উপ-সম্পাদকীয়ঃ
এক মহাসাগর রক্ত আর পাহাড়সম দুর্দশার বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশক পরও কী আমরা পেরেছি বিশ্বের সুউচ্চ আসনে দেশ কিংবা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে ? আমরা কি পেরেছি তথ্যপ্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা, অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা, ক্রীড়াক্ষেত্রে কিংবা জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সফলতা অর্জন করতে ? একটা দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর ৫৩ বছর পার হওয়া অবশ্যই কম কথা নয়। আমরা পারিনি এ দীর্ঘ সময়ে আত্মকেন্দ্রিকতা আর আত্মবিভেদ ভুলে জাতীয় স্বার্থকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়ে আয়তনে ক্ষুদ্র উন্নয়নশীল বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করতে।
বাংলাদেশ আয়তনের দিক থেকে যদিও রাশিয়া, কানাডা, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল থেকে অনেক ছোট। তথাপিও বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনের দিক থেকে অনেক ছোট রাষ্ট্র বর্তমানে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে নিজেদের মান সমুন্নত রেখেছে। লুক্সেমবার্গ, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড প্রভৃতি রাষ্ট্র আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের তুলনায় অনেক ছোট হলেও বর্তমানে তারা উন্নত আর ধনী দেশের কাতারে নিজেদের স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ হিসেবে তালিকার শীর্ষে রয়েছে ইউরোপের দেশ লুক্সেমবার্গ। ইউরোপের অন্যতম প্রধান আর্থিক প্রযুক্তি (ফিনটেক) হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত দেশটি। সেখানে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্য পরিসেবা অতুলনীয়। সেখানে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে গণপরিবহণ ব্যবহার করেন নাগরিকরা। দেশটির জনগণের মাথাপিছু আয় ১ লাখ ৪০ হাজার ৩১২ ডলার যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১ কোটি ৫৪ লক্ষ টাকা। অথচ লুক্সেমবার্গের আয়তন মাত্র ২ হাজার ৫৯০ বর্গ কিলোমিটার।
সুইজারল্যান্ডের আয়তন ৪১ হাজার ২৯৩ বর্গ কিলোমিটার। পর্যটকদের স্বপ্নের দেশ ইউরোপের দেশ সুইজারল্যান্ড। অপরূপ প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি বেশ স্থিতিশীল অর্থনীতিও দেশটির। মূল্যবান ধাতু, যন্ত্রপাতি এবং কম্পিউটার ও মেডিকেল ডিভাইস রপ্তানি করেও প্রচুর টাকা উপার্জন করে দেশটি।
দেশের জনসংখ্যা কে দক্ষ কর্মঠ করে গড়ে তুললে। অত্যাধিক জনসংখ্যাও জাতীয় অগ্রগতির পথে কোন অন্তরায় নয়, এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত চীন। আয়তনে ছোট হলেও যে ধনী দেশে পরিণত হওয়া যায় সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া তার প্রমাণ বহন করে। এক্ষেত্রে প্রশ্নটা স্বাভাবিক, তবে আমাদের সোনার বাংলাদেশের এ চেহারা কেন ? আমরা কি পারিনা এদেশকে অন্যের কাছে মডেল হিসেবে দাঁড় করাতে ?
উপরোল্লিখিত দেশগুলো আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে ছোট হলেও আজ তারা শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত। অথচ আমরা এসব দেশের পদাঙ্ক অনুসরণ না করে এসব দেশের মতো শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হওয়ার চেষ্টা না করে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাহ্য করে মগ্ন দলীয় স্বার্থে কিংবা ব্যক্তি স্বার্থে। এছাড়া জনসংখ্যাকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করে এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদের সুষ্ঠু, পরিমিত, সঠিকভাবে ব্যবহার করার মাধ্যমে জাতীয় অগ্রগতি নিশ্চিত করলে আমাদের সোনার বাংলাদেশের চিত্রটা হয়তো অন্য রকম হতে পারতো। পরিকল্পনামাফিক সঠিক ও দ্রুত সিদ্ধান্ত প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সামগ্রিক উদ্দেশ্য অর্জনের অপরিহার্যতার গুরুত্ব আমাদের কাছে সীমাবদ্ধ। তা নাহলে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত পরিহার করে আমরা পারিনা দেশের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছাতে। হাত মিলিয়ে সবাই মিলে কাজ করতে কিংবা ভালো কাজের জন্য প্রতিপক্ষকে অভিনন্দন জানাতে। আর সঙ্গত কারণেই আমাদের পশ্চাদকামিতা অনিবার্য হয়ে পড়েছে।
এদেশের আমলাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, পক্ষাবলম্বনের অভিযোগ রয়েছে। ঘুষ ছাড়া ফাইল এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে যায় না। বর্তমানে বাংলাদেশে এটি এখন যেন প্রবাদে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন বিষয় সরকারি কর্মচারীদের বদলির জন্য ঘুষ যেন এক মহৌষধে পরিণত হয়েছে।
আমলাতান্ত্রিক ত্রুটির কারণে আবেদনপত্র লাল পিতার মোড়কে মাসের পর মাস আটকে থাকায় বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও সময় সময় হতাশ হয়। উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হয়। বিভিন্ন সরকারি কাজে কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চপদস্থ আমলারা বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কাজ করেন এবং চূড়ান্ত ক্ষমতা তাদের হাতে ন্যস্ত থাকায় অনেক সময় দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিয়ে অযোগ্য লোকদের নিয়োগ দেন।
দেশে মাঠ প্রশাসনে যেসব সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তার অভাব। শহর থেকে পাস করে উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ মাঠ পর্যায়ে মফস্বলে কাজ করতে আগ্রহী নয়। কারণ দজ্ঞ কর্মকর্তাদের জন্য যে পদমর্যাদা, বেদন-ভাতা, পদোন্নতি, সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন, মাঠ প্রশাসন তার ব্যবস্থা করতে সক্ষম নয়। মাঠ পর্যায়ে দক্ষ কর্মকর্তার অভাব আমাদের ব্যাকওয়ার্ড করে তুলছে। এ অবস্থা চলতে থাকায় দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আনুষঙ্গিক বিভিন্ন কারণে যোগ্য ব্যক্তিদের যোগ্য স্থানে অধিষ্ঠিত করতে না পারায় দিন দিন পিছিয়ে পড়ছি। ব্যর্থ হচ্ছি উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে। আর এ সুযোগটাই গ্রহণ করছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। অর্থনৈতিক সাহায্য, খাদ্য সাহায্য চালু করছে। যদিও আপাতদৃষ্টিতে এই নয়া উপনিবেশবাদ ধরা যায় না। সুযোগ বুঝে উন্নত দেশগুলো আমাদের বিভিন্ন প্রকল্পের উপর বিভিন্ন শর্ত আরোপ করছে, দেশে উন্নয়নের নামে অর্থ লোন হিসেবে দিয়ে শর্ত আরোপের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে তাদের শোষণ ও আধিপত্য বজায় রেখেছে, যা অনভিপ্রেত।
এছাড়া ঘটছে বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ। যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে আমাদের মন-মানসিকতা, চিন্তা-চেতনার উপর। আমাদের মত দারিদ্র দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা এবং উচ্চ শিক্ষিতদের প্রশিক্ষনের সহায়তার নামে দেশ থেকে মেধা পাচার করে আমাদের মেধাশূন্য,পঙ্গু নির্জীব করে পশাতগামী ফেরার পায়তারা চলছে। আজকের মেধাবী ছাত্ররা যারা ভবিষ্যতে দেশকে সুন্দরভাবে পরিচালনার সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, শিল্পোন্নত হিসেবে দেশকে গড়ে তুলবে এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবে, তারা বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানে সুযোগ-সুবিধার আধিক্যের কারণে স্থায়িত্ব পেয়ে যাচ্ছে। এভাবে আমরা অজান্তেই যেন নিজেরা নিজেদের পায়ে কুড়াল মারছি আর পিছিয়ে পরছি অন্য দেশের তুলনায়।
তৃণমূল পর্যায়ের বিভিন্ন অসংগতির কারণে তৃণমূল থেকে ট্যালেন্টরা জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছতে না পারায়, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে অনেক ক্ষেত্রই সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে বের হচ্ছে না বুদ্ধিদীপ্ত তারুণ্য। আমাদের পাশ্চাতগামিতা হওয়া বা পিছিয়ে পড়ার পেছনে এটা একটা বড় কারণ নয় কি ? এভাবে আমরা অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে পড়তে পড়তে হয়তো একদিন উপলব্ধি করতে সচেষ্ট হব যে কতটা পশ্চাদগামী হয়েছি। তখন শত চেষ্টা করো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ পৌঁছানোর চেষ্টা হবে পন্ডশ্রম ।
দীপঙ্কর পোদ্দার অপু
শিক্ষক ও সাংবাদিক
প্রিন্ট