ঢাকা , শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রতিনিধি নিয়োগ
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা পত্রিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আপনি আপনার এলাকায় সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন। Hotline- +880 9617 179084

ছোটগল্পঃ আষাঢ়ের সেই দিনগুলো

শামীম আহমেদঃ

 

আষাঢ় মাস এলেই আমার মনটা কেমন যেন করে ওঠে। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে, গ্রামের সেই নিরিবিলি দিনগুলোর কথা। বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে যাওয়া পাট ক্ষেত, মাঠের মাঝে জলজট হয়ে মাছ ধরার আনন্দ, আর ঢেউ খেলানো মেঘের খেলা—সব মিলিয়ে এক অপূর্ব সৌন্দর্যের ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে।-

তখন আমরা গ্রামের বাড়িতে থাকতাম, মা, বাবা, ভাই-বোন মিলে একসাথে। আষাঢ় মাস পড়লেই কেমন এক রোমাঞ্চ অনুভব করতাম সকলে। চারদিক মেঘলা হয়ে যেতো, বাতাসে ধানের গন্ধে ম ম করত, আর হঠাৎ করেই মুষলধারে বৃষ্টি নামত। সেই সময় আমাদের উঠোনে এবং টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ যেন এক ধরনের সুর হয়ে বাজত—”টাপুর টুপুর টাপুর টুপুর”। আমরা জানালার পাশে বসে মুড়ি-চিড়া খেতে খেতে মুগ্ধ হয়ে সে সুর শুনতাম।

একদিনের কথা এখনো মনে পড়ে। সকালে হালকা রোদের পর বিকেলে হঠাৎ আকাশ কালো হয়ে এল। মা ডেকে বললেন, “বৃষ্টি আসছে, জামাকাপড় তুলে আন।” কিন্তু ঠিক তখনই আমি আর আমার ছোট ভাই মেঘরাজ ছুটে বেরিয়ে গেলাম বাইরে। কাদায় পিছলে পড়তে পড়তে কী যে মজা লাগত! বাড়ির পাশের পুকুরটা তখন কানায় কানায় পূর্ণ। আমি আর মেঘরাজ ছিপ নিয়ে বসতাম পুকুরের পাড়ে, ছোট ছোট মাছ ধরার আশায়। মাঝে মাঝে বৃষ্টির মধ্যে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম! তখনো বুঝতাম না প্রকৃতির এ এক অনন্য উপহার!

আর ছিল আষাঢ়ের সেই সন্ধ্যাবেলা। পাখির ডাকে ভরা মেঘলা আকাশের নিচে ঠাণ্ডা হাওয়ায় মা হাঁসের ডিম ভেজে দিতেন, সাথে গরম গরম খিচুরি। একদিকে বৃষ্টির শব্দ, অন্যদিকে নরম আলোয় ঘরের মধ্যে বসে গল্প শুনতাম দাদার মুখে—”এক ছিল রাজা, এক ছিল রানী” দিয়ে শুরু হওয়া সেই অদ্ভুত সব কাহিনি।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শুধু চোখে দেখার বিষয় নয়, তা মনকেও ছুঁয়ে যায়। আষাঢ়ের দিনে গাছের পাতা যেন আরও সবুজ হয়ে উঠত, কলাপাতায় জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা যেন মুক্তার মতো ঝলমল করত। আমাদের বাড়ির পাশের বাঁশঝাড়ে যখন বৃষ্টি পড়ত, তখন তার শব্দ এমন ছিল যেন প্রকৃতি নিজের ভাষায় কিছু বলে যাচ্ছে। আর সেই ভাষা আমরা অনুভব করতাম।

তখনকার দিনে মোবাইল বা টেলিভিশনের আকর্ষণ ছিল না, ছিল শুধু প্রকৃতির সান্নিধ্য। তাই আষাঢ় এলেই আমি সময় পেলেই ছাদে গিয়ে দাঁড়াই, চোখ বন্ধ করি, আর কল্পনায় ফিরে যাই সেই বৃষ্টিভেজা গ্রামের দিনে।
আজ শহরের কংক্রিটের জঙ্গলে দাঁড়িয়ে যতই চেষ্টা করি, সেই গন্ধ, সেই সুর, সেই ছোঁয়া আর পাওয়া যায় না। কিন্তু স্মৃতির পাতায় এখনো আষাঢ়ের সৌন্দর্য গেঁথে আছে—একটা মাটির গন্ধে ভরা ভালোবাসার দিন, বৃষ্টির ফোঁটায় ঝরঝরে হয়ে থাকা এক নিখুঁত শৈশব।

লেখিকঃ- শামীম আহমেদ
                 কবি, লেখক ও সাহিত্যিক।


প্রিন্ট
Tag :
এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

নরসিংদীতে ট্রাকসহ ১৪৮ বস্তা জিরা উদ্ধার, দুই ডাকাত গ্রেফতার

error: Content is protected !!

ছোটগল্পঃ আষাঢ়ের সেই দিনগুলো

আপডেট টাইম : ০৪:২০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫
সময়ের প্রত্যাশা ডেস্ক : :

শামীম আহমেদঃ

 

আষাঢ় মাস এলেই আমার মনটা কেমন যেন করে ওঠে। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে, গ্রামের সেই নিরিবিলি দিনগুলোর কথা। বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে যাওয়া পাট ক্ষেত, মাঠের মাঝে জলজট হয়ে মাছ ধরার আনন্দ, আর ঢেউ খেলানো মেঘের খেলা—সব মিলিয়ে এক অপূর্ব সৌন্দর্যের ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে।-

তখন আমরা গ্রামের বাড়িতে থাকতাম, মা, বাবা, ভাই-বোন মিলে একসাথে। আষাঢ় মাস পড়লেই কেমন এক রোমাঞ্চ অনুভব করতাম সকলে। চারদিক মেঘলা হয়ে যেতো, বাতাসে ধানের গন্ধে ম ম করত, আর হঠাৎ করেই মুষলধারে বৃষ্টি নামত। সেই সময় আমাদের উঠোনে এবং টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ যেন এক ধরনের সুর হয়ে বাজত—”টাপুর টুপুর টাপুর টুপুর”। আমরা জানালার পাশে বসে মুড়ি-চিড়া খেতে খেতে মুগ্ধ হয়ে সে সুর শুনতাম।

একদিনের কথা এখনো মনে পড়ে। সকালে হালকা রোদের পর বিকেলে হঠাৎ আকাশ কালো হয়ে এল। মা ডেকে বললেন, “বৃষ্টি আসছে, জামাকাপড় তুলে আন।” কিন্তু ঠিক তখনই আমি আর আমার ছোট ভাই মেঘরাজ ছুটে বেরিয়ে গেলাম বাইরে। কাদায় পিছলে পড়তে পড়তে কী যে মজা লাগত! বাড়ির পাশের পুকুরটা তখন কানায় কানায় পূর্ণ। আমি আর মেঘরাজ ছিপ নিয়ে বসতাম পুকুরের পাড়ে, ছোট ছোট মাছ ধরার আশায়। মাঝে মাঝে বৃষ্টির মধ্যে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম! তখনো বুঝতাম না প্রকৃতির এ এক অনন্য উপহার!

আর ছিল আষাঢ়ের সেই সন্ধ্যাবেলা। পাখির ডাকে ভরা মেঘলা আকাশের নিচে ঠাণ্ডা হাওয়ায় মা হাঁসের ডিম ভেজে দিতেন, সাথে গরম গরম খিচুরি। একদিকে বৃষ্টির শব্দ, অন্যদিকে নরম আলোয় ঘরের মধ্যে বসে গল্প শুনতাম দাদার মুখে—”এক ছিল রাজা, এক ছিল রানী” দিয়ে শুরু হওয়া সেই অদ্ভুত সব কাহিনি।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শুধু চোখে দেখার বিষয় নয়, তা মনকেও ছুঁয়ে যায়। আষাঢ়ের দিনে গাছের পাতা যেন আরও সবুজ হয়ে উঠত, কলাপাতায় জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা যেন মুক্তার মতো ঝলমল করত। আমাদের বাড়ির পাশের বাঁশঝাড়ে যখন বৃষ্টি পড়ত, তখন তার শব্দ এমন ছিল যেন প্রকৃতি নিজের ভাষায় কিছু বলে যাচ্ছে। আর সেই ভাষা আমরা অনুভব করতাম।

তখনকার দিনে মোবাইল বা টেলিভিশনের আকর্ষণ ছিল না, ছিল শুধু প্রকৃতির সান্নিধ্য। তাই আষাঢ় এলেই আমি সময় পেলেই ছাদে গিয়ে দাঁড়াই, চোখ বন্ধ করি, আর কল্পনায় ফিরে যাই সেই বৃষ্টিভেজা গ্রামের দিনে।
আজ শহরের কংক্রিটের জঙ্গলে দাঁড়িয়ে যতই চেষ্টা করি, সেই গন্ধ, সেই সুর, সেই ছোঁয়া আর পাওয়া যায় না। কিন্তু স্মৃতির পাতায় এখনো আষাঢ়ের সৌন্দর্য গেঁথে আছে—একটা মাটির গন্ধে ভরা ভালোবাসার দিন, বৃষ্টির ফোঁটায় ঝরঝরে হয়ে থাকা এক নিখুঁত শৈশব।

লেখিকঃ- শামীম আহমেদ
                 কবি, লেখক ও সাহিত্যিক।


প্রিন্ট