আলিফ হোসেনঃ
রাজশাহীর তানোরে আলুর উৎপাদন খরচ উঠছে না। এক লিটার পানির দামে দুই কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে। রাজশাহীর তানোর উপজেলা দেশের আলু উৎপাদনে অন্যতম এলাকা হিসেবে পরিচিত।কিন্ত্ত এবার এখানে পানির থেকে কম দরে বিক্রি হচ্ছে আলু। এক লিটার পানির দাম ২৬ টাকা,আর এক কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ১৩ টাকায়। এতে উৎপাদন খরচও উঠছে না। দাম না পেয়ে চাষিদের পথে বসার উপক্রম। কৃষকরা বলছেন, এবার শ্রমিক মজুরী, বাড়তি সংরক্ষণ খরচ ছাড়াও আলু বীজ ও সারের চড়া দরের কারণে বেড়েছে দ্বিগুন উৎপাদন খরচ।
জানা গেছে, ভোক্তা পর্যায়ে আলুর দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা হলেও পাইকারি বাজারে ১৫ থেকে ১৬ টাকা কেজি। আর প্রান্তিক কৃষকরা বিক্রি করছেন ১২ থেকে ১৪ টাকায়।মঙ্গলবার ১২ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হয়েছে, যেখানে এক লিটার পানির দাম ২৬ টাকা। অথচ এবার সব মিলিয়ে প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ পড়েছে ২২ থেকে ২৫ টাকা। তাই পর্যাপ্ত দাম না পেয়ে লোকসানের আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন হাজারো কৃষক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বস্তাসহ এক বস্তা (৭০ কেজি) আলুর ভাড়া প্রতি কেজি ৬ টাকা হিসেবে ৪২০ টাকা। প্রতি বস্তাায় আলু ভালো পাওয়া যাচ্ছে ৫০ কেজি,নস্ট ২০ কেজি অথচ ভাড়া দিতে হচ্ছে ৭০ কেজির।এছাড়াও প্রতি বস্তায় সেড ভাড়া ৪৫ টাকা ও ১০০ বস্তা আলু বাছাই করতে শ্রমিক খরচ তিন হাজার টাকা। সব মিলিয়ে এক বস্তা আলু বিক্রি করে কৃষক পাচ্ছেন মাত্র ৬৫০ টাকা এর মধ্যে স্টোর ভাড়া ৪২০ টাকা, সেড ভাড়া ও শ্রমিকের মজুরি বাবদ খরচ হচ্ছে প্রায় ৪৮০ টাকা। অর্থাৎ এক বস্তা আলু বিক্রি করে কৃষক পাচ্ছেন মাত্র ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। এবার যেখানে এক বস্তা (৭০ কেজি) আলুর উৎপাদন খরচ গড়ে ১৭৫০ টাকা।ফলে প্রতি বস্তা আলুতে কৃষকের লোকসান প্রায় ১৬০০ টাকা বলে একাধিক সুত্র নিশ্চিত করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এবার প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ পড়েছে ২২ থেকে ২৫ টাকা। আবার, কৃষিপণ্যে সরকার থেকে মূল্য সহায়তার সুযোগ থাকলেও বাস্তবে এর বাস্তবায়ন নেই। এতে বেকায়দায় পড়ছেন কৃষকরা। ফলে তাদের ক্ষোভ বাড়ছে। তাদের দাবি, অবিলম্বে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা হোক।
তানোরে চলতি মৌসুমে সাত ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভায় লক্ষ্যমাত্রা ছাপিয়ে আলু আবাদ হয়েছিল ১৩ হাজার ৩৮৫ হেক্টর। আলু উৎপাদন হয় প্রায় ৪ লাখ ২৮ হাজার ৩৫০ টন। এর মধ্যে অন্তত ৩৮ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার ৩৭৫ টনের বেশি আলু তানোর উপজেলার সাতটি হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়েছিল।
এদিকে আলু চাষি রায়হান আলীর দেখাদেখি প্রথমবারের মতো আলু চাষ করেছিলেন বনকেশর গ্রামের মেজবাউল। তিনি বলেন, এবার নষ্ট আলুর পরিমাণও বেশি। আলুর গায়ে একটি দাগ থাকলেই সেটি নষ্ট হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। হিমাগারের মালিক এক কেজি আলু থেকে শ্রমিক খরচসহ পাচ্ছেন প্রায় ৭ টাকা। আর চাষির পকেটে আসছে মাত্র ৪ টাকা কয়েক পয়সা টাকা। এর চেয়ে পরিহাসের বিষয় আর কী হতে পারে!
তানোরের মেসার্স রহমান কোল্ড স্টোরেজের ব্যবসায়ী মাসুদ আলীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি দুই হাজার বস্তা আলু ১৪ থেকে ১৬ টাকা কেজি দরে কিনে হিমাগারে রেখেছেন। তিনি বলেন, তাঁদের কেজি প্রতি ৬ টাকা হিমাগার ভাড়া, একটি বস্তা ৮৫ টাকা ও গাড়িভাড়া ৫০ টাকা বাদ দিয়ে এখন সেই আলু ১৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। এ বছর আলুর দাম কম হওয়ায় আগামী বছরে এ অঞ্চলে আলুর আবাদ কম হবে বলে মনে করছেন তানোর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ আহম্মেদ। তিনি আরও বলেন, ‘চাহিদার তুলনায় উৎপাদন অনেক বেশি হওয়ায় দাম কমেছে। অনেকক্ষেত্রে উৎপাদিত আলুর মান, ভালো না হওয়ায় রপ্তানিও সম্ভব হচ্ছে না। রপ্তানি করা গেলে চাষিরা উপকৃত হতেন।
রাজশাহী হিমাগার মালিক সমিতির নেতা তাসনিম হোসেন নিলয় বলেন, আলু চাষিরা বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এবার আলুর দামের যে অবস্থা, তাতে আগামীতে কৃষকেরা আলু চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন, যা ভবিষ্যতে নতুন সংকট তৈরি করবে। আলুর অস্বাভাবিক দরপতন বিষয়ে তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লিয়াকাত সালমান বলেন, তানোর অন্যতম আলু উৎপাদনের এলাকা। দাম নিয়ে আলু চাষিদের দুঃখ-দুর্দশার কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে।
প্রিন্ট