ঢাকা , শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
Logo সোনামসজিদ স্থলবন্দরে হিট স্ট্রোকে ট্রাফিক পরিদর্শকের মৃত্যু Logo দৌলতপুরে নারী চিকিৎসককে হয়রানি করে কারাগারে যুবক Logo নাটোরের বাগাতিপাড়া বাউয়েট এর নতুন রেজিস্ট্রার শেখ সানি মোহাম্মদ তালহা Logo বঙ্গোপসাগরে ১২ নাবিক নিয়ে কার্গো জাহাজডুবি Logo দ্বীপ হাতিয়ায় সৈকতে ভেসে এসেছে বিরল প্রজাতির ‘ইয়েলো-বেলিড সি স্নেক’ Logo কালুখালীতে চেয়ারম্যান প্রার্থী এনায়েত হোসেনের উঠান বৈঠক Logo গোমস্তাপুরে বৃষ্টির আশায় ইসতিসকার নামাজ আদায় Logo লালপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দোয়া প্রার্থী মোঃ শামীম আহম্মেদ সাগর Logo ফরিদপুরে বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার নামাজ আদায় Logo বোয়ালমারীতে স্বস্তির বৃষ্টি প্রার্থনায় ইসতিসকার নামাজ আদায়
প্রতিনিধি নিয়োগ
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা পত্রিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আপনি আপনার এলাকায় সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন।

মাগুরায় মাজেদ বাহিনীর ২৭ জন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে ঐতিহাসিক কামান্না দিবস

১৯৭১ সালে ২৬ নভেম্বর পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে মাগুরা সদর থানা সম্মিলিত গণবাহিনী মাজেদ বাহিনীর ২৭ জন চৌকস বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

মাগুরা সদর থানা সম্মিলিত গণবাহিনী মাজেদ বাহিনী পরিচালনা করতেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা খোন্দকার আব্দুল মাজেদ।

মাজেদ বাহিনীর সহ-অধিনায়ক ছিলেন খোন্দকার আব্দুল মাজেদ এর আপন ভাগিনা বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আবু ইউসুফ  ও সহযোগী ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল্লাহ ভিকু। এই বাহিনীর কামান্না অংশের দলটির কমান্ডার ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার মেজর মোঃ শমসের আলী  ও ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু বক্কার ।

কামানা যুদ্ধে খোন্দকার আবুল মাজেদ এর বড় পুত্র খোন্দাকার রাশেদ আলী, মামাতো ভাই সেলিম বিশ্বাস, ভাগ্নি জামাই মোঃ শহীদুল ইসলাম শহীদ হয়।

কামান্না যুদ্ধের সেই ২৭ শহীদের কথা জাহিদ রহমান ২০১২ সালে আমার লেখা মুক্তিযুদ্ধে কামান্নার ২৭ শহীদ বইটি প্রকাশিত হয়। আমি বলবো এটি কামান্না যুদ্ধের অনুসন্ধানী এক প্রামাণ্যচিত্র। মাগুরা, ঝিনেদার অনেক গ্রাম ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে এই বইটি রচনা করি।

২৬ নভেম্বর এলেই মাগুরাতে এক বেদনাবিধূর পরিবেশ তৈরি হয়। একাত্তরের এই দিনে তৎকালীন ঝিনাইদহ মহকুমার শৈলকূপা থানার কামান্না গ্রামে পাক হানাদারদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা হাজীপুর বাহিনী এবং বিভিন্ন গেরিলা দলের ২৭জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মাত্র দুজন ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের সবার বাড়িই ছিল মাগুরা মহকুমার বিভিন্ন গ্রামে। এর মধ্যে আবার মাগুরা সদর থানার হাজীপুর ইউনিয়নের গ্রামেই ছিল বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি। স্বভাবতই ২৬ নভেম্বর হলেই বড় বেশি শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে হাজীপুর, শ্রীমস্তপুর, আলীধানী, হৃদয়পুর,  আরালিয়া, মীর্জাপুর, শিবরামপুর গ্রামের স্বজন হারানো পরিবারগুলো। এই দিনটিতে সন্তান হারানো মায়েরা এখনও চোখের জলে বুক ভাসান। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা এসএম রহমান, সামাদ, আতিয়ার, জলিল, ওসমান, সালাম, আবুলসহ ১২-১৫ জন যোদ্ধা খানিকটা অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। মূল অবস্থানে না থাকায় দলের নেতৃত্বে থাকা হাবিলদার মেজর শমসের আলীও বেঁচে যান। উল্লেখ্য কামান্না গ্রামের জনৈক মাধব চন্দ্র ভৌমিকের দ্বিতল টিনের বাড়িতে অস্থায়ী ক্যাম্প করেছিল মুক্তিযোদ্ধারা।

কামান্না যুদ্ধে যে ২৭ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তাঁরা হলেন- ০১। শহীদ আব্দুল মোমিন উদ্দীন (ফুলবাড়ি, হাজীপুর, মাগুরা), ০২। শহীদ মোঃ কাদের বিশ্বাস (মোর্তোজাপুর, শ্রীপুর, মাগুরা), ০৩। শহীদ মোঃ শহীদুল ইসলাম (পশ্চিম বেরেইলা, হাজীপুর,মাগুরা), ০৪। শহীদ মোঃ ওয়াহিদুজ্জামান (ফুলবাড়ি, হাজীপুর মাগুরা), ০৫। শহীদ রিয়াত মন্ডল (আলীধানী, মাগুরা সদর), ০৬। শহীদ আব্দুল মোতালেব (ইছাখাদা, মাগুরা), ০৭। শহীদ আলী হোসেন (আরালিয়া, হাজীপুর, মাগুরা), ০৮। শহীদ শরিফুল ইসলাম (কালালক্ষীপুর, ঝিনেদা), ০৯। শহীদ মুন্সী আলীমুজ্জামান ওরফে আরিফ মুন্সী (বিষ্ণুপুর, মাগুরা), ১০। শহীদ মোঃ গোলাম কওসার মোল্লা (মির্জাপুর, হাজীপুর, মাগুরা), ১১। শহীদ মনিরুজ্জামান খান ওরফে মনি খাঁ (হ্নদয়পুর, মাগুরা), ১২। শহীদ সেলিম ওরফে কেটে (শিবরামপুর, মাগুরা), ১৩। শহীদ হোসেন আলী (শ্রীমন্তপুর, মাগুরা), ১৪। শহীদ খোন্দকার রাশেদ আলী (শিবরামপুর, মাগুরা), ১৫। শহীদ গোলজার খাঁ (মালিগ্রাম, মাগুরা), ১৬। শহীদ আনিসুর রহমান (আরিয়াকান্দি, হাজীপুর, মাগুরা), ১৭। শহীদ অধীর কুমার শিকদার (হাজীপুর, মাগুরা), ১৮। শহীদ তাজুল ইসলাম তাজু (পারনান্দুয়ালী ব্যাপারীপাড়া, মাগুরা), ১৯। শহীদ গৌরচন্দ্র রায় (হাজীপুর, মাগুরা), ২০। শহীদ আলমগীর (হাজীপুর, মাগুরা), ২১। শহীদ আব্দুর রাজ্জাক রাজা (দাইরপুল, শ্রীপুর, মাগুরা), ২২। শহীদ আকবর (অজ্ঞাত), ২৩। শহীদ সালেক মোল্লা (দ্বারিয়াপুর, শ্রীপুর, মাগুরা), ২৪। শহীদ সলেমান শিকদার (নরসিংহাটি, মঘি, মাগুরা), ২৫। শহীদ মাছিম মিয়া (হ্নদয়পুর, হাজীপুর, মাগুরা), ২৬। শহীদ মুন্সী আব্দুর রাজ্জাক (হাজীপুর, মাগুরা), ২৭। শহীদ নিখিল কুমার মন্ডল (বাগডাঙ্গা, মাগুরা)। উল্লিখিতদের মধ্যে শহীদ শরীফুলের বাড়ি ঝিনাইদহে হলেও তিনি শ্রীমন্তপুরে শ্বশুরবাড়িতে এসে স্থানীয় হাজীপুর বাহিনীতে যোগ দেন। এই যুদ্ধে তাঁর স্ত্রীর আপন ভাই শ্রীমন্তপুরের হোসেন আলীও শহীদ হন।

একাত্তরে হাজীপুর বাহিনী গড়ে উঠেছিল মূলত হাজীপুর গ্রামকে ঘিরেই। বীর মুক্তিযোদ্ধার খোন্দকার আব্দুল মাজেদ এই বাহিনী পরিচালনা করতেন। ২৬ নভেম্বরের আগে হাজীপুর এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে নিরাপদ স্থান চিহ্নিত করে ৪০-৪২ জনের মুক্তিযোদ্ধা দলটি (আঞ্চলিক বাহিনীর সদস্য এবং এফএফ) কুমার নদের পাড়ে কামান্না গ্রামে এসে মাধব চন্দ্র ভৌমিকের বাড়িতে অস্থায়ী ক্যাম্প গড়ে তোলে। দলের মূল নেতৃত্বে থাকেন হাবিলদার মেজর শমসের আলী। এদিকে কামান্নাতে মুক্তিযোদ্ধা দলটির অবস্থানের কথা পাকহানাদারদের কাছে ফাঁস করে দেয় রাজাকাররা। অতঃপর পাকহানাদারদের একটি বিরাট দল ২৬ নভেম্বর ভোররাতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের উপর অতর্কিত হামলা করে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা অধীর, আলী হোসেন, মণি খাঁ, মোতালেব এবং বেঁচে থাকাদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা এমএ সামাদ, এসএম রহমান, সমেশ চন্দ্র দে, আব্দুল জলিল দ্রুতই পাল্টা গুলি ছুঁড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালান। কেউ কেউ অস্ত্র নিয়ে বের হয়ে এসে বিভিন্ন গাছের গোড়ায় শেল্টার নিয়ে প্রতিরোধ করতে থাকেন। কিন্তু দোতলা টিনের ঘরে বেশিরভাগ যোদ্ধা আটকে পড়ায় প্রতিরোধ গড়ে তোলাটা দুরূহ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় রণাঙ্গন পুরো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় পাক হানাদাররা। ক্যাম্পের মূল অবস্থানেই ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনীর নির্মম হত্যার শিকার হন। পরের দিন মারা যান গুরুতর আহত আব্দুর রাজ্জাক রাজা। তাকে শ্রীপুর দাইরপোলে নিজ বাড়িতে দাফন করা হয়।

এদিকে এই হত্যাকান্ড সমাপ্ত করে ভোরেই পাকবাহিনী জায়গা ছেড়ে চলে যায়। পরে এই নির্মম হত্যাকান্ডের খবর পেয়ে চারপাশের গ্রাম থেকে ময়মরুব্বি এবং সাধারণ মানুষ ছুটে আসে। ভয়ার্ত গ্রামবাসী লাশগুলো উদ্ধার করে সন্ধ্যার দিকে জানাজা এবং দাফনের ব্যবস্থা করেন। কামান্না হাইস্কুলের পাশেই তিনটি গণকবরে শহীদ যোদ্ধাদের শায়িত করা হয়।

কামান্নার যুদ্ধে যে সাতাশ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তাদের বেশিরভাগই ছিলেন সাধারণ দরিদ্র পরিবারের সন্তান। আবার পাশাপাশি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় সবাই একে অপরের আত্মীয়-বন্ধু অথবা পরিচিতও ছিলেন। বেশিরভাগ যোদ্ধাই ছিলেন অবিবাহিত। মুক্তিযুদ্ধে মাগুরার এই সাতাশ তরুণ মুক্তিযোদ্ধা এক সঙ্গে জীবন দান করলেও তাদের আত্মতাগের মোটেও যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। কামান্নার রণাঙ্গনে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই ছিলেন সংসারের বড় ছেলে। অনেকেই পুলিশ, ইপিআর, আনসারে চাকরি করতেন। বড় সন্তান শহীদ হওয়ায় অনেক শোকার্ত পরিবারই আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। সেই সব পরিবারগুলোর মধ্যে অনেক পরিবার এখনও এতোটাই অভাব অনটনের মধ্যে পতিত যে তা স্বচক্ষে না দেখলে কারো বিশ্বাস হবে না। মির্জাপুরের শহীদ কাওসার, হৃদয়পুরের শহীদ মাছিম মিয়া, নরসিংহহাটির শহীদ সলেমান, শ্রীমন্তপুরের শহীদ মুনিরুজ্জামান ওরফে মণি খাঁ, ফুলবাড়ীর ওয়াহিদুজ্জামান, শিবরামপুরের শহীদ সেলিম. পারনান্দুয়ালীর শহীদ তাজুল, হাজীপুরের শহীদ গৌরের উত্তরসূরিরা কেউই সেই অর্থে সরকারি সহযোগিতা পাননি। এ নিয়ে শহীদ পরিবারগুলোর মাঝে বিস্তর ক্ষোভ রয়েছে। ক্ষোভের আরও কারণ রয়েছে। এই সাহসী সন্তানদের নাম সেভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় উঠে না আসায় মাগুরাবাসীর অনেকেই তাদের নাম সেভাবে জানে না। মাগুরা জেলা সদরে এই সাতাশ শহীদের স্মরণে দৃশ্যমান কিছু করা হয়নি। আজও তাই কামান্নার বিরোচিত ২৭ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মাগুরার নতুন প্রজন্মের কাছে এক অজানা অধ্যায়।

Tag :
এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

সোনামসজিদ স্থলবন্দরে হিট স্ট্রোকে ট্রাফিক পরিদর্শকের মৃত্যু

error: Content is protected !!

মাগুরায় মাজেদ বাহিনীর ২৭ জন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে ঐতিহাসিক কামান্না দিবস

আপডেট টাইম : ১০:০৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২২

১৯৭১ সালে ২৬ নভেম্বর পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে মাগুরা সদর থানা সম্মিলিত গণবাহিনী মাজেদ বাহিনীর ২৭ জন চৌকস বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

মাগুরা সদর থানা সম্মিলিত গণবাহিনী মাজেদ বাহিনী পরিচালনা করতেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা খোন্দকার আব্দুল মাজেদ।

মাজেদ বাহিনীর সহ-অধিনায়ক ছিলেন খোন্দকার আব্দুল মাজেদ এর আপন ভাগিনা বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আবু ইউসুফ  ও সহযোগী ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল্লাহ ভিকু। এই বাহিনীর কামান্না অংশের দলটির কমান্ডার ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার মেজর মোঃ শমসের আলী  ও ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু বক্কার ।

কামানা যুদ্ধে খোন্দকার আবুল মাজেদ এর বড় পুত্র খোন্দাকার রাশেদ আলী, মামাতো ভাই সেলিম বিশ্বাস, ভাগ্নি জামাই মোঃ শহীদুল ইসলাম শহীদ হয়।

কামান্না যুদ্ধের সেই ২৭ শহীদের কথা জাহিদ রহমান ২০১২ সালে আমার লেখা মুক্তিযুদ্ধে কামান্নার ২৭ শহীদ বইটি প্রকাশিত হয়। আমি বলবো এটি কামান্না যুদ্ধের অনুসন্ধানী এক প্রামাণ্যচিত্র। মাগুরা, ঝিনেদার অনেক গ্রাম ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে এই বইটি রচনা করি।

২৬ নভেম্বর এলেই মাগুরাতে এক বেদনাবিধূর পরিবেশ তৈরি হয়। একাত্তরের এই দিনে তৎকালীন ঝিনাইদহ মহকুমার শৈলকূপা থানার কামান্না গ্রামে পাক হানাদারদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা হাজীপুর বাহিনী এবং বিভিন্ন গেরিলা দলের ২৭জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মাত্র দুজন ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের সবার বাড়িই ছিল মাগুরা মহকুমার বিভিন্ন গ্রামে। এর মধ্যে আবার মাগুরা সদর থানার হাজীপুর ইউনিয়নের গ্রামেই ছিল বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি। স্বভাবতই ২৬ নভেম্বর হলেই বড় বেশি শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে হাজীপুর, শ্রীমস্তপুর, আলীধানী, হৃদয়পুর,  আরালিয়া, মীর্জাপুর, শিবরামপুর গ্রামের স্বজন হারানো পরিবারগুলো। এই দিনটিতে সন্তান হারানো মায়েরা এখনও চোখের জলে বুক ভাসান। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা এসএম রহমান, সামাদ, আতিয়ার, জলিল, ওসমান, সালাম, আবুলসহ ১২-১৫ জন যোদ্ধা খানিকটা অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। মূল অবস্থানে না থাকায় দলের নেতৃত্বে থাকা হাবিলদার মেজর শমসের আলীও বেঁচে যান। উল্লেখ্য কামান্না গ্রামের জনৈক মাধব চন্দ্র ভৌমিকের দ্বিতল টিনের বাড়িতে অস্থায়ী ক্যাম্প করেছিল মুক্তিযোদ্ধারা।

কামান্না যুদ্ধে যে ২৭ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তাঁরা হলেন- ০১। শহীদ আব্দুল মোমিন উদ্দীন (ফুলবাড়ি, হাজীপুর, মাগুরা), ০২। শহীদ মোঃ কাদের বিশ্বাস (মোর্তোজাপুর, শ্রীপুর, মাগুরা), ০৩। শহীদ মোঃ শহীদুল ইসলাম (পশ্চিম বেরেইলা, হাজীপুর,মাগুরা), ০৪। শহীদ মোঃ ওয়াহিদুজ্জামান (ফুলবাড়ি, হাজীপুর মাগুরা), ০৫। শহীদ রিয়াত মন্ডল (আলীধানী, মাগুরা সদর), ০৬। শহীদ আব্দুল মোতালেব (ইছাখাদা, মাগুরা), ০৭। শহীদ আলী হোসেন (আরালিয়া, হাজীপুর, মাগুরা), ০৮। শহীদ শরিফুল ইসলাম (কালালক্ষীপুর, ঝিনেদা), ০৯। শহীদ মুন্সী আলীমুজ্জামান ওরফে আরিফ মুন্সী (বিষ্ণুপুর, মাগুরা), ১০। শহীদ মোঃ গোলাম কওসার মোল্লা (মির্জাপুর, হাজীপুর, মাগুরা), ১১। শহীদ মনিরুজ্জামান খান ওরফে মনি খাঁ (হ্নদয়পুর, মাগুরা), ১২। শহীদ সেলিম ওরফে কেটে (শিবরামপুর, মাগুরা), ১৩। শহীদ হোসেন আলী (শ্রীমন্তপুর, মাগুরা), ১৪। শহীদ খোন্দকার রাশেদ আলী (শিবরামপুর, মাগুরা), ১৫। শহীদ গোলজার খাঁ (মালিগ্রাম, মাগুরা), ১৬। শহীদ আনিসুর রহমান (আরিয়াকান্দি, হাজীপুর, মাগুরা), ১৭। শহীদ অধীর কুমার শিকদার (হাজীপুর, মাগুরা), ১৮। শহীদ তাজুল ইসলাম তাজু (পারনান্দুয়ালী ব্যাপারীপাড়া, মাগুরা), ১৯। শহীদ গৌরচন্দ্র রায় (হাজীপুর, মাগুরা), ২০। শহীদ আলমগীর (হাজীপুর, মাগুরা), ২১। শহীদ আব্দুর রাজ্জাক রাজা (দাইরপুল, শ্রীপুর, মাগুরা), ২২। শহীদ আকবর (অজ্ঞাত), ২৩। শহীদ সালেক মোল্লা (দ্বারিয়াপুর, শ্রীপুর, মাগুরা), ২৪। শহীদ সলেমান শিকদার (নরসিংহাটি, মঘি, মাগুরা), ২৫। শহীদ মাছিম মিয়া (হ্নদয়পুর, হাজীপুর, মাগুরা), ২৬। শহীদ মুন্সী আব্দুর রাজ্জাক (হাজীপুর, মাগুরা), ২৭। শহীদ নিখিল কুমার মন্ডল (বাগডাঙ্গা, মাগুরা)। উল্লিখিতদের মধ্যে শহীদ শরীফুলের বাড়ি ঝিনাইদহে হলেও তিনি শ্রীমন্তপুরে শ্বশুরবাড়িতে এসে স্থানীয় হাজীপুর বাহিনীতে যোগ দেন। এই যুদ্ধে তাঁর স্ত্রীর আপন ভাই শ্রীমন্তপুরের হোসেন আলীও শহীদ হন।

একাত্তরে হাজীপুর বাহিনী গড়ে উঠেছিল মূলত হাজীপুর গ্রামকে ঘিরেই। বীর মুক্তিযোদ্ধার খোন্দকার আব্দুল মাজেদ এই বাহিনী পরিচালনা করতেন। ২৬ নভেম্বরের আগে হাজীপুর এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে নিরাপদ স্থান চিহ্নিত করে ৪০-৪২ জনের মুক্তিযোদ্ধা দলটি (আঞ্চলিক বাহিনীর সদস্য এবং এফএফ) কুমার নদের পাড়ে কামান্না গ্রামে এসে মাধব চন্দ্র ভৌমিকের বাড়িতে অস্থায়ী ক্যাম্প গড়ে তোলে। দলের মূল নেতৃত্বে থাকেন হাবিলদার মেজর শমসের আলী। এদিকে কামান্নাতে মুক্তিযোদ্ধা দলটির অবস্থানের কথা পাকহানাদারদের কাছে ফাঁস করে দেয় রাজাকাররা। অতঃপর পাকহানাদারদের একটি বিরাট দল ২৬ নভেম্বর ভোররাতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের উপর অতর্কিত হামলা করে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা অধীর, আলী হোসেন, মণি খাঁ, মোতালেব এবং বেঁচে থাকাদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা এমএ সামাদ, এসএম রহমান, সমেশ চন্দ্র দে, আব্দুল জলিল দ্রুতই পাল্টা গুলি ছুঁড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালান। কেউ কেউ অস্ত্র নিয়ে বের হয়ে এসে বিভিন্ন গাছের গোড়ায় শেল্টার নিয়ে প্রতিরোধ করতে থাকেন। কিন্তু দোতলা টিনের ঘরে বেশিরভাগ যোদ্ধা আটকে পড়ায় প্রতিরোধ গড়ে তোলাটা দুরূহ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় রণাঙ্গন পুরো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় পাক হানাদাররা। ক্যাম্পের মূল অবস্থানেই ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনীর নির্মম হত্যার শিকার হন। পরের দিন মারা যান গুরুতর আহত আব্দুর রাজ্জাক রাজা। তাকে শ্রীপুর দাইরপোলে নিজ বাড়িতে দাফন করা হয়।

এদিকে এই হত্যাকান্ড সমাপ্ত করে ভোরেই পাকবাহিনী জায়গা ছেড়ে চলে যায়। পরে এই নির্মম হত্যাকান্ডের খবর পেয়ে চারপাশের গ্রাম থেকে ময়মরুব্বি এবং সাধারণ মানুষ ছুটে আসে। ভয়ার্ত গ্রামবাসী লাশগুলো উদ্ধার করে সন্ধ্যার দিকে জানাজা এবং দাফনের ব্যবস্থা করেন। কামান্না হাইস্কুলের পাশেই তিনটি গণকবরে শহীদ যোদ্ধাদের শায়িত করা হয়।

কামান্নার যুদ্ধে যে সাতাশ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তাদের বেশিরভাগই ছিলেন সাধারণ দরিদ্র পরিবারের সন্তান। আবার পাশাপাশি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় সবাই একে অপরের আত্মীয়-বন্ধু অথবা পরিচিতও ছিলেন। বেশিরভাগ যোদ্ধাই ছিলেন অবিবাহিত। মুক্তিযুদ্ধে মাগুরার এই সাতাশ তরুণ মুক্তিযোদ্ধা এক সঙ্গে জীবন দান করলেও তাদের আত্মতাগের মোটেও যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। কামান্নার রণাঙ্গনে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই ছিলেন সংসারের বড় ছেলে। অনেকেই পুলিশ, ইপিআর, আনসারে চাকরি করতেন। বড় সন্তান শহীদ হওয়ায় অনেক শোকার্ত পরিবারই আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। সেই সব পরিবারগুলোর মধ্যে অনেক পরিবার এখনও এতোটাই অভাব অনটনের মধ্যে পতিত যে তা স্বচক্ষে না দেখলে কারো বিশ্বাস হবে না। মির্জাপুরের শহীদ কাওসার, হৃদয়পুরের শহীদ মাছিম মিয়া, নরসিংহহাটির শহীদ সলেমান, শ্রীমন্তপুরের শহীদ মুনিরুজ্জামান ওরফে মণি খাঁ, ফুলবাড়ীর ওয়াহিদুজ্জামান, শিবরামপুরের শহীদ সেলিম. পারনান্দুয়ালীর শহীদ তাজুল, হাজীপুরের শহীদ গৌরের উত্তরসূরিরা কেউই সেই অর্থে সরকারি সহযোগিতা পাননি। এ নিয়ে শহীদ পরিবারগুলোর মাঝে বিস্তর ক্ষোভ রয়েছে। ক্ষোভের আরও কারণ রয়েছে। এই সাহসী সন্তানদের নাম সেভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় উঠে না আসায় মাগুরাবাসীর অনেকেই তাদের নাম সেভাবে জানে না। মাগুরা জেলা সদরে এই সাতাশ শহীদের স্মরণে দৃশ্যমান কিছু করা হয়নি। আজও তাই কামান্নার বিরোচিত ২৭ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মাগুরার নতুন প্রজন্মের কাছে এক অজানা অধ্যায়।