ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার পরমেশ্বরদী ইউনিয়নের শ্রীনগর গ্রামের সচিন্ত্য কুমার খাঁ’র ছেলে সত্যব্রত খাঁ। ২০১৬ সালের ১৯ জুলাই ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তার জন্ম নিবন্ধন করান। পরবর্তিতে কোনো কাজ করতে গিয়ে দেখতে পান জন্ম নিবন্ধনটি অনলাইন সার্ভারে নেই। অনলাইনে তার জন্ম সনদ সার্চ দিলে একই নিবন্ধন নম্বরে সত্যব্রত খাঁর নামের জায়গায় একই ইউনিয়নের ময়েনদিয়া গ্রামের জাকির শেখের ছেলে তামিনের নাম দেখা যায়।
একই ঘটনা ঘটেছে ওই গ্রামের মধুসুদন সাহার ছেলে সৃজন সাহার নামে পরিবর্তে ধুলজোড়া গ্রামের ছবির শেখের ছেলে আব্দুল্লাহ সিয়ামের নাম, প্রতাপ কুমারের ছেলে প্রত্যয় কুমার সাহার পরিবর্তে হয়ে ধুলুজোড়া গ্রামের জাহাঙ্গীর মোল্যার ছেলে আ. আহাদ মোল্যা, পরমেশ্বরদী গ্রামের দিপায়ন সাহার মেয়ে দয়িতা সাহার জায়গায় হয়ে গেছে মো. জিন্নাত মোল্যার মেয়ে মারজিয়া ইসলাম, পুতন্ত্রীপাড়া গ্রামের দূর্লভ চন্দ্র সাহার মেয়ে বাবলী রানী সাহার পরিবর্তে দেব কুমার মন্ডলের ছেলে দীপু মন্ডল।
এ রকম ৩৪ জনের সন্ধান পাওয়া গেছে যাদের জন্ম নিবন্ধন সনদ পরিবর্তিত হয়ে অন্যের নাম পরিবর্তন হয়ে গেছে। অবশ্য এ সকল জন্ম নিবন্ধন সনদে স্বাক্ষর করেছেন পরমেশ্বরদী ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মোহাম্মদ রিবুল হোসেন। অভিযোগ উঠেছে এ জন্ম সনদ গুলো জাল করে সচিব বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। তবে সনদ জালিয়াতি ও অর্থ নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন সচিব রিবুল হোসেন। জন্ম নিবন্ধন সনদ পাল্টে যাওয়ায় বিপদে পড়া পরমেশ্বরদী গ্রামের ৩৫ জন ব্যক্তি এর প্রতিকার চেয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর লিখিত আবেদন করেছেন। এ ছাড়া সচিবের বিরুদ্ধে জন্ম নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্সসহ নানাবিধ কাজে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
জন্ম সনদপত্র পরিবর্তন হওয়ায় বিপদে পড়া বোয়ালমারী উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অভিযোগ করেন, তাঁর ছেলের পাসপোর্ট রয়েছে এবং বেতনের জন্য ইলেক্ট্রিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি) করার কাগজপত্র প্রস্তুত করতে গিয়ে দেখেন অনলাইনে ছেলের জন্ম নিবন্ধন সনদ নেই। বিষয়টি নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে গেলে সচিব উল্টাপাল্টা বলতে থাকেন। এক পর্যায়ে সচিব তাকে এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেন। বাড়াবাড়ি করলে তাকে ভারত পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকিও দেন। শাহ জাফর টেকনিক্যাল কলেজের একজন অধ্যাপকও ইএফটি করতে গিয়ে বিপদে পড়েন অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন সনদ না থাকায়।
পরবর্তিতে খোঁজাখুজি করতে গিয়ে দেখা যায়, আরো অনেকেরই জন্ম নিবন্ধন সনদ অনলাইন সার্ভারে নেই। তখন তাঁরা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। কারণ ইএফটি করতে না পারলে তাদের বেতন বন্ধ হয়ে যাবে। ছেলে-মেয়েদের জন্য কোনো কাজ করতে পারবেন না। দৌড়ঝাঁপে কাজ না হওয়ায় শ্রীনগর গ্রামের ৩৫জন ব্যক্তি জটিলতা নিরসনের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত আবেদন করেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওই সচিবকে অফিসে ডেকে ভূক্তভোগীদের জন্ম নিবন্ধন সনদপত্র ঠিক করে দেওয়ার মৌখিক নির্দেশ দিলে সচিব পর্যায়ক্রমে তাদের সনদ ঠিক করে দিচ্ছেন।
ভুক্তভোগী পরমেশ্বরদী ইউনিয়নের শ্রীনগর গ্রামের বাসিন্দা ময়েনদিয়া বাজারের ব্যবসায়ী দুর্লভ চন্দ্র সাহা বলেন, আবেদন দেওয়ার পাশাপাশি আমার এক চাচা সচিব, তাঁকে দিয়ে ফোন করিয়ে জন্ম নিবন্ধন ঠিক করা নিয়েছি। তবে এখনও সবারটা ঠিক হয়নি। আমাদেরটা ঠিক করার সময় টাকা পয়সা লাগেনি কিন্তু অন্য যারা এ কাজে গিয়েছেন তাদের কাজ টাকা ছাড়া হয়নি। তিনি বলেন, সাংবাদিকরা ময়েনদিয়া বাজারে এসে খোঁজ নিলে সব জানতে পারবেন।
পরমেশ্বরদী ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মোহাম্মদ রিবুল হোসেন জন্ম সনদ জালিযাতি ও অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, আগে জন্ম নিবন্ধনের কাজ উদ্যোক্তারা করতো। তারা কোন কাজ সঠিকভাবে করতে পারেনি। বরঞ্চ আমি বিপদে পড়া ব্যক্তিদের উপকার করেছি সনদ সঠিক করে দিয়ে।
সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ দিবে একথা জানলে তাদের (ভুক্তভোগীদের) কাজ করে দিতাম না। তিনি একজন ব্যবসায়ীর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ওর হাত-পা ভেঙ্গে দিয়ে আসতাম। ভারতে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার সাথে ওই শিক্ষকের চ্যালেঞ্জ হয়েছিল; আমি সৌদি চলে যাবো আর না হলে তাকে ভারত পাঠিয়ে দেব। জন্ম নিবন্ধন ও ট্রেড লাইসেন্সসহ বিভিন্ন কাজে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার বিষয়টি সঠিক না বলে তিনি দাবি করেন।
শনিবার বিকেলে পরমেশ্বরদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নুরুল আলম মিনা বলেন, জন্ম নিবন্ধন সনদ নিয়ে কিছু অভিযোগ আমার কাছেও এসেছে। সচিবের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার কথাও কেউ কেউ বলেছেন। তবে এ সব বিষয়ে আমি সচিবকে সতর্ক করেছি। পাল্টে যাওয়া জন্ম নিবন্ধন সনদে আপনার স্বাক্ষর আছে মর্মে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জন্ম নিবন্ধন একটা টেকনিক্যাল ব্যাপার। সচিব এ কাজগুলো সমাধান করে তাই তার স্বাক্ষর দেখে আমিও স্বাক্ষর করেছি।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঝোটন চন্দ বলেন, আবেদনকারীদের জন্ম নিবন্ধন সনদ পাওয়ার কাজটা তখন জরুরী ছিল। তাই সচিবকে ডেকে দ্রুত তাঁদের কাজ করে দেওয়ার নির্দেশ দেই। তবে এ বিষয়ে বেশ কিছু দিন কেউ কিছু জানায়নি এবং অভিযোগকারীরাও আর আসেনি। হয়তো কাজ হয়ে গেছে বলেই কেউ আর যোগাযোগ করেনি। তবে ওই সচিবের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। তার বিরুদ্ধে মৌখিক আরো কিছু অভিযোগ আছে। নতুন করে কেউ লিখিত অভিযোগ করলে সচিবের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রিন্ট