বোয়ালমারী (ফরিদপুর) প্রতিনিধিঃ
“আমার বাবাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে কবর পর্যন্ত পিছু ছাড়েনি ওরা। এখন আমার পেছনেও লেগেছে। মানুষ কি শুধু রাজনীতি করার জন্যই এই দুঃখ সয়ে যাবে?”
কথাগুলো বলছিলেন ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার রুপাপাত ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মোল্লা। তার কণ্ঠে ছিল ক্ষোভ, বেদনা ও চরম হতাশা—যা কেবল একজন দীর্ঘদিন রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার পরিবারের সদস্যই বুঝতে পারে।
–
মিজানুর রহমানের বাবা আবুল হোসেন মোল্যা ছিলেন রুপাপাত ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। তিনি ছিলেন দলের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী, যিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দলের পতাকা আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু সেই নিষ্ঠার ফলস্বরূপ তাকে ও তার পরিবারকে হতে হয়েছে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার।
আবুল হোসেন মোল্যা, তার স্ত্রী, ভাই এবং দুই ছেলেসহ পরিবারের প্রায় সব সদস্যের নামেই একের পর এক রাজনৈতিক মামলা দায়ের করা হয়। জীবদ্দশায় তাদের নামে চলেছিল ৩০-৩৫টির মতো মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, পুলিশি হয়রানি, হুমকি, রাতের আঁধারে ঘরবাড়ি ঘেরাও—কিছুই বাদ ছিল না।
–
চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান জানান, আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকালে কদমী গ্রামে প্রায় ৪০০ বিএনপি পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। অনেকের ঘরবাড়ি লুটপাট করে ফাঁকা করে দেওয়া হয়। রান্নার হাঁড়ি-পাতিল পর্যন্ত নেই হয়ে যায়। মা-বোনদের গলার চেইন, শিশুদের খেলনা—সব কিছু কেড়ে নেওয়া হয়। এসব ছিল একটি রাজনৈতিক পরিচয়ের মূল্য, যা তারা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
–
২০১৭ সালে মিজানুর রহমান সাহস করে এগিয়ে আসেন। গ্রামীণ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সালিশি বৈঠকের মাধ্যমে অনেক মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেন। ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়ান, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। এরপর এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তাকে রুপাপাত বামন চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি নির্বাচিত করেন। তখন তিনি মানবিক সিদ্ধান্ত নিয়ে স্কুলের সকল শিক্ষার্থীর বেতন ও খরচ দুই বছর পর্যন্ত মওকুফ করে দেন।
করোনাকালীন সময়ে ঢাকায় থাকা এই মানুষটি ব্যবসা বন্ধ করে গ্রামে ফিরে আসেন এবং অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নানা সহযোগিতা করতে থাকেন। ফলে জনগণ তাকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে উৎসাহ দেয়। ২০২২ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি।
–
চেয়ারম্যান হওয়ার পর মিজানুর রহমান শালিশ বাণিজ্য বন্ধ করে দেন। অপরাধী ও ভুক্তভোগীকে একত্র করে নিঃস্বার্থভাবে বিচার করে দেন। তার জনপ্রিয়তা ও নিরপেক্ষতা দেখে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের একাংশ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এখানেই শেষ নয়। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক গোষ্ঠী বিএনপির ভেতরের কিছু নেতাকেও টাকা-পয়সা দিয়ে কিনে নেয়।
তাদের হাত ধরেই ফের শুরু হয় চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে নতুন করে হয়রানি। একের পর এক মিথ্যা মামলা তৈরি হয় তার বিরুদ্ধে। সরকার পরিবর্তন হলেও চেহারা বদলে ফিরে আসে সেই পুরনো নির্যাতনের চিত্র।
–
সম্প্রতি ঢাকার রামপুরা থানায় দায়ের হওয়া একটি রাজনৈতিক মামলায় মিজানুর রহমান মোল্লাকে আসামি করা হয়। মামলাটির কোনো ভিত্তি নেই, অথচ কাগজে-কলমে তাকে দোষী প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে। সরকার পতনের পরে মিরপুরেও একটি মিথ্যা মামলা হয়। সে মামলার সাক্ষী ছিলেন কালামের ছেলে মো. রাজু মোল্যা।
তবে রাজুর বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি।
–
রুপাপাত ইউনিয়ন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কালাম মিয়ার মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এজন্য তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
–
স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন, “ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে যেমন মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাদের শ্বাসরুদ্ধ করা হতো, এখনো তাই চলছে। সরকার বদলেছে, কিন্তু নির্যাতনের নকশা বদলায়নি।”
–
চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, “আমি কারও বিরুদ্ধে না, আমি মানুষের পাশে আছি। কিন্তু আজও আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়, হুমকি আসে। আমরা কি চিরদিন অন্যায় সয়ে যাবো? আমরা কি ন্যায় কোনো দিন দেখবো না?”
–
একটি প্রশ্ন সমাজের প্রতি: রাজনীতি করলে কি মর্যাদা নয়, কষ্টই ভবিতব্য?
এই প্রশ্ন এখন শুধু রুপাপাত নয়, ফরিদপুরের প্রতিটি সেই পরিবারের—যারা দলীয় পরিচয়ের জন্য জীবনের সব কিছু হারিয়েছে। তারা চায় ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা। কিন্তু সেই আশাটুকু কি আজও স্বপ্নই রয়ে যাবে?
–
রুপাপাত ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি ও অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট মো. মফিজুর রহমান আক্কাস বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার শেখ হাসিনার আমলে আমাদের নামে একাধিক মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছিল। সব মামলা ও শত্রুতা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মোল্লা মিটমাট করে দেন। তারপরেও যদি আবার আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়, সেটা অন্যায় ও বড় ধরণের জুলুম। শুনেছি, আওয়ামী লীগ ও কথিত বিএনপির কিছু নেতা মিলিত হয়ে আমাদের চেয়ারম্যানকে মাস্তান দিয়ে জানে মেরে ফেলবে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। সেই সাথে তার নামে ঢাকার রামপুরায় একটি মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে। এটা নিন্দনীয় কাজ। এ মিথ্যা মামলা থেকে তাকে মুক্ত করে দেয়া হোক।
–
বিএনপি নেতা আবুল হোসেনের স্ত্রী নাছিমা বেগম বলেন, “আমার স্বামী বিএনপি করার কারণে রুপাপাত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহজাহান তার লোকজন নিয়ে আমাদের বাড়ি সহ বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট ও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। এমনকি আমার দুই ছেলে, ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান মোল্লা ও ইউনিয়ন যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মুরাদ মোল্লার নামে একাধিক মামলা দায়ের করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তবুও আমরা কষ্ট পেলেও মেনে নিয়েছিলাম যে আমরা বিএনপি করি। আওয়ামী লীগ তো মিথ্যা মামলা দিবে, এটা সত্য। তবে এ আমলেও মিথ্যা মামলা দিয়ে আমার ছেলেদের হয়রানি করা হচ্ছে। আমরা বিএনপি পরিবার, এর তীব্র নিন্দা জানাই। আমার ছেলেদের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাই।”
–
বিএনপি সমর্থক ফায়েক মোল্লা বলেন, “আওয়ামী লীগের আমলে আমি, সোনা মিয়া, মুরাদ মোল্লা, কালাম মিয়া—পুলিশের ভয়ে একই সাথে মাঠের ভেতর ঘুমিয়ে রাত কাটিয়ে দিয়েছি। পরে আমাকে ডিবি পুলিশ ধরে নিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেছে। আমাকে পিটিয়ে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছিল। মহান আল্লাহর রহমতে ফ্যাসিস্ট সরকার হাসিনার পতনের মাধ্যমে দেশ শান্তি পেয়েছিল। ভেবেছিলাম এবার শান্তিতে থাকতে পারবো। তবে সেটা কিছু বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কারণে সম্ভব হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের শাহজাহান উৎকোচ নিয়ে বিএনপির কালামের সঙ্গে একত্রিত হয়ে বিএনপির নির্যাতিত নেতাদের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে তার ছেলেকে দিয়ে মিথ্যা মামলা দায়ের করছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।”
–
উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বলেন, “রুপাপাত আসলে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে দেখা হয়। তবে সে দুর্দিনেও ওই সময় মিজানুর রহমান মোল্লার পরিবার বিএনপির রাজনীতি করেছে। এমনকি তারা ওই এলাকায় বিএনপিকে টিকিয়ে রেখেছিল। তবে শুনেছি, ওই পরিবারটিকে বিএনএমএর দালাল নামধারী বিএনপি নেতা ও আওয়ামী লীগের কিছু নেতা একত্রিত হয়ে যেখানে-সেখানে মিথ্যা মামলা দায়ের করছে। এটা নিন্দনীয় কাজ। আমরা উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানাই। অনতিবিলম্বে এ মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাই আমরা।”
প্রিন্ট