ইসমাইল হোসেন বাবু, স্টাফ রিপোর্টার
কুষ্টিয়া শহর মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এই লড়াইয়ে উভয় পক্ষেই ছিল ব্যাপক হতাহতের সংখ্যা। অনেক প্রাণের বিনিময়ে ১১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত হয় এবং আসে চূড়ান্ত বিজয়।
একদিকে স্বজনদের লাশ, অন্যদিকে মা-বোনদের হারানো শোক, স্মৃতি ও আর্তনাদ—এতো বেদনা সত্ত্বেও সেদিন কুষ্টিয়ার মানুষ বিজয়ের আনন্দে রাস্তায় নেমে উল্লাস করেছিল।
আজ ১১ ডিসেম্বর, ঐতিহাসিক কুষ্টিয়া মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে কুষ্টিয়া জেলা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়েছিল। কুষ্টিয়া জেলার মুক্তিযোদ্ধারা ২২টি ছোট-বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে কুষ্টিয়াকে মুক্ত করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়ে কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তুমুল লড়াই চলেছিল।
১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ
এই দিনে বাংলার দামাল ছেলেরা কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা চালায়, যার ফলে বহু পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এরপর বংশীতলা, দুর্বাচারা, আড়পাড়া, মঠবাড়িয়া, মিরপুরের কাকিলাদহ, কুমারখালীর ঘাসখালি সহ ৪৪টি যুদ্ধ সংঘটিত হয় কুষ্টিয়া জেলায়।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল
মুজিবনগর সরকার গঠন হয় এবং পাকিস্তানি বাহিনী কুষ্টিয়া দখলে নিয়ে পুনরায় গণহত্যা শুরু করে। ৬ ডিসেম্বর তিন দিক থেকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে বৃহত্তর কুষ্টিয়ার বিভিন্ন এলাকা হানাদারমুক্ত হতে থাকে। ৯ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া শহর ছাড়া অন্যান্য এলাকা মুক্ত হয়, কিন্তু তুমুল যুদ্ধ চলে শহরে। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে ১১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়াকে শত্রুমুক্ত করেন।
মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক মুহূর্ত: হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে গগণবিদারী আওয়াজে কুষ্টিয়ার আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তোলে। পথে-প্রান্তরে ব্যারিকেড গড়ে তোলা হয়, যেখানে লাঠি-সড়কি, ঢাল-তলোয়ার হাতে বিভিন্ন গ্রামের মানুষ কুষ্টিয়া শহরে ছুটে আসেন মুক্তির আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে।
রাজাকারদের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনী ফাঁদ পেতে শহরের কাছে চৌড়হাঁসে ব্রিজের নিচে মাইন পেতে রাখে। ১০ ডিসেম্বর দুপুরে মিত্রবাহিনীর ৪টি ট্যাংক পার হওয়ার পরই ব্রিজটি উড়িয়ে দেয় তারা। এতে মিত্রবাহিনীর অন্তত ২০০ জন নিহত হয়। পরবর্তীতে, মিত্রবাহিনী হেলিকপ্টার ব্যবহার করে যুদ্ধ চালাতে থাকে এবং পাকিস্তানি বাহিনী কিছুটা পিছু হটে।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ণনা
বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আব্দুল জলিল জানান, “মুক্তিযোদ্ধারা শহরের তিন দিক থেকে ঘিরে আক্রমণ চালান এবং মূহুর্মূহু মর্টার চার্জ করে পাক বাহিনীকে পিছিয়ে দিতে বাধ্য করেন। তারা শহরের জিলা স্কুল ও সার্কিট হাউজের ক্যাম্পে অবস্থান নেয় এবং পরে ভেড়ামারার দিকে পালিয়ে যায়।”
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শামীম রেজা বলেন, “১১ ডিসেম্বর সকালে মিত্রবাহিনী বিমান থেকে বোমা ফেললে পাক হানাদারদের দোসররাও পালিয়ে যায় এবং মুক্ত কুষ্টিয়ায় প্রবেশ করে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা।”
কুষ্টিয়া শহর তখন ছিলো এক ভয়ার্ত নগরী। বিহারীরা ব্যাপক লুটপাট করেছিল। একাত্তরের মার্চ মাসে প্রতিরোধ যুদ্ধে কুষ্টিয়াকে মুক্ত করে ফেলেছিল মুক্তিকামীরা, কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী আবার ফিরে এসে শহর দখল করে নেয়।
কুষ্টিয়া শহর মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। উভয় পক্ষের হতাহতের সংখ্যা ছিল অনেক। তবে, অনেক প্রাণের বিনিময়ে ১১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত হয় এবং বিজয় লাভ করে।
আরও পড়ুনঃ রংপুরের গংগাচড়ায় ১১ এতিম মেয়ের যৌতুকবিহীন বিয়ের উপহার দিলেন জামায়াত
একদিকে শোক, অন্যদিকে আনন্দ—এ দিন কুষ্টিয়ার মানুষ বিজয়ের আনন্দে সিক্ত হয়েছিল।
প্রিন্ট