কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ছাতারপাড়া গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গ্রামে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। সেখানে রয়েছে পুলিশের পাহারা। একই পরিবারের দুজন হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ায় গাইন পরিবারে শোকের ছায়া বিরাজ করছে। বাড়ির শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়সী সবার চোখেই অশ্রু। নিকটাত্মীয়রা পরিবারের সদস্যদের কোনোভাবেই শান্ত করতে পারছেন না। ডাবল মার্ডারের ঘটনায় ৩ দিন পর থানায় মামলা দায়ের। তবে হত্যাকাণ্ডে মামলার এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পরে ৫ জনকে কুষ্টিয়া আদালতে সোপর্দ করেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দৌলতপুর থানার ওসি শেখ আওয়াল কবীর।
জোড়া খুনের ঘটনায় পরদিন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ছাতারপাড়া গ্রাম পরিদর্শনে যান পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে আপন দুই ভাইকে হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলার এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মামলায় মোট ৪৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও এই মামলায় অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আরও ৮-১০ জনকে।
রোববার (৩ অক্টোবর) দুপুরে নিহত নজরুল ইসলামের ছেলে সুরুজ আলী দৌলতপুর থানায় মামলাটি করেন। হত্যাকারীদের ফাঁসি দাবি করেছেন নিহতের পরিবার।
প্রতিপক্ষের হামলায় দুই ভাই নিহত হওয়ার পর থেকে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নের ছাতারপাড়া গ্রামে। এদিকে ঘটনার তিন দিন পারে মামলা দায়ের করা হয়।
বংশগত পূর্ববিরোধের জের ধরে গত বুধবার বিকেলে ছাতারপাড়া গ্রামের বাজারে গাইন বংশের হামিদুল ইসলাম ও তাঁর ছোট ভাই নজরুল ইসলামকে প্রতিপক্ষ পিয়াদা বংশের লোকজন নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করেন বলে অভিযোগ। ময়নাতদন্ত শেষে নিহত দুই ভাইয়ের মরদেহ গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে তাঁদের নিজ গ্রামে দাফন করা হয়। ঘটনার পর থেকে তাঁদের পরিবারের সদস্যরা চরম আতঙ্কে থাকার কথা জানিয়েছেন। তাঁরা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন।
একই ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন আরও চারজন। তাঁদের মধ্যে আজগর ও আসমতের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাঁদের ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। সাইফুল ও জামালকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, প্রাথমিক তথ্যে জানা গেছে, পূর্বশত্রুতার জের ধরেই এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে হত্যার সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয় আছে কি না, তাও দেখা হচ্ছে।
আজ ছাতারপাড়া গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গ্রামে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। সেখানে রয়েছে পুলিশের পাহারা। একই পরিবারের দুজন হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ায় গাইন পরিবারে শোকের ছায়া বিরাজ করছে। বাড়ির শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়সী সবার চোখেই অশ্রু। নিকটাত্মীয়রা পরিবারের সদস্যদের কোনোভাবেই শান্ত করতে পারছেন না।
সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০২১ সালে জানারুল ইসলাম নামে পিয়াদা বংশের এক ব্যক্তির রহস্যজনক মৃত্যু হয়। পিয়াদারা এই মৃত্যুর জন্য গাইনদের দায়ী করে। তবে গাইনরা এ দাবি অস্বীকার করে। তাঁদের দাবি ছিল, অসুস্থতার কারণে জানারুলের মৃত্যু হয়। সে সময় এ ঘটনায় পিয়াদারা গাইনদের আসামি করে মামলা করলেও আসামিরা আওয়ামী লীগের সমর্থক হওয়ায় ওই মৃত্যুর রহস্যের উন্মোচন হয়নি। স্থানীয় লোকজনের দাবি, গত তিন বছর এই ক্ষোভ মনে পুষে রেখেছিলেন বিএনপির সমর্থক পিয়াদারা। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গাইনরা এলাকায় কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পরিকল্পিতভাবে প্রতিপক্ষ হামিদুল ও নজরুলকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন পিয়াদা বংশের লোকজন।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, দুই বংশের মধ্যে আধিপত্যের রেষারেষি চলে আসছে প্রায় দুই যুগ ধরে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর পিয়াদাদের দাপটে গ্রামছাড়া হন গাইন বংশের অনেকে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আবার বিগত ১৫ বছর গাইনদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন পিয়াদা বংশের লোকেরা।
নিহত নজরুলের স্ত্রী রমেলা খাতুন বলেন, খেতের কাজ শেষ করে প্রতিদিনই তাঁর স্বামী স্থানীয় বাজারে যান। বুধবার বিকেলেও তিনি বাজারে গিয়েছিলেন। সন্ধ্যার সময় খবর আসে যে তাঁর স্বামীর ওপর হামলা করা হয়েছে। দৌড়ে বাজারে গিয়েও স্বামীর জীবিত মুখটি দেখতে পাননি। কাঁদতে কাঁদতে হত্যাকারীদের শাস্তি দাবি করেন তিনি।
নজরুলের বড় ভাই রেজাউল ইসলাম বলেন, যারা এই হামলা করেছে, তাদের সঙ্গে আমাদের বংশগত বিরোধ ছিল। আমরা আওয়ামী লীগের আর প্রতিপক্ষ বিএনপির সমর্থক। তবে হত্যাকাণ্ডটি দলীয় কোনো ইস্যুতে হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, জানারুলের মৃত্যুর ঘটনার পর থেকেই মূলত পিয়াদাদের সঙ্গে তাদের বিবাদ বৃদ্ধি পায়।
হত্যাকাণ্ডের পর থেকে গা ঢাকা দিয়েছেন পিয়াদা বংশের লোকজন। তাই তাঁদের কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ আওয়াল কবীর বলেন, পূর্ববিরোধ ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের জের ধরে প্রতিপক্ষরা দুই ভাইকে হত্যা করেছে। ওই গ্রামে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ, ভাঙচুর, লুটপাটের মতো ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। তবে দুই ভাই হত্যার ঘটনার পর থেকে পুলিশ শক্ত অবস্থানে আছে।
নিহতের পরিবার ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, পূর্ব শত্রুতার জেরে প্রতিপক্ষের হামলায় আপন দুই ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। তাদের এমন মৃত্যুতে গ্রামের মানুষ নির্বাক। পুরো গ্রামে শোকের মাতম চলছে। আমরা খুনিদের ফাঁসি চাই।
মামলার বাদী ও নিহত নজরুল ইসলামের ছেলে সুরুজ আলী বলেন, আমি, আমার আব্বা নজরুল ইসলাম ও আমার চাচা আব্দুল হামিদ বুধবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সাতারপাড়া বাজারে বসে চা খাচ্ছিলাম। এ সময় সামাজিক দ্বন্দ্ব ও পূর্ব শত্রুতার জেরে প্রতিপক্ষ পিয়াদা, বিশ্বাস ও প্রামানিক বংশের লোকজন পিস্তল, রামদা, চাপাতি ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে হামলা করেন। আমার চোখের সামনে আব্বা ও চাচাকে হত্যা করেছে, আমি বেঁচে গেছি। প্রকাশ্য দিবালোকে তারা এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের সবাইকে আমি চিনি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে হত্যা করে পালিয়ে গেছে তারা। বাজারের সবাই তাদের চেনেন। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন আমাদের চারজন। আমার আব্বা ও চাচা ঘটনাস্থলেই মারা যান। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। আমি খুনিদের ফাঁসি চাই।
প্রিন্ট