ঢাকা , বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০২৫, ১৯ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
Logo বোয়ালমারীতে সেপ্টিক ট্যাঙ্কি খুঁড়তে গিয়ে বালু চাপায় শ্রমিকের মৃত্যু Logo স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকে হামলার অভিযোগ তুলে ৪ বাড়িতে ভাংচুর Logo কেউ আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসিত করতে পাববেনাঃ -আব্দুল হান্নান মাসউদ Logo রাঘববোয়ালদের আটক না করে অস্ত্র উদ্ধারের নামে নাটক করেছে প্রশাসনঃ -আবুল কালাম আজাদ Logo লালপুরে আওয়ামীলীগ ও বিএনপি সংঘর্ষের ঘটনায় ১৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা Logo বাঘায় হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নি সংযোগের প্রতিবাদে জামায়াতের বিক্ষোভ-সমাবেশ Logo বাঘায় ঈদের আনন্দ শোকে পরিনত বিএনপি নেতা কচির পরিবারে Logo কুষ্টিয়ায় অস্ত্র ও গুলিসহ ৫ জন আটক Logo হাতিয়ায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে মানববন্ধন Logo আজ ৩০শে মার্চ লালপুরের ঐতিহাসিক ‘ময়না যুদ্ধ দিবস’
প্রতিনিধি নিয়োগ
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা পত্রিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আপনি আপনার এলাকায় সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন।

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক রাষ্ট্রদূত এম. হোসেন আলী

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশের মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী এবং প্রথম কুটনীতিক, যিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে ৬৫ জন বাঙালী সহকর্মী নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি হলেন পাবনার কৃতিসন্তান রাষ্ট্রদূত এম. হোসেন আলী। এই ঘটনাটি তৎকালীন সময়ে খুবই আলোচিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের একটি মাইলফলক হিসেবে পরিগনিত হয়।

 

১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইটের লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা এবং একই দিন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করলে মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ১০ এপ্রিল ভারতের মাটিতে প্রবাসী সরকার গঠনের ঘোষনা এবং ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় ( মুজিবনগর ) প্রবাসী সরকার শপথ গ্রহন করার পর ১৮ এপ্রিল কলকাতায় অবস্থিত পাকিস্তানের উপ-দুতাবাসের ডিপুটি হাইকমিশনার এম. হোসেন আলী তাঁর অফিস থেকে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। তাঁর অধীনস্থ ৬৫ জন বাঙালী কর্মকর্তা কর্মচারী বাংলাদেশের পক্ষ অবলম্বন করেন।

 

উল্লেখিত ঘটনার পর প্রবাসী মুজিবনগর সরকার কলকাতার হাই কমিশনকে বাংলাদেশ মিশন নামকরন করে এম. হোসেন আলীকে জৈষ্ঠ কুটনীতিক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িতরা সবাই জানেন, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদানের কথা। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ মিশন ছিল প্রবাসী সরকারের প্রধান কেন্দ্রস্থল। এখান থেকেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করা হতো। বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ শরনার্থীর আশ্রয় প্রদান, তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা সহ প্রয়োজনীয় সকল সামগ্রী সরবরাহে ব্যবস্থা গ্রহন করা এবং পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র প্রদানের ব্যবস্থা করা সহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমর্থন, সহযোগিতা এবং কুটনৈতিক তৎপরতার সব কিছু পরিচালিত হতো কলকাতার পার্ক ষ্ট্রীটে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশন থেকে। আর এই সকল কর্মকান্ডের নেপথ্য কারিগর ছিলেন, বাংলাদেশ মিশন প্রধান এম. হোসেন আলী। উনি ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত ছিলেন, সকল বিতর্কের উর্ধে।

 

সফল কুটনীতিক রাষ্ট্রদূত এম. হোসেন আলী ১৯২৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারী পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার পার ভাঙ্গুড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। পিতার নাম তাহের মাহমুদ। অত্যন্ত মেধাবী এই কৃতি সন্তান ১৯৪৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে এমএসসি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৪৮ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি সম্পন্ন করেন। ১৯৪৯ সালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ন হয়ে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগদান করেন।

 

পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগদানের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত ফরেন সার্ভিস ইনস্টিটিউটে আন্তর্জাতিক আইন ও কুটনীতি শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন। তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরেও কুটনীতি বিষয়ে প্রশিক্ষন গ্রহন করেন। এছাড়া ফ্রান্সের প্যারিসে ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশন্যাল রিলেশন্স থেকে কুটনীতি বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রী অর্জন করেন। চাকুরী জীবনে তিনি ভারত, তুরস্ক, বেলজিয়াম, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ড, মায়ানমার, অষ্ট্রেলিয়া, জার্মান ও কানাডাতে কুটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন।

 

১৯৭০ সালে কুটনীতিক এম. হোসেন আলী কলকাতায় পাকিস্তান হাই কমিশনে ডিপুটি হাইকমিশনার নিযুক্ত হন। ৭০ এবং ৭১ এর শুরুতে পাকিস্তানী শাসকদের কর্মকান্ড তাঁর মনে তীব্র ভাবে আঘাত করে। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের নামে সেনাবাহিনী কর্তৃক লক্ষ লক্ষ নীরিহ বাঙালী হত্যার কারনে এম. হোসেন আলীর মনে বিদ্রোহ জেগে উঠে। কি করবেন সে বিষয়ে তখনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। তখন দুতাবাসে বাঙালী অবাঙালী মিলিয়ে ১০৫ জন কর্মকর্তা কর্মচারী ছিলেন। তিনি সহ বাঙালী ছিলেন ৬৫ জন। পরিবার সহ বাঙালী কর্মকর্তা কর্মচারীদের সাথে গোপন আলাপ আলোচনা করতে থাকেন। তাঁরা নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন, পাকিস্তান সরকারের অধীনে তাঁরা চাকুরী করবেন না। ইতিমধ্যে ১০ এপ্রিল ভারতে আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ প্রবাসী সরকার গঠনের ঘোষনা দেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রবাসী সরকার শপথ গ্রহন করলে রাতেই এম. হোসেন আলী সিদ্ধান্ত নেন, আগামীকাল সকালেই বাঙালীরা বিদ্রোহ করে অবাঙালীদের বের করে দুতাবাস দখল করবেন এবং প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষনা করবেন।

 

১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রবাসী সরকার শপথ নেওয়ার পরেই রাষ্ট্রদূত এম, হোসেন আলী গোপনীয়তার সাথে বাঙালী কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন। বাইরে থেকে লাল, সবুজ এবং সোনালী রংয়ের কাপড় সংগ্রহ করে তাঁর বাসভবনে বসে তাঁর স্ত্রী বেগম ফয়জুন্নেছা এবং দুই কন্যা জলি ও ইয়াসমিন মিলে মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকাটি তৈয়ারী করেন। (পতাকাটি এখনো ঢাকা যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে)। এরপর সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৮ এপ্রিল সকালে এম. হোসেন আলীর নেতৃত্বে বাঙালীরা বিদ্রোহ করেন। অবাঙালীদের ভবন থেকে বের করে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে ভবনের শীর্ষস্থানে উড্ডয়নরত পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে “আমার সোনার বাংলা – আমি তোমায় ভালবাসি ” জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। সৃষ্টি হয় মহান মুক্তিযুদ্ধের একটি গৌরবময় ইতিহাস। বিদেশের মাটিতে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন এবং পাশাপাশি আরেকটি ইতিহাস অংকিত হয় প্রথম কুটনীতিক হিসেবে এম. হোসেন আলী সহ ৬৫ জন বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করায় ।

 

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হলো। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। ১০ জানুয়ারী ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলেন। রাষ্ট্রদূত এম. হোসেন আলীকে দেশে তলব করা হলো। নবগঠিত সরকার এম. হোসেন আলীকে তথ্য ও বেতার মন্ত্রনালয়ে সচিব হিসেবে নিয়োগ করলেন। এরপর মার্চ মাসে এম. হোসেন আলীকে অষ্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাই কমিশনার হিসেবে পাঠানো হলো। অষ্ট্রেলিয়া থাকাকালীন তাঁকে নিউজিল্যান্ড এবং ফিজিতে মিশন প্রধান হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালে জানুয়ারী মাসে এম. হোসেন আলীকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত পশ্চিম জার্মানীতে রাষ্ট্রদূত ছিলেন। এরপর ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত কানাডায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। এটাই তাঁর কর্মজীবনের শেষ সময়কাল।

 

১৯৮১ সালে ২ জানুয়ারী কানাডায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে চাকুরীরত অবস্থায় মৃত্যুবরন করেন। এরপর তাঁকে কানাডার অটোয়াতে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুকালে তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে রেখে গেছেন। জানা যায় তাঁর স্ত্রী ২০১৪ সালে মৃত্যুবরন করেছেন। তাঁর বড় ছেলে আরিফ অষ্ট্রেলিয়ায় এবং ছোট ছেলে জ্যাক কানাডায় বসবাস করছেন। দুই মেয়ে কানাডায় থাকেন। পরিতাপের বিষয় আজও জানা যায়নি – মহান মুক্তিযুদ্ধের এই সেনানী বীর মুক্তিযোদ্ধা এম হোসেন আলীকে কেন কানাডায় সমাহিত করা হলো? আজও জানা যায়নি এই মহান যোদ্ধাকে দেশ এবং সরকার কেন আজও মুল্যায়ন করেনি। অকুতোভয় এই যোদ্ধা যিনি দেশের জন্য যুদ্ধ করলেন আর সেই যোদ্ধা তাঁর মৃত্যুর পর নিজ দেশ বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় পেলেন না।

 

হে বীর আমাদের ক্ষমা করো। এই জাতিকে – এই দেশকে ক্ষমা করো । এই দেশ তোমাকে যথার্থ সন্মান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তুমি নাই – তবুও আছো, বাংলার মানুষের হৃদয়ে। ইতিহাসের পাতায় তুমি বেঁচে থাকবে – যতদিন বাংলাদেশ থাকবে। পরিশেষে তোমাকে লাল সবুজের ভালবাসা এবং রক্তিম অভিবাদন।

লেখক পরিচিত –
আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।


প্রিন্ট
Tag :
এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

বোয়ালমারীতে সেপ্টিক ট্যাঙ্কি খুঁড়তে গিয়ে বালু চাপায় শ্রমিকের মৃত্যু

error: Content is protected !!

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক রাষ্ট্রদূত এম. হোসেন আলী

আপডেট টাইম : ১০:৫৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ এপ্রিল ২০২০
শুভাশীষ ভট্টাচার্য্য তুষার, পাবনা প্রতিনিধিঃ :

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশের মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী এবং প্রথম কুটনীতিক, যিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে ৬৫ জন বাঙালী সহকর্মী নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি হলেন পাবনার কৃতিসন্তান রাষ্ট্রদূত এম. হোসেন আলী। এই ঘটনাটি তৎকালীন সময়ে খুবই আলোচিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের একটি মাইলফলক হিসেবে পরিগনিত হয়।

 

১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইটের লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা এবং একই দিন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করলে মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ১০ এপ্রিল ভারতের মাটিতে প্রবাসী সরকার গঠনের ঘোষনা এবং ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় ( মুজিবনগর ) প্রবাসী সরকার শপথ গ্রহন করার পর ১৮ এপ্রিল কলকাতায় অবস্থিত পাকিস্তানের উপ-দুতাবাসের ডিপুটি হাইকমিশনার এম. হোসেন আলী তাঁর অফিস থেকে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। তাঁর অধীনস্থ ৬৫ জন বাঙালী কর্মকর্তা কর্মচারী বাংলাদেশের পক্ষ অবলম্বন করেন।

 

উল্লেখিত ঘটনার পর প্রবাসী মুজিবনগর সরকার কলকাতার হাই কমিশনকে বাংলাদেশ মিশন নামকরন করে এম. হোসেন আলীকে জৈষ্ঠ কুটনীতিক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িতরা সবাই জানেন, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদানের কথা। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ মিশন ছিল প্রবাসী সরকারের প্রধান কেন্দ্রস্থল। এখান থেকেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করা হতো। বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ শরনার্থীর আশ্রয় প্রদান, তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা সহ প্রয়োজনীয় সকল সামগ্রী সরবরাহে ব্যবস্থা গ্রহন করা এবং পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র প্রদানের ব্যবস্থা করা সহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমর্থন, সহযোগিতা এবং কুটনৈতিক তৎপরতার সব কিছু পরিচালিত হতো কলকাতার পার্ক ষ্ট্রীটে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশন থেকে। আর এই সকল কর্মকান্ডের নেপথ্য কারিগর ছিলেন, বাংলাদেশ মিশন প্রধান এম. হোসেন আলী। উনি ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত ছিলেন, সকল বিতর্কের উর্ধে।

 

সফল কুটনীতিক রাষ্ট্রদূত এম. হোসেন আলী ১৯২৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারী পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার পার ভাঙ্গুড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। পিতার নাম তাহের মাহমুদ। অত্যন্ত মেধাবী এই কৃতি সন্তান ১৯৪৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে এমএসসি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৪৮ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি সম্পন্ন করেন। ১৯৪৯ সালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ন হয়ে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগদান করেন।

 

পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগদানের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত ফরেন সার্ভিস ইনস্টিটিউটে আন্তর্জাতিক আইন ও কুটনীতি শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন। তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরেও কুটনীতি বিষয়ে প্রশিক্ষন গ্রহন করেন। এছাড়া ফ্রান্সের প্যারিসে ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশন্যাল রিলেশন্স থেকে কুটনীতি বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রী অর্জন করেন। চাকুরী জীবনে তিনি ভারত, তুরস্ক, বেলজিয়াম, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ড, মায়ানমার, অষ্ট্রেলিয়া, জার্মান ও কানাডাতে কুটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন।

 

১৯৭০ সালে কুটনীতিক এম. হোসেন আলী কলকাতায় পাকিস্তান হাই কমিশনে ডিপুটি হাইকমিশনার নিযুক্ত হন। ৭০ এবং ৭১ এর শুরুতে পাকিস্তানী শাসকদের কর্মকান্ড তাঁর মনে তীব্র ভাবে আঘাত করে। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের নামে সেনাবাহিনী কর্তৃক লক্ষ লক্ষ নীরিহ বাঙালী হত্যার কারনে এম. হোসেন আলীর মনে বিদ্রোহ জেগে উঠে। কি করবেন সে বিষয়ে তখনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। তখন দুতাবাসে বাঙালী অবাঙালী মিলিয়ে ১০৫ জন কর্মকর্তা কর্মচারী ছিলেন। তিনি সহ বাঙালী ছিলেন ৬৫ জন। পরিবার সহ বাঙালী কর্মকর্তা কর্মচারীদের সাথে গোপন আলাপ আলোচনা করতে থাকেন। তাঁরা নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন, পাকিস্তান সরকারের অধীনে তাঁরা চাকুরী করবেন না। ইতিমধ্যে ১০ এপ্রিল ভারতে আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ প্রবাসী সরকার গঠনের ঘোষনা দেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রবাসী সরকার শপথ গ্রহন করলে রাতেই এম. হোসেন আলী সিদ্ধান্ত নেন, আগামীকাল সকালেই বাঙালীরা বিদ্রোহ করে অবাঙালীদের বের করে দুতাবাস দখল করবেন এবং প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষনা করবেন।

 

১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রবাসী সরকার শপথ নেওয়ার পরেই রাষ্ট্রদূত এম, হোসেন আলী গোপনীয়তার সাথে বাঙালী কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন। বাইরে থেকে লাল, সবুজ এবং সোনালী রংয়ের কাপড় সংগ্রহ করে তাঁর বাসভবনে বসে তাঁর স্ত্রী বেগম ফয়জুন্নেছা এবং দুই কন্যা জলি ও ইয়াসমিন মিলে মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকাটি তৈয়ারী করেন। (পতাকাটি এখনো ঢাকা যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে)। এরপর সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৮ এপ্রিল সকালে এম. হোসেন আলীর নেতৃত্বে বাঙালীরা বিদ্রোহ করেন। অবাঙালীদের ভবন থেকে বের করে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে ভবনের শীর্ষস্থানে উড্ডয়নরত পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে “আমার সোনার বাংলা – আমি তোমায় ভালবাসি ” জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। সৃষ্টি হয় মহান মুক্তিযুদ্ধের একটি গৌরবময় ইতিহাস। বিদেশের মাটিতে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন এবং পাশাপাশি আরেকটি ইতিহাস অংকিত হয় প্রথম কুটনীতিক হিসেবে এম. হোসেন আলী সহ ৬৫ জন বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করায় ।

 

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হলো। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। ১০ জানুয়ারী ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলেন। রাষ্ট্রদূত এম. হোসেন আলীকে দেশে তলব করা হলো। নবগঠিত সরকার এম. হোসেন আলীকে তথ্য ও বেতার মন্ত্রনালয়ে সচিব হিসেবে নিয়োগ করলেন। এরপর মার্চ মাসে এম. হোসেন আলীকে অষ্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাই কমিশনার হিসেবে পাঠানো হলো। অষ্ট্রেলিয়া থাকাকালীন তাঁকে নিউজিল্যান্ড এবং ফিজিতে মিশন প্রধান হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালে জানুয়ারী মাসে এম. হোসেন আলীকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত পশ্চিম জার্মানীতে রাষ্ট্রদূত ছিলেন। এরপর ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত কানাডায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। এটাই তাঁর কর্মজীবনের শেষ সময়কাল।

 

১৯৮১ সালে ২ জানুয়ারী কানাডায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে চাকুরীরত অবস্থায় মৃত্যুবরন করেন। এরপর তাঁকে কানাডার অটোয়াতে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুকালে তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে রেখে গেছেন। জানা যায় তাঁর স্ত্রী ২০১৪ সালে মৃত্যুবরন করেছেন। তাঁর বড় ছেলে আরিফ অষ্ট্রেলিয়ায় এবং ছোট ছেলে জ্যাক কানাডায় বসবাস করছেন। দুই মেয়ে কানাডায় থাকেন। পরিতাপের বিষয় আজও জানা যায়নি – মহান মুক্তিযুদ্ধের এই সেনানী বীর মুক্তিযোদ্ধা এম হোসেন আলীকে কেন কানাডায় সমাহিত করা হলো? আজও জানা যায়নি এই মহান যোদ্ধাকে দেশ এবং সরকার কেন আজও মুল্যায়ন করেনি। অকুতোভয় এই যোদ্ধা যিনি দেশের জন্য যুদ্ধ করলেন আর সেই যোদ্ধা তাঁর মৃত্যুর পর নিজ দেশ বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় পেলেন না।

 

হে বীর আমাদের ক্ষমা করো। এই জাতিকে – এই দেশকে ক্ষমা করো । এই দেশ তোমাকে যথার্থ সন্মান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তুমি নাই – তবুও আছো, বাংলার মানুষের হৃদয়ে। ইতিহাসের পাতায় তুমি বেঁচে থাকবে – যতদিন বাংলাদেশ থাকবে। পরিশেষে তোমাকে লাল সবুজের ভালবাসা এবং রক্তিম অভিবাদন।

লেখক পরিচিত –
আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।


প্রিন্ট