মাগুরার মহম্মদপুরে এলজিইডি অধিদপ্তরের প্রকৌশলী সাদ্দাম হুসাইনের বিরুদ্ধে ঠিকাদারি কাজে অনিয়ম ও ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণে উপজেলায় কর্মরত ঠিকাদারগণ এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ঠ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন। স্বজনপ্রীতি করে ঠিকাদার কে কাজ পাইয়ে দেওয়া, ঠিকাদারের সাথে চুক্তিতে কাজ করা এবং বিল প্রাদানে বাধ্যতামূলক অগ্রিম ঘুষ নেওয়া, গোপনে দরপত্র আহ্বান করে নিজের পছন্দ মত ঠিকাদার কে কাজ পাইয়ে দেওয়া এবং ঠিকাদার দিয়ে কাজ কম করিয়ে করে নিজে অন্যের নামে ভূয়া প্রত্যয়ন তৈরি করে সম্পূর্ন বিল উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা এই অভিযোগপত্রে স্থান পেয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এলজিইডির নতুন সিডিউল রেট দেওয়ার পরেও সর্বোচ্চ ৮% উর্ধ্বদরে তার আস্থাভাজন এক ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেন। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) এডিপি’র (অউচ) দরপত্র ওটিএম (ঙঞগ) পদ্ধতিতে আহ্বান করেন। প্রতিটি প্যাকেজে তার আস্থাভাজন একজন ঠিকাদার অংশগ্রহণ করেন এবং তাকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অথচ অধিক স্বচ্ছতার জন্য সারাদেশে এলটিএম (খঞগ) পদ্ধতিতেই এডিপি দরপত্র আহ্বান করা হয়।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে তার দপ্তরের কার্যসহকারী নাজমুল হোসেন সাদ্দামের (কুটি সাদ্দাম) স্ত্রীর মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘নাহিয়ান ট্রেডার্স’ কে কাজ পাইয়ে দেন। কিন্তু ওটিএম পদ্ধতিতে নাহিয়ান ট্রেডার্সের দরপত্রে অংশগ্রহণের কোন যোগ্যতায় ছিলনা। একই অর্থবছরে উপজেলা প্রকৌশলী সাদ্দাম হোসাইন এক সহকারী প্রকৌশলীর আত্মীয়ের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘আর এস কর্পোরেশন’ কে কাজ পাইয়ে দেন। এই প্রতিষ্ঠানেরও ওটিএম পদ্ধতিতে দরপত্রে অংশগ্রহণের যোগ্যতা ছিলনা বলে অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, কেবল মাত্র একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দরপত্রে অংশগ্রহণ করিয়েই কাজ দিয়ে দেওয়ার অভিযোগও তোলা হয়েছে উপজেলা প্রকৌশলী সাদ্দাম হোসাইনের বিরুদ্ধে। এভাবে তিনি নেপথ্যে থেকে ঠিকাদার কে নানাভাবে সহযোগিতা করেন এবং ঠিকাদারের সাথে গোপনে যৌথ ব্যবসা করেন। টেন্ডার আইডি নং- ৯৭১৬০৭, প্যাকেজ নং- ই-টেন্ডার/ এডিপি/ এমজিআর/ এমওএইচ/ ২০২৩-২৪/১৩। এ কাজটি তার আত্মীয়ের প্রতিষ্ঠান ‘আর এস কর্পোরেশন’ কে দিয়ে এবং দরপত্রে উল্লেখিত ২৫৫ মিটার বিএফএস’র স্থলে ২০৪ মিটার কাজ সম্পন্ন করে সমুদয় বিল উত্তোলন করার অভিযোগ করা হয়েছে।
সম্প্রতি উপজেলা প্রকৌশলী জাইকা প্রকল্পের একটি টেন্ডারে ঝিনাইদহ জেলাধীন এক ঠিকাদার আত্মীয়ের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে অবৈধ উপায়ে রেটকোট দিয়ে সহায়তা করে দুইটি কাজ পাইয়ে দেন। কিন্তু জাইকা বরাদ্দকৃত অর্থে গৃহীত প্রকল্পের মধ্যে ইছামতি বিলের কৃষক ছাউনি এবং ঝামা ফেরি ঘাটে যাত্রী ছাউনির কাজে টাইলস ও বজ্র নিরোধক যন্ত্র স্থাপন না করেই সমুদয় বিল তুলে নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া উপজেলার বাবুখালি ইউনিয়নের ঠাকুরের হাট বাজারে ওয়াশ ব্লক, চান্দিনা ঘর, নহাটা ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে টিউবওয়েল স্থাপন না করেই সাবেক ভাইস চেয়ারম্যানে বরকত আলী’র নামে ভূয়া প্রত্যয়ন তৈরি করে সমুদয় বিল উত্তোলন করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া মশাখালী, কলাগাছি ও রাজপাট এলাকার বিভিন্ন স্থানে ইটের সলিংয়ের কাজ কম করে ঠিকাদারের সাথে সমন্বয় করে সমুদয় বিল উত্তলোন করে টাকা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান তার নামে ভূয়া প্রত্যয়ন দেখে তাৎক্ষণিত প্রকৌশলীর উপর ক্ষিপ্ত হয়েছেন এবং এ অপরাধে তিনি থানায় সাধারন ডায়েরি করেছেন।
চলতি অর্থবছরে উপজেলায় ‘জয় সেন্টার’ নির্মাণে উপ-সহকারী প্রকৌশলী থাকা সত্ত্বেও তাকে কোনো দায়িত্ব না দিয়ে খালিদ হাসান নামের নতুন একজন সার্ভেয়ারকে দিয়ে কাগজপত্র স্বাক্ষর করিয়ে নেন। মূলত: এ কাজের নেপথ্য ঠিকাদার তিনি নিজেই, এমন গুরুতর অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী-এ কাজটি পেয়েছিলেন ঝিনাইদহ জেলাধীন মিজানুর রহমান নামের এক ঠিকাদার। কিন্তু স্থানীয় একজন ঠিকাদারের মাধ্যমে মিজানুর রহমানকে ম্যানেজ করে প্রকৌশলী নিজেই নেপথ্যে থেকে ঠিকাদারী ব্যবসা করছেন। এতে যে পাথর ব্যবহার করা হয়েছে তা পূর্বে কোনো নির্মাণ কাজে ঢালাইয়ে ব্যবহৃত হয়েছিল। সেই পাথর মেশিনে ভেঙ্গে ব্যবহার উপযোগী দেখিয়ে এবং রাতের আধারে সেই পাথরের উপরে কিছু নতুন পাথর ফেলে ব্যবহৃত ও নতুন পাথর মিশিয়ে কলম ঢালায় দিয়েছেন এবং সিডিউলে বর্ণিত এফএম বালু ব্যবহার করা হয়নি। উপজেলা সদরে এ ধরনের নিময় বহির্ভূত কাজ সকলের চোখের সামনেই করা হচ্ছে। নাজমুল হোসেন ওরফে সাদ্দাম নামের একজন কার্যসহকারীকে দিয়ে তিনি এ ধরণের দুর্নীতিমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করে চলেছেন।
অভিযোগ মতে, উপজেলার ৯০% কাজের কার্যাদেশ সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত সার্ভেয়ার খালিদ হাসানের (১৬তম গ্রেড) নামে দেন। ১০ম গ্রেডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী থাকা সত্ত্বেও সকল কাজেই ১৬তম গ্রেডের সার্ভেয়ারকে দিয়ে করান এবং ঠিকাদারের সাথে যোগসাজসে নেপথ্যে নিজেই ব্যবসা করেন। মধুমতি নদীর উপর শেখ হাসিনা সেতুতে লাইট স্থাপণের জন্য দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও সেখানে একটি লাইটও স্থাপন না করে নিজেই সমুদয় টাকা তুলে নেন। এছাড়াও কাজ না করে এবং কম কাজ করে সম্পূর্ণ বিল উত্তোলন, প্রকৌশলী আত্বীয়ের নামে লাইসেন্স করে কাজ দিয়ে নিজেই ঠিকাদারি করেন, নিয়ম বহির্ভূতভাবে কার্যসহকারী নাজমুল হোসেন সাদ্দামের স্ত্রীর নামের লাইসেন্সে আংশিক কাজ করে সম্পূর্ণ বিল উত্তোলন, রেটকোড গোপণ করে নিজের লোককে কাজ পাইয়ে দিয়ে নিজেই ঠিকাদারি করেন, মম্মদপুর বাজারের একটি ছোট রাস্তার কাজে অনিয়ম এবং কিছু প্রকল্পের কাজ না করেই টাকা উত্তোলনসহ নানাবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে উপজেলা প্রকৌশলী সাদ্দাম হোসাইনের বিরুদ্ধে। অভিযোগকারী স্থানীয় ঠিকাদারদের দাবি, উপজেলা প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগের বিষয়ে সরেজমিনে সঠিক তদন্ত করা হলে প্রমাণ হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে অভিযোগকারী ও স্থানীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আজমাইন ট্রেডার্সের স্বত্ত্বাধিকারী এস এম শাহরিয়ার শাওন বলেন, ‘উপজেলা প্রকৌশলী বিভিন্নভাবে অনিয়ম ও দুর্নীতি করে আসছেন। আমরা ন্যায় বিচার পেতে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছি।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আশিক এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী হাফিজুর রহমান বলেন, ‘সঠিক তদন্ত করলেই উপজেলা প্রকৌশলীর বিভিন্ন অনিয়ম ও ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়গুলো প্রমাণ হবে। আমি তার শাস্তির দাবি করছি।’
উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বরকত আলী বলেন, উপজেলা প্রকৌশলী আমার নামে ভূয়া প্রত্যয়ন তৈরি করে বিল উত্তলোনের বিষয়ে আমি থানায় জিডি করেছি।
এ বিষয়ে মাগুরার নির্বাহী প্রকৌশলী (এলজিইডি) আ. ন. ম. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘মহম্মদপুর উপজেলার কিছু ঠিকাদার আমাদের প্রধান প্রকৌশলী স্যার বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন। আমাকে অনুলিপি দেওয়া হয়েছে। যেহেতু প্রধান প্রকৌশলী স্যার বরাবর অভিযোগ দেওয়া হয়েছে সেহেতু স্যারের দপ্তর থেকে এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা আসলে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’
উপজেলা প্রকৌশলী সাদ্দাম হোসাইন বলেন, ‘ঠিকাদারদের অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। স্বার্থন্বেষী কতিপয় ঠিকাদার আমাকে এখান থেকে সরাতে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রিন্ট