নড়াইলে ১০ আগস্ট বিশ্ব বরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের ৯৭তম জন্মবার্ষিকী পালিত হবে। ১৯২৪ সালের এদিন তিনি নড়াইল মহাকুমার মাছিমদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এস এম সুলতান। তার পিতা মেছের আলী পেশায় ছিলেন একজন রাজ মিস্ত্রী । মাতা মাজু বিবি একজন গৃহিনী। বাবা মা আদর করে নাম রেখেছিলেন লাল মিয়া।
এসএম সুলতান ১৯২৮ সালে নড়াইল আশ্রম স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। পরে ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে আষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। স্কুলের অবসরে বাবাকে কাজে সহযোগিতার করার সময় ছবি আঁকতে শুরু করেন। ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে পড়াকালীন সময়ে ১৯৩৩ সালের কোন একদিন রাজনীতিক ও জমিদার শ্যামাপ্রাসাদ মুখোপাধ্যায় নড়াইলের জমিদার ব্যারিস্টার ধীরেন রায়ের আমন্ত্রণে ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল পরিদর্শনে গেলে তার একটি পোট্রেট আঁকেন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র এসএম সুলতান। মুগ্ধ হন শ্যামাপ্রাসাদ সহ অন্যরা। তারা তাকে কোলকাতায় আমন্ত্রন জানান। এরপর লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ১৯৩৮ সালে কলকাতায় গিয়ে ছবি আঁকা ও জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন।
সে সময় চিত্র সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে তার পরিচয় হয়। তিনি তাকে কোলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি করাতে গেলে বাধ সাধে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা। কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর সুপারিশে অ্যাকাডেমিক যোগ্যতা না থাকা সত্তে¡ও ১৯৪১ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তির সুযোগ পান সুলতান। নড়াইলের লাল কোলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হবার সময় থেকেই ডাক নাম ছেড়ে এস এম সুলতান নামে পরিচিত হতে থাকেন।
১৯৪৩ সালে আর্ট স্কুল ত্যাগ করে ঘুরে বেড়ান এখানে-সেখানে। এ সময় কাশ্মীরের পাহাড়ে উপজাতীয়দের সাথে বসবাস এবং জীবন-জীবিকা নিয়ে চিত্রাংকন শুরু করেন। ১৯৪৫ সালে ভারতের সিমলায় তার প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী হয়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতিমা জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে লাহোরে সুলতানের চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন।
১৯৫০ সালে আমেরিকা তে চিত্রশিল্পীদের আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ইউরোপের বেশ কয়েকটি একক ও যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। পাবলো পিকাসো, সালভেদর দালি, পল ক্লী প্রমুখ খ্যাতিমান শিল্পীদের ছবির পাশে সুলতানই এশিয়ার একমাত্র শিল্পী যার ছবি এসব প্রদর্শনীতে সুযোগ লাভ করে।

১৯৫৩ সালে নড়াইলে ফিরে আসেন সুলতান। শিশু-কিশোরদের সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি চারুকলা শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। ১৯৬৯ সালের ১০ জুলাই ‘দি ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৭ সালে স্থাপিত হয় ‘শিশুস্বর্গ’। শিশুদের খুবই ভালোবাসতেন এই বহেমিয়ান। তাইতো শিশুদের নিয়ে প্রকৃতির সাথে চিত্রা নদীতে ঘুরে ছবি আকার জন্য তার সঞ্চিত অর্থ দিয়ে ১৯৯২ সালে ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ৬০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৫ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট দ্বিতলা নৌকা (ভ্রাম্যমাণ শিশুস্বর্গ) নির্মাণ করিয়েছিলেন।
আমাদের চিত্রশিল্পের ইতিহাসে এক কিংবদন্তী মহান শিল্প সাধক পুরুষ। শিল্পের প্রতি অনুরাগ, শিশুদের প্রতি মমত্ববোধ,বন্য জীবজন্তু পশু-পাখির প্রতি ভালবাসা,বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়াস,ভোগবাদী জীবনের প্রতি অবহেলা,মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সর্বোপরি চিত্রশিল্পে সতন্ত্রতা তাকে নিয়ে গেছে অন্যতম উচ্চতায়।
শিল্পী সুলতান তুলির আঁচড়ে সৃষ্টি করেছেন “পাট কাটা”, “ধানকাটা”, “ ধান ঝাড়া”, “ জলকে চলা”, “ চর দখল”, “গ্রামের খাল”, “মৎস শিকার”, “গ্রামের দুপুর”, “নদী পারা পার”, “ধান মাড়াই”, “জমি কর্ষনে যাত্রা”, “মাছ ধরা”, “নদীর ঘাটে”, “ধান ভানা”, “গুন টানা”, “ফসল কাটার ক্ষনে” , “শরতের গ্রামীন জীবন”, “শাপলা তোলা” মত বিখ্যাত সব ছবি।চিত্রাপাড়ের লালমিয়া হয়ে উঠেছেন দেশ জাতির গন্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ববরেন্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান।
চিত্রাংকনের পাশাপাশি বাঁশি বাজাতে পারতেন। পুষতেন সাপসহ বিভিন্ন পশু-পাখি।নড়াইলের রাস্তায় কালো গাউনপরে কাধে ঝোলা ব্যাগে আড় বাশি নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন প্রিয় লালমিয়া। ঝোলা ব্যাগে কখনও বেজি, বিড়াল আবার সাপও থাকতে দেখা গেছে। চিত্রাপাড়ের লালমিয়া শিল্পের মূল্যায়ন হিসেবে পেয়েছেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ নিউইয়র্কের বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার থেকে ‘ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট’ এবং এশিয়া উইক পত্রিকা থেকে ‘ম্যান অব এশিয়া’ পুরস্কার।
এছাড়া ১৯৮২ সালে একুশে পদক এবং ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের রেসিডেন্ট আর্টিস্ট স্বীকৃতি এবং ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা পান। তার চিত্রকর্ম নিয়ে তারেক মাসুদ তৈরী করেন “আদমসুরত”। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর অসুস্থ অবস্থায় যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রিয় জন্মভূমি নড়াইলের কুড়িগ্রামে তাকে শায়িত করা হয়।
শিল্পী এস এম সুলতান ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও নড়াইলের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান জানান,করোনা সংকটের কারণে এবছর সংক্ষিপ্ত পরিসরে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ১০ আগষ্ট সকালে শিল্পীর সমাধিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, সুলতান কমপ্লেক্সে কোরআনখানি ও দোয়া মাহফিল এর আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া সংক্ষিপ্ত আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন ও থাকছে।
প্রিন্ট