আলিফ হোসেনঃ
রাজশাহীর তানোরসহ বরেন্দ্র অঞ্চলে ভেজাল ও নিম্নমাণের কীটনাশকে বাজার সয়লাব হয়ে উঠেছে। কৃষকদের অভিযোগ, মানহীন এসব কীটনাশক জমিতে দফায় দফায় প্রয়োগ করেও সুফল মিলছে না। সঠিক সময়ে কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের উপ-সহকারী কর্মকর্তাদের (এএও) পরামর্শও পাওয়া যাচ্ছে না। আবার ভেজাল ঠেকাতে কৃষি বিভাগের তেমন কোনো নজরদারিও নাই, নাই ভ্রাম্যমান অভিযান।
সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়,সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা থেকে সংগ্রহ করা ১৬টি রাসায়নিক সারের নমুনা মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে পরীক্ষা করে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় । নমুনাগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশের বিংগো (সলুবার বোরন), ফেভারিট এগ্রোর ফেবার জিঙ্ক, ইনতেফা কোম্পানির বোরফা প্লাস, প্রোগ্রেস এগ্রোর বোরো প্লাস, ফেভারিট এগ্রোর আয়াত বোরিক অ্যাসিড, স্কয়ারের জালি মনো, বাংলাদেশ এগ্রিকালচার ইন্ডাস্ট্রিজের বাই বোরন, ইস্পাহানি এগ্রোর মনো জিঙ্ক, ক্রপ কেয়ারের অ্যাকটিভ বোরাক্স, ভেলেন্টেটেকের ভেলেন্ট মনো জিঙ্ক, সাফা এগ্রি কেয়ারের সাবাসি এবং বোরন, গ্রিন বাংলার গ্রিন লিফ, টেনস এগ্রোর টেনস জিঙ্ক এমকোর ইকো জিঙ্ক প্রোগ্রেস এগ্রোর প্রোজিন বোল্ট, মিমপেক্সের মিম জিঙ্ক, যমুনা প্লাস এগ্রা মার্কেটের গ্রোজিঙ্ক+ এবং সিনজেনটার গ্রোজিংন। গবেষণাগারের ফলে ১৬টি নমুনার সবগুলোতেই ভেজাল পাওয়া যায়।
জানা গেছে, নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশের কৃষক। তার ওপর বিভিন্ন স্থানে বালাইনাশকের কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি ভেজাল পণ্য সরবরাহ করছে। আর এতে মাথায় হাত পড়েছে কৃষকদের। সরকারের মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ল্যাব টেস্টেও এসব কোম্পানির পণ্য ভেজাল প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি বেসরকারিভাবে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) ল্যাবে করা টেস্টেও ভেজাল প্রমাণিত হয়েছে এসব বালাইনাশক। তা ছাড়া চীনের রাষ্ট্রীয় একটি ল্যাবরেটরির টেস্টেও এসব পণ্যে ভেজাল প্রমাণিত হয়েছে।
এরপরও মন্ত্রণালয়ের ঢিলেঢালা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নিয়ে বালাইনাশক কোম্পানিগুলো দেশব্যাপী বিস্তার করেছে প্রতারণার জাল। বিভিন্ন কোম্পানি এসব অনিয়ম এবং অপরাধের নেতৃত্ব দেয়। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে টেনস এগ্রো, অ্যামিনেন্স কেমিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ার্স ক্রপ সায়েন্স, এগ্রো ইনপুট বাংলাদেশ, ক্লিন এগ্রো ও নিড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ। তাদের বিরুদ্ধে কখনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে একাধিক সুত্র নিশ্চিত করেছে।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জাভেদ হোসাইন খানের নেতৃত্বে এ পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এস এম নুর আলম এবং সেন্টার ফর সফিস্টিকেটেড ইনস্ট্রুমেন্টেশন অ্যান্ড রিসার্চ ল্যাবরেটরির ডেপুটি ডিরেক্টর ড. মো. ওমর ফারুক। গত ৭ জানুয়ারি এ টেস্টের ফল দেওয়া হয়। ল্য্যবরেটরিতে পরীক্ষার ফল বলছে, এসব বালাইনাশকে যে পরিমাণ কেমিক্যাল থাকার কথা, তার ধারেকাছেও নেই। এমনকি সর্বনিম্ন পর্যায় থেকেও অনেক কম রয়েছে। কোনো কোনো কোম্পানির বালাইনাশকে প্রয়োজনের চেয়ে এক ভাগ থেকে পঞ্চাশ ভাগ পর্যন্ত কম রয়েছে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে (যবিপ্রবি)র কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জাভেদ হোসেন খান বলেন, ৯টি বিষয়ে কীটনাশক পরীক্ষা করতে দিয়েছিল একটি প্রতিষ্ঠান। যবিপ্রবির ল্যাব পৃথিবীর সবচেয়ে অত্যাধুনিক ল্যাব। পরীক্ষার ফল নির্ভুল হয়।
সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর থেকে এসব পণ্যে যা থাকার কথা বলা হয়েছিল পরীক্ষা করে তা পাওয়া যায়নি। প্রতিটি কীটনাশক পরীক্ষা করে দুই ভাগ, পাঁচ ভাগ, ১০ ভাগ এবং ৫০ ভাগ পর্যন্ত কম পাওয়া গেছে, যা কখনোই উপযুক্ত নয়। এটি ফসলের ক্ষেত্রে ঠিকঠাক কার্যকর হবে না।
স্থানীয়রা জানান, কীটনাশক আসল, নকল না নিম্নমাণের সেই সম্পর্কে অধিকাংশ কৃষকের তেমন কোনো ধারণা নাই। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে একশ্রেণীর কীটনাশক ব্যবসায়ী নিম্নমাণেন মানহীন কীটনাশকের রমরমা বাণিজ্য করে কৃষকের পকেট কাটছে।
কৃষকদের স্থানীয় সুত্র জানায়, গত ২০২০ সালের ৫মে মুন্ডুমালা পৌর এলাকার কীটনাশক ব্যবসায়ী মেসার্স সুফিয়া টেড্রার্সের স্বত্তাধিকারী সামসুজ্জামান ডালিমের পরামর্শে তার দোকান থেকে কীটনাশক কিনে পাঁচন্দর গ্রামের বাসিন্দা সারুদ্দি সরকারের পুত্র কৃষক মাসুদ রানা তার সাড়ে তিন বিঘা বোরো খেতে শীষকাটা রোগ প্রতিরোধে স্প্রে করেন। কিন্ত্ত ৭মে মাসুদ রানা জমিতে গিয়ে দেখেন তার জমির পুরো ধান গাছ পুড়ে খড়ে পরিনত হয়েছে। এতে তার প্রায় এক লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়।
বিগত মৌসুমে উপজেলার সরনজাই ইউপির সরনজাই খাঁপাড়া গ্রামের মৃত রহমান শাহ্র পুত্র দারেস আলী ইউপির মণ্ডলপাড়া বাজারের কীটনাশক ব্যবসায়ী মিজানের পরামর্শে তার দোকান থেকে কয়েক প্রকার কীটনাশক কিনে ৮ বিঘা আমণখেতে স্প্রে করেন। কিন্ত্ত এসব কীটনাশক স্প্রে করার পরপরই ধান গাছের পাতা পুড়ে ঝলসে যায়। এতে তার প্রায় দুই লাখ টাকার ক্ষতি হয়।
এদিকে কৃষকেরা জানান, উপজেলার কামারগাঁ ইউপির মাদারীপুর বাজারের কীটনাশক ব্যবসায়ী ময়েজ, কামারগাঁ বাজারের সুমন ও সজিব দীর্ঘদিন যাবত কেশরহাট থেকে নিম্নমাণের কীটনাশক এনে বিক্রি করছে। কেশরহাটের জনৈক মোখলেছুর তাদের কাছে এসব মাল সরবরাহ করছে।
এদিকে বিগত ২০২১ সালের ২০ এপ্রিল বুধবার মাদারীপুর বাজারের মেসার্স সিজান ট্রেডার্স থেকে মাদারল্যান্ড কোম্পানীর বিভিন্ন প্রকারের ৬ কার্টুন নিম্নমাণের কীটনাশক জব্দ করেন উপজেলা উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা। কিন্ত্ত ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ বা জব্দকৃত কীটনাশক অফিসে না এনে গোপণে তড়িঘড়ি ব্যস্ত রাস্তার পাশে পুড়িয়ে দিয়ে ব্যবসায়ীকে দায় মুক্তি দেয়া হয়। এদিকে ভেজাল কীটনাশক ধরা পড়ার পরেও লাইসেন্স বাতিল বা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ভেজাল কীটনাশক বিক্রি বন্ধ হচ্ছে না। এবিষয়ে তানোর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ আহমেদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও মুঠোফোনে কল গ্রহণ না করায় তার কোনো বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
প্রিন্ট