ড. কামাল হোসেন : আমি মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস বন্দি ছিলাম হরিপুর জেলে। প্রথম দিকে আমার সঙ্গে কয়েদির মতো আচরণ করা হলেও ১৬ ডিসেম্বরের পর আমার প্রতি জেলারের আচরণ রাতারাতি পাল্টে যায়। আমাকে উন্নত খাবার দেওয়া হয়। পাল্টে যায় জেলখানায় আমার সেলের আসবাবপত্র। এরপর ২৪ ডিসেম্বর জেলার বলেন, আমাকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যেখানে গেলে আমার ভালো লাগবে। এরপর ২৮ ডিসেম্বরে হরিপুর জেলখানা থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় রাওয়ালপিন্ডি পুলিশ অ্যাকাডেমির শিহালা গেস্ট হাউজে। সেখানেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়। আমাকে দেখেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এত দেরি করলা ক্যান।
রাহাত মিনহাজ : বঙ্গবন্ধু তো মিয়ানওয়ালি কারাগারে বন্দি ছিলেন। তাকে এই গেস্ট হাউজে কোন প্রেক্ষাপটে আনা হয়েছিল?
ড. কামাল হোসেন : দেখুন, এ. কে. নিয়াজি ছিলেন মিয়ানওয়ালি এলাকার বাসিন্দা। ১৬ ডিসেম্বর নিয়াজির আত্মসমর্পণের পর কারাগারে উত্তেজনা তৈরি হয়। সেখানে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা ছিল। তাই সেখান থেকে জেলার তাকে এই গেস্ট হাউজে নিয়ে এসেছিলেন। সেখানে তিনি কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ছিলেন।
রাহাত মিনহাজ : ওই গেস্ট হাউজে আপনারা কয়েক দিন ছিলেন। সেই সময় আপনারা কী করেছেন?
ড. কামাল হোসেন : গেস্ট হাউজে প্রথম যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয় তখন তিনি রেডিও শুনছিলেন। আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরই তিনি বলেন, কামাল রেডিওটা নাও। বিভিন্ন চ্যানেলের খবর শোনো। আমি তখন বিবিসি, আকাশবাণীসহ বিভিন্ন রেডিওর খবর শুনতাম। পরে আমি সে বিষয়গুলো বঙ্গবন্ধুকে বলতাম। ওই কয়েকদিন আমরা বিদেশি নানা গণমাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন খবর শুনি এবং প্রকৃত অবস্থা বোঝার চেষ্টা করি।
রাহাত মিনহাজ : আমরা যতদূর জানি, ওই গেস্ট হাউজে জুলফিকার আলি ভুট্টো এসেছিলেন। তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কী কথা হয়েছিল?
ড. কামাল হোসেন : সেখানে হঠাৎ করেই একদিন ভুট্টো চলে আসেন। তখন বঙ্গবন্ধু তাকে বলেন, তুমি এখানে কেন। তখন ভুট্টো বলেন, আমি এখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। বঙ্গবন্ধু বলেন, তুমি কীভাবে প্রেসিডেন্ট হলে? সে সময় চতুর ভুট্টো পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করেন। ভুট্টো বলেন, আপনিই আসলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হতেন। আপনিই সংখ্যাগরিষ্ঠদের নেতা। ইত্যাদি ইত্যাদি। সে সময় ভুট্টো আরও বলেন, যা হওয়ার হয়ে গেছে। আপনি কোনো না কোনোভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে একটু হলেও সম্পর্ক রাখেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, সেটা পরে দেখা যাবে। বঙ্গবন্ধু তাকে বলেন, তুমি আমাকে তাড়াতাড়ি দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করো।
রাহাত মিনহাজ : পাকিস্তান ছাড়ার আগে ভুট্টোর দেওয়া এক ডিনারে আপনারা যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে কী ঘটেছিল?
ড. কামাল হোসেন : আসলে ১৬ ডিসেম্বরের পর পাকিস্তানিরা ভীত হয়ে পড়ে। তারা তখন যুদ্ধবন্দি ও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিল। আর ভুট্টো চাচ্ছিলেন কোনোভাবে একটা আপস করতে। সেটা শুধু কাগজে-কলমে বা লোক দেখানো হলেও। আর এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুকে রাজি করাতে ভুট্টো সব সময়ই চেষ্টা করেছেন। ওই ডিনারে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে অনেক কাকুতি-মিনতি করেন। কিছু একটা করার জন্য। যাতে সম্পর্কটা থাকে। তার অবস্থা এমন পর্যায়ের ছিল যে, কোনো একভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য ভুট্টো শুধু বঙ্গবন্ধুর পা ধরা বাকি রেখেছিলেন।
রাহাত মিনহাজ : সে সময় ইরানের শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি পাকিস্তান সফরে আসার কথা ছিল। সে বিষয়টি নিয়ে ভুট্টো কী পরিকল্পনা করেছিলেন?
ড. কামাল হোসেন : ভুট্টো চাচ্ছিলেন কোনো না কোনোভাবে মুজিবের সঙ্গে শাহর একটা সাক্ষাৎ করাতে। বঙ্গবন্ধুর ওপর চাপ সৃষ্টি করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। ডিনারের সময় ভুট্টো শেখ মুজিবকে আবার সে কথা বলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বিষয়টি কঠোরভাবে মোকাবিলা করেন। তিনি বলেন, আমি পাকিস্তানে আর কারও সঙ্গে দেখা করতে চাই না। আমি দেখা করব না। তোমার ইচ্ছা হলে তুমি আমাকে আবার জেলে পাঠাতে পারো। পরে ভুট্টো চুপসে যান। আর কিছু বলেননি। বঙ্গবন্ধু বলেন, আমাদের দ্রুত লন্ডন পাঠানোর ব্যবস্থা করো।
রাহাত মিনহাজ : লন্ডনে পৌঁছে আপনারা কী করলেন?
ড. কামাল হোসেন : লন্ডনে পৌঁছে বঙ্গবন্ধু কলকাতায় থাকা তাজউদ্দীন ও নজরুল ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তাদের কাছ থেকে যুদ্ধের বিভিন্ন কথা শোনেন। তারপর দেশে ফেরার বিষয় নিয়ে কথা বলেন। লন্ডন থেকেই বঙ্গবন্ধু দেশের বিভিন্ন খবরা-খবর আরও বিস্তারিতভাবে নিতে থাকেন। বিদেশি অনেক সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ঘটনা শোনেন।
রাহাত মিনহাজ : সে সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে আপনাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল। তার সঙ্গে সেদিন কী কথা হয়েছিল?
ড. কামাল হোসেন : লন্ডন পৌঁছার পরই ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমরা প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে দেখা করতে যাই। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার আন্তরিক পরিবেশে সাক্ষাৎ হয়। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সহযোগিতার জন্য বঙ্গবন্ধু তাকে ধন্যবাদ জানান। তখন বঙ্গবন্ধুকে হিথ বলেন, আমি কীভাবে আপনাকে সহযোগিতা করতে পারি? বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি দ্রুত দেশে ফিরতে চাই। তখন হিথের রাষ্ট্রীয় কাজের জন্য দুটি বিমান ছিল। তিনি তার সেক্রেটারিকে বিমান দুটির খোঁজ নিতে বলেন। তিনি খোঁজ নিয়ে বলেন, একটি বিমান পরশু ফ্লাইয়ের জন্য আবার তৈরি হয়ে যাবে। তিনি তখন বঙ্গবন্ধুকে ওই বিমানে ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানান। আমরা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বিমানে করেই দিল্লি আসি।
রাহাত মিনহাজ : পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা বা বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর কী ধরনের আবেগ আপনি দেখেছেন?
ড. কামাল হোসেন : গণহত্যার কথা আমরা শিহালা গেস্ট হাউজে থাকার সময়েই শুনেছি। সে সময়ে তিনি অনেক ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দেশের মানুষের কথা বলতেন। আর বলতেন, আমি ভুট্টোকে বলেছিলাম মানুষ মেরে তোমরা পাকিস্তান রাখতে পারবা না। গণহত্যা করে বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। তবে লন্ডনে এসে আমরা গণহত্যার কথা বিস্তারিত জানি। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের কথা শুনি। বঙ্গবন্ধু তখন খুব আফসোস করছিলেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী নিহত হয়েছিলেন তিনি তাদের সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। যখন আমরা লন্ডন থেকে দিল্লির পথে তখনো তিনি তাদের কথা বলে আফসোস করেন। আর একই সঙ্গে বলেন, এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচার তিনি করবেন।
রাহাত মিনহাজ : আপনারা দিল্লিতে পৌঁছে কী করলেন?
ড. কামাল হোসেন : ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর প্লেনে করে আমরা দিল্লি পৌঁছাই ১০ জানুয়ারি দুপুরে। দিল্লিতে পৌঁছে আমরা ইন্দিরা গান্ধী সরকারের কাছে উষ্ণ অভ্যর্থনা পাই। পালাম বিমানবন্দরে ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের রাষ্ট্রপতি ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়। সেখানে বঙ্গবন্ধু একটা সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। তাতে তিনি বাংলাদেশের লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে ধন্যবাদ জানান। একই সঙ্গে বাংলার মুক্তিসংগ্রামে ভারতের ভূমিকার জন্য ইন্দিরা সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। অনেকেই চেয়েছিলেন আমরা যেন দিল্লি হয়ে কলকাতা যাই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু দ্রুত ঢাকা ফিরতে চাইছিলেন। শীতের সন্ধ্যা খুব দ্রুত নামে। তাই তিনি বিকেলেই ঢাকায় আসতে চেয়েছিলেন।
রাহাত মিনহাজ : বাংলাদেশে ক’টার দিকে পৌঁছালেন। এসে আপনি কী দেখলেন?
ড. কামাল হোসেন : ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর প্লেনে আমরা ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করি বিকেল ৩টার দিকে। আমি যতদূর জানি, বঙ্গবন্ধুর আসার খবরে সকাল থেকেই বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স পর্যন্ত এলাকা হাজারো মানুষ ভিড় করেছিলেন। বিমান থেকে নামার পরই তাজ ভাই (তাজউদ্দীন আহমদ) বঙ্গবন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। সেটা ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি একে অপরকে জড়িয়ে কাঁদছেন। কাঁদছে আশপাশের অনেকেই। বিমানবন্দর থেকে একটা ট্রাকে করে বঙ্গবন্ধু চলে যান রেসকোর্সের দিকে। তার পেছনে আর পাশে তখন লাখো জনতা।
সংগৃহীতঃ দেশ রূপান্তর।