আওয়ামী লীগের বিভাগীয় উপকমিটিগুলোর আকার আবারও বড় হচ্ছে। নির্দেশনা থাকলেও ঘোষিত কমিটিগুলোর একটিও ৩৫ সদস্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি। দু-একটিতে ৮০ উপরেও সদস্য রাখা হয়েছে। সবচেয়ে কম সদস্যের উপকমিটিও ৪০ জনের। এ ছাড়া আওয়ামী লীগে ‘এক নেতার এক পদ’ নীতি থাকলেও তাও মানা হয়নি।
উপকমিটিতে জেলা-উপজেলা বা সহযোগী সংগঠনে পদে আছেন-এমন নেতাদেরও সদস্য করা হয়েছে। এদিকে কমিটির আকার বড় হওয়ায় এতে আবারও ‘সাহেদদের’ মতো সুবিধাবাদীদের অনুপ্রবেশের শঙ্কা থেকে যায় বলে মনে করছেন দলের সংশ্লিষ্টরা। তবে আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বলছেন, দল ও সহযোগী সংগঠনের বঞ্চিত নেতাদের জায়গা দিতেই কমিটির আকার কিছুটা বাড়ানো হচ্ছে। এবার উপকমিটি গঠনের সময় বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকাতে তারা অনেক বেশি সতর্ক ছিলেন।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান শুক্রবার বিকালে গণমাধ্যমকে বলেন, সদস্য সংখ্যা বেশি হলে একটা সুবিধা আছে, অনেককে কাজে লাগানো যায়। উপকমিটিগুলো আরও ভালো কাজ করতে পারে। তবে এখানে সমস্যা হচ্ছে মনিটরিং কমে যায়। আমরা অতীতে দেখেছি সদস্য বাড়লে এমন এমন লোক ঢুকে পড়ে যাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সবার বদনাম হয়।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকটি উপকমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে ডিসেম্বরের শুরুতে প্রথম শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক উপকমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়। অধ্যাপক আব্দুল খালেককে চেয়ারম্যান ও শামসুন নাহার চাঁপাকে সদস্যসচিব করে কমিটিতে ৩৮ জনকে সদস্য করা হয়েছে। এরপর শিল্প ও বাণিজ্য, যুব ও ক্রীড়া, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বন ও পরিবেশ, মুক্তিযুদ্ধ, আইন, কৃষি ও সমবায়, মহিলা, সংস্কৃতি ও স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বন ও পরিবেশবিষয়ক উপকমিটি করা হয়েছে ৮২ সদস্যের আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপকমিটি ৭২ সদস্যের। অন্যগুলোর সদস্য সংখ্যাও ৫০ থেকে ৭০-এর মধ্যে। অন্যান্য উপকমিটিও অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এগুলোও ৩৫-এ সীমাবদ্ধ থাকছে না। এর মধ্যে একটি উপকমিটি শতাধিক সদস্যের হতে যাচ্ছে বলে দলীয় একটি সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপকমিটিতে সাবেক ছাত্রনেতা ও দলের সহযোগী সংগঠনের নেতাদের ঠাঁই দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছেন, দলীয় সংসদ সদস্য, বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরাও। তবে এক ব্যক্তিকে একাধিক কমিটিতে রাখা যাবে না-এমন নির্দেশনা মানা হয়নি অনেক ক্ষেত্রেই। আগে সহযোগী সংগঠনের আরও দুটি পদে আছেন এমন কাউকে কাউকেও উপকমিটিতে রাখা হয়েছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে দল বা সহযোগী সংগঠনের পদে আছেন এমন নেতাদেরও জায়গা দেওয়া হয়েছে উপকমিটিতে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপকমিটির সদস্যসচিব প্রকৌশলী মো. আবদুস সবুর শুক্রবার বিকালে গণমাধ্যমকে বলেন, আওয়ামী লীগ বড় সংগঠন। গত কমিটিতে অনেকে সফলভাবে কাজ করেছেন, তাদের বাদ দিলে অবিচার করা হয়। আবার বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ও দলীয় সংসদ সদস্যরা আছেন। সেখানে আবার দলের নেতাদেরও জায়গা দিতে হয়। এটা না দিতে পারলে অনেককে অবমূল্যায়ন করা হয়। ফলে উপকমিটিতে সদস্য সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে।
কমিটির আকার বাড়ায় সেখানে আবার সাহেদদের মতো ব্যক্তিদের অনুপ্রবেশের শঙ্কা থাকে কি না-জানতে চাইলে তিনি বলেন, এবার এ ব্যাপারে আমাদের দলের সম্পাদকরা এবং দলের কেন্দ্রীয় নেতারা সজাগ ও সতর্ক ছিলেন, যাতে সাহেদের মতো ব্যক্তিরা না আসতে পারে। তাই এবার আর আগের মতো ঘটনা ঘটবে না বলে বিশ্বাস রয়েছে।
একই বিষয়ে আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক এবং বন ও পরিবেশবিষয়ক উপকমিটির সদস্যসচিব দেলোয়ার হোসেন শুক্রবার সন্ধ্যায় গণমাধ্যমকে বলেন, উপকমিটির সদস্য সংখ্যা ৩৫ করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল; কিন্তু সিদ্ধান্ত হয়নি। আর উপকমিটি গঠনে গঠনতন্ত্রও লঙ্ঘন করা হয়নি। তিনি বলেন, কর্মীদের প্রতি আমাদের দায়বদ্ব¬তা আছে। ছাত্রলীগ-যুবলীগ থেকে ১০-২০ বছর কাজ করে যারা বের হয়, পদ-পরিচয় না থাকলে তারা কীভাবে কাজ করবেন? তাদের তো জায়গা দিতে হবে। আর যে সমস্যা আছে, উপকমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় যারা যুক্ত তারা সমন্বয় করে নিলে সেই সমস্যা থাকার কথা নয়।
সূত্র জানায়, ২০১২ সালে গঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন যে উপকমিটি হয়েছিল, তাতে প্রথমে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ৬৬ জনকে সহসম্পাদক করেছিলেন। এদের প্রায় সবাই ছাত্রলীগে গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন এবং বয়সের কারণে ছাত্ররাজনীতি ছাড়তে হয়েছে। তবে ২০১৩ সালের দিকে অনানুষ্ঠানিকভাবে আরও কয়েকশ সহসম্পাদক নিয়োগ করা হয়। তখন দলে একটা আলোচনা ছিল-আওয়ামী লীগে সহসম্পাদকের সংখ্যা কত, তা কেউ জানে না। এ নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে সমালোচনা ওঠে। সহসম্পাদক পদের নাম ভাঙিয়ে অপকর্মের সঙ্গে অনেকেই জড়িয়ে পড়েন। কোনো যাচাই-বাছাই না করে ঢালাওভাবে সহসম্পাদক করায় অনেক সুযোগসন্ধানী ও দুষ্কৃতকারী দলে ঢুকে পড়েন। এর ফলে অপকর্মকারীরা আরও সুযোগ নিতে থাকেন।
এসব বিষয় উপলব্ধি করে আওয়ামী লীগের বিগত কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে সহসম্পাদক পদ বাদ দেওয়া হয়। তবে উপকমিটি গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। এতে যারা থাকবেন, তাদের মধ্যে চেয়ারম্যান ও সদস্যসচিব ছাড়া প্রত্যেকে কমিটির সদস্য হবেন। তবে কত সদস্যের কমিটি হবে-সেটা নির্দিষ্ট করে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে বলা হয়নি। এরই মধ্যে গত বছর আওয়ামী লীগের এক উপকমিটির সদস্য ‘প্রতারক’ সাহেদকে নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। সেই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের উপকমিটিতে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে যায় দলটি। পরবর্তী সময়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে সম্পাদকমণ্ডলীর এক সভায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের উপকমিটির সদস্য ৩৫ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। অন্য কোনো সংগঠনের পদে আছেন এমন কাউকে উপকমিটিতে না রাখার পরামর্শও দিয়েছিলেন তিনি।
প্রিন্ট