অবশেষে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রকাশ্যে ভোটযুদ্ধ শুরু হচ্ছে আজ সোমবার থেকে। প্রতীক পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনের মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়বেন প্রার্থীরা। ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে প্রথম দিনেই শোডাউনের ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছেন অনেক প্রার্থী। এ ছাড়া হেভিওয়েট প্রার্থীদের রয়েছে বিভিন্ন কৌশল। তবে কেউ আচরণবিধি ভঙ্গ করলে কঠোর ব্যবস্থা নেবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
আজ সকল প্রার্থীর মধ্যে নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দ করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে যে ২৮ টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে সেসব দলের প্রার্থীরা নিজ নিজ দলের প্রতীক পাচ্ছেন। যেমন আওয়ামী লীগ নৌকা ও জাতীয় পার্টি লাঙ্গল প্রতীক পাচ্ছে। তবে যারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে নির্বাচন করছেন তারাও নৌকা প্রতীক পাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করলেও কোনো কোনো শরিক দল যেসব আসনে সমঝোতা করছে সেসব আসনে নৌকা প্রতীকে এবং অন্য আসনগুলোতে নিজ নিজ দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আজ আনুষ্ঠানিকভাবে ভোটযুদ্ধ শুরুর প্রথম দিনেই নিজ নিজ সংসদীয় এলাকায় ব্যাপক শোডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছে অনেক প্রার্থী। ইতোমধ্যেই তারা নিজ নিজ দলের নেতাকর্মী, আত্মীয়স্বজন ও কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে অনানুষ্ঠানিক ঘরোয়া বৈঠক করে আজকে শোডাউনের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানায়। আর বিভিন্ন এলাকার বেশ কিছু হেভিওয়েট প্রার্থী ভোটারদের সমর্থন আদায়সহ এলাকাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে, যা আজ থেকে বাস্তবায়ন শুরু করবে। তবে শোডাউন করতে গিয়ে কেউ যেন বিশৃঙ্খলা করতে না পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে।
এদিকে নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ বজায় রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে ইসি। এ ছাড়া আচরণবিধি প্রয়োগ করা হচ্ছে কঠোর হস্তে। কেউ আচরণবিধি ভঙ্গ করলে সঙ্গে সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থা নেবে ইসি। অবশ্য প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রচার শুরুর আগে থেকেই আচরণবিধি ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। ইাতোমধ্যেই বেশ কয়েক হেভিওয়েট প্রার্থীকে কারণ দর্শাও নোটিস দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ক’জন মন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্যও রয়েছেন।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র ১৯ দিন বাকি। ৭ জানুয়ারি এ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হলেও আজ থেকে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত প্রচার চালাতে পারবেন প্রার্থীরা। তাই প্রকাশ্যে ভোটের প্রচারের জন্য সময় আছে মাত্র ১৭ দিন। এ সময়ের মধ্যেই নিজ নিজ সংসদীয় এলাকার ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যেতে হবে প্রার্থীদের।
অর্থাৎ আজ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হচ্ছে ভোটযুদ্ধ। প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় নির্বাচনে বিজয়ের টার্গেট নিয়ে ভোটারদের সমর্থন আদায়ে নানা কৌশল কাজে লাগাবেন। বিভিন্ন দল, সংগঠন ও এলাকার প্রভাবশালীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে ভোটব্যাংক বাড়ানোর জোর তৎপরতা চালাবেন।
এদিকে ৩০০ আসনের মধ্যে ৩২ আসন ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোকে ছেড়েছে ৬টি আসন আর জাতীয় পার্টির সঙ্গে সমঝোতা করে ছেড়েছে আরও ২৬টি আসন। এ ছাড়াও ক’টি ছোট দলের ক’জন প্রার্থীর সঙ্গে গোপন সমঝোতা হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র জানায়।
এবার ৩০০ সংসদীয় আসনে ৫ শতাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে তিন শতাধিক। তারাও নিজ নিজ এলাকায় ভোটারদের সমর্থন পেতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন। তারাসহ সকল স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং নিবন্ধিত ২৮টি দলের সকল প্রার্থী আজ থেকে মাঠে অধিক সক্রিয় হচ্ছেন।
প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার পর এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে নির্বাচনী প্রচারে নতুন মাত্রা পেয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুরু হয়েছে নতুন হিসাব-নিকাশ। কিছু আসনে বিভিন্ন দলের সঙ্গে সমঝোতা হলেও বাকি আসনে কীভাবে ভোটে জেতা যায় সে লক্ষ্য নিয়ে এখন কাজ শুরু করেছে তারা। স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও কৌশল পরিবর্তন করেছে। বিশেষ করে যেসব আসনে সমঝোতার পর আওয়ামী লীগ কিংবা জাতীয় পার্টি আসন ছেড়ে দিয়েছে সেখানকার শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নতুন উদ্যমে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা করছে।
এবার নির্বাচনে সকল প্রার্থী যেন নির্বিঘ্নে ভোটের প্রচার চালাতে পারেন এবং ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন সে জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন ঘিরে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের নেওয়া পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে সকল প্রার্থীর জন্য লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ড তৈরি ও আচরণবিধির যথাযথ প্রয়োগ। ইতোমধ্যেই বেশ ক’জন প্রভাবশালী প্রার্থীকে আচরণবিধি ভঙ্গের দায়ে কারণ দর্শাও নোটিস দিয়ে তা প্রমাণ করেছে ইসি। এর মধ্যে বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী। যার বিরুদ্ধেই অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ভোট গ্রহণের আগ পর্যন্ত এভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত থাকবে।
এবার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিভিন্ন বাহিনীর সাড়ে ৭ লাখ সদস্য নিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে থাকছে ৫ লাখ ১৬ হাজার আনসার। থাকছে ২ হাজার ৩৫০ কোস্ট গার্ড ও ৪৬ হাজার ৮৭৬ বিজিবি; যারা ভোটের ১০ দিন আগে থেকে নেমে ১৩ দিন মাঠে থাকবে। ১ লাখ ৮২ হাজার ৯১ পুলিশ ও র্যাব সদস্য মোতায়েন থাকছে; যারা ভোটের ৫ দিন আগে মাঠে নামবে। এর বাইরে সেনাবাহিনীও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে থাকবে। ৭ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচন। তাই নির্বাচন কশিমন সেনা মোতায়েন করতে চাচ্ছে ২৯ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৩ দিন।
এ ছাড়া ইসির পক্ষ থেকে এবার ভোট কেন্দ্রে সকল প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট নিশ্চিত করা। ভোটগ্রহণের দায়িত্বে নিয়োজিত কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আচরণবিধি মানাতে ৮০২ জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছে, তারা ২৮ নভেম্বর থেকে কাজ শুরু করেছেন।
এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ৩০০ আসনের জন্য ৩০০টি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নির্বাচন কমিশন। সংশ্লিষ্ট আসনে প্রার্থীদের অপরাধ তদন্ত করে আমলে নেওয়ার জন্য এসব কমিটি গঠন করা হয়েছে। ভোটের ফল গেজেট আকারে প্রকাশ করা পর্যন্ত এ কমিটি দায়িত্ব পালন করবে। এই কমিটিতে দায়িত্ব পালন করছেন যুগ্ম জেলা জজ ও সিনিয়র সহকারী জজগণ। নির্বাচনে যারা ভোটগ্রহণের দায়িত্ব পালন করবেন তাদের সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এদিকে ব্যালট বাক্স ছাড়া সকল নির্বাচনী উপকরণও সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে পৌঁছে দিয়েছে ইসি।
এবার নির্বাচন কমিশন একটি স্মার্ট ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ তৈরি করেছে। নির্বাচনে প্রার্থীর তথ্য নিয়ে অপপ্রচার হয়। তাই অপপ্রচার যাচাই করতে কোনো ভোটার যখন প্রার্থী সম্পর্কে জানতে চাইবেন, তখন তারা স্মার্ট ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট অ্যাপে সব দেখতে পারবেন। এ অ্যাপে প্রার্থীর সব তথ্য-প্রমাণ থাকবে। অর্থাৎ অপপ্রচারগুলো যাচাই করে নেওয়া যাবে। এর মাধ্যমে বিভাগওয়ারি আসনগুলোর তথ্য যেমন- মোট ভোটার, মোট আসন, আসনের প্রার্থী, প্রার্থীদর বিস্তারিত তথ্য (হলফনামা, আয়কর সম্পর্কিত তথ্য, নির্বাচনী ব্যয় ও ব্যক্তিগত সম্পদের বিবরণী) জানতে পারবেন। তাই এর মাধ্যমে ভোটাররা যোগ্য প্রার্থী বেছে নিতে পারবেন। এ অ্যাপের ফলে ভোট অনেক স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হবে।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুসারে ৩০ নভেম্বর ছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময়। মনোনয়নপত্র বাছাই হয় ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এতে ৭১৩ জনের প্রার্থিতা বাতিল হলেও আপিলে প্রার্থিতা ফিরে পান ২৮০ জন। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিন ছিল ১৭ ডিসেম্বর রবিবার। আজ ১৮ ডিসেম্বর সোমবার প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ করা হচ্ছে। আর ভোটগ্রহণ ৭ জানুয়ারি সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন ও নারী ভোটার ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন। আর তৃতীয় লিঙ্গের ভোটারের সংখ্যা ৮৫২। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের জন্য আলাদা আলাদা ভোটার তালিকা প্রস্তুত করেছে ইসি। এই তালিকা অনুযায়ী প্রতিটি সংসদীয় আসনের ভোটগ্রহণ করা হবে। এবার ৩০০টি সংসদীয় আসনে ভোটকেন্দ্র থাকছে ৪২ হাজার ৩৮০টি। আর ভোটকক্ষ থাকছে দুই লাখ ৬১ হাজার ৬৬৮টি। ৩০০ আসনে নির্বাচনের জন্য ৬৬ রিটার্নিং অফিসার এবং ৫৯২ সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ভোটকক্ষের জন্য একটি করে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স রাখা হবে। এছাড়া প্রতিকেন্দ্রে একটি করে অতিরিক্ত ব্যালট বাক্স রাখা হবে। সে হিসাবে সংসদ নির্বাচনে তিন লাখের বেশি স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স প্রয়োজন হবে। ভোটগ্রহণের জন্য এবার দশ লাখ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। যাদের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
প্রিন্ট