কমান্ডার আফতাব উদ্দিন খান ১শ ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মিরপুর থানায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা গান স্যালুটের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়। এর পর ৬৫ জন পাকহানাদার বাহিনীর দোসর ও রাজাকার পাহাড়পুর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে আত্মসমর্পন করে। মিরপুর হানাদার মুক্ত হওয়ার সংবাদ এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে ১৯৭১ সালের এই দিনে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ রাস্তায় নেমে আনন্দ শুরু করতে থাকে।
হায়দার আলী বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা দৌলতপুর উপজেলা সাবেক সহকারী কমান্ড বলেন,৮ ডিসেম্বর একই দিনে দৌলতপুর হানাদার মুক্ত হয়। ১৯৭১ সালের এই দিনে দৌলতপুরকে শত্রæমুক্ত করে থানা চত্বরে বিজয় পতাকা উড়ানোর মধ্য দিয়ে মুক্তিকামী বীর সূর্য সন্তানেরা দৌলতপুরকে হানাদার মুক্ত করেন।
দৌলতপুরকে হানাদার মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনাদের সম্মুখ যুদ্ধসহ ছোট-বড় প্রায় ১৬টি যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। যুদ্ধে ৩৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ কয়েকশ নারী-পুরুষ শহীদ হন। সবচেয়ে বড় যুদ্ধ সংঘঠিত হয় উপজেলার ধর্মদহ ব্যাংগাড়ী মাঠে। এ যুদ্ধে প্রায় সাড়ে ৩শ পাকসেনা নিহত হয়। শহীদ হন তিনজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তিনজন ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সদস্য। ৮ ডিসেম্বর সকালে আল্লারদর্গায় পাক সেনারা দৌলতপুর ত্যাগ করার সময় তাদের গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা রফিক শহীদ হয়। এরপর দৌলতপুর হানাদার মুক্ত ঘোষণা করেন তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মেজর নুরুন্নবী। দিবসটি পালন উপলক্ষে সকল উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড র্যালি, মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
প্রিন্ট