ঢাকা , সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
Logo লন্ডনে শহীদ জননীর জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান Logo কালুখালী উপজেলা বিএনপির সম্মেলনে সভাপতি লুৎফর, সম্পাদক রুমা নির্বাচিত Logo জনসমর্থন না থাকায় বিএনপি নির্বাচন থেকে দূরে থাকছে – হানিফ Logo কর্মবিরতিতে কুষ্টিয়া পল্লী বিদ্যুতের কর্মচারীরা Logo নাটোরের লালপুরে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস এর গণহত্যা দিবস আজ Logo ভাঙ্গায় সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অংশীজনদের সাথে মতবিনিময় সভা Logo বোয়ালমারীতে ট্রেনে কাটা পড়ে কৃষকের মৃত্যু Logo মাগুরা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ উদ্বোধন Logo মধুখালী উপজেলা নির্বাচন, ভোটারদের দ্বারে দ্বারে প্রার্থীরা Logo সদরপুরে সার্বজনীন পেনশন স্কিম এর কর্মশালা ও স্পট রেজিস্ট্রেশন অনুষ্ঠিত
প্রতিনিধি নিয়োগ
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা পত্রিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আপনি আপনার এলাকায় সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন।

কাটছে সংকট

ডলারের দাম আরও কমার আভাস

৯০ কোটি ডলার বিদেশী বিনিয়োগ বাংলাদেশে এসেছে।

দেশে চলমান ডলার সংকট কেটে যাচ্ছে। শক্তিশালী হতে যাচ্ছে টাকা। এরই মধ্যে ৫০ পয়সা কমানো হয়েছে ডলারের দর। একই সঙ্গে সরবরাহ ক্রমাগত বৃদ্ধি ও দাম আরও কমে আসার আভাসও মিলছে। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বাজারে ডলারের দামে নৈরাজ্যের মধ্যে এ দাম কমানোর উদ্যোগকে আগামী অর্থনীতির জন্য স্বস্তির বার্তা বলে উল্লেখ করেছেন অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী নেতা ও সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল।

তারা বলছেন, এমনটিই হওয়ার ছিল। কারণ, দেশে বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি কমে এসেছে। একইভাবে ঋণাত্মক অবস্থা থেকে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স বা চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও এখন সেপ্টেম্বরের হিসাবে ১ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্তে ফিরে এসেছে। নানামুখী পদক্ষেপের কারণে আগামীতে চলতি হিসাবের ভারসাম্য ইতিবাচক অবস্থাতেই থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।

 

স্বস্তির খবর হচ্ছে—ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার প্রতিশ্রুত ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ঋণ ছাড় হতে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, আইডিবিসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থাগুলোর প্রতিশ্রুত ও পুঞ্জীভূত ঋণের অর্থ ছাড়ের গতি ও ধারাবাহিকতা বাড়তে থাকবে। এ নিয়ে সরকার দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে অব্যাহতভাবে দেনদরবার করে যাচ্ছে। তদুপরি সরকারও এ মুহূর্তে বৈদেশিক ঋণনির্ভর প্রকল্পগুলোতেই বেশি জোর দিচ্ছে। ফলে বিভিন্ন দেশ ও উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে গত চার মাসে নতুন করে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে ৪৬২ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের। একইভাবে এই সময় উন্নয়ন সহযোগীরা ছাড় করেছে ১৬২ কোটি ৬১ লাখ ডলারের ঋণ।

 

এদিকে সংকট কাটিয়ে প্রণোদনায় ভর করে এরই মধ্যে অক্টোবরে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহের হারও বেড়েছে। এ মাসে প্রবাসীরা ১.৯৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা গত চার মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যৌক্তিক কারণেই আগামীতে রেমিট্যান্স প্রবাহের হার বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। এর বিপরীতে ধারাবাহিকভাবে আমদানি কমছে লক্ষণীয়ভাবে। এতেও ডলারের সাশ্রয় হচ্ছে। রপ্তানিও আছে প্রবৃদ্ধির ধারায়। এর পাশাপাশি আগামী ৭ জানুয়ারির পর নির্বাচনী অনিশ্চয়তা কেটে গেলে দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রবণতা বাড়বে। এতে বেসরকারি স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রবৃদ্ধিও গতিশীল হবে। এর সবকিছুর হিসাব ডলারে সমন্বয় হবে এবং এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়বে।

জানা গেছে, ঘাটতির কারণে বর্তমানে ২১ ব্যাংক ডলার সংকটে রয়েছে, আর ৩৯টি ব্যাংক রয়েছে উদ্বৃত্তে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক, ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) দায়িত্বশীলরা আভাস দিয়েছেন—সামনে ডলারের দাম ক্রমাগত কমতে থাকবে। সে ধরনের পরিস্থিতি এখন দেশে তৈরি হয়েছে। এখন দরকার পরিকল্পিত ছক ধরে এগোনোর। তাহলে অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলারের সরবরাহ ঘাটতি দূর হবে। সরবরাহ বাড়বে। এতে কার্ব মার্কেটেও দামও কমে আসবে, যার প্রভাব অত্যাবশ্যকীয় ভোগ্যপণ্য, মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামালের আমদানিতে পড়বে। এতে এলসি জটিলতা দূর হবে এবং ডলারের দাম কমার দরুন গতি আসবে ব্যবসা-বাণিজ্যে, যা এই সময়ের অর্থনীতির জন্য চরম স্বস্তিদায়ক বার্তা।

 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম জানান, অসহনীয় মূল্যস্ফীতিসহ অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে আজকের যে চক্রাকার সমস্যা তৈরি হয়েছে, তার প্রধানতম কারণ হচ্ছে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ঘাটতি। এতে ডলার দুর্লভ হয়ে উঠেছে এবং দাম বেড়েছে লাগামহীন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। ভুক্তভোগী হয়েছে ক্রেতা-ভোক্তা। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ডলারের দাম কমে আসা নিঃসন্দেহে অর্থনীতির জন্য সুখবর। এটা ধারাবাহিকভাবে কমলে এর উপকারভোগী হবে দেশই। এতে ব্যবসায় ডলার নামক আতঙ্ক ও জটিলতা কমবে, এলসির গতি বাড়বে।

 

তিনি বলেন, বৈদেশিক ঋণের ছাড়, রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি ও রপ্তানি আয়ে ধারাবাহিক গতিশীলতা ধরে রাখতে হবে। একই সঙ্গে আমদানিতে বিলাস দ্রব্য কিংবা এ মুহূর্তের অর্থনীতিতে যেটার দরকার নেই, তার আমদানি কঠোরভাবে রোধ করতে হবে। তবেই ডলার সাশ্রয় হবে। এর সঙ্গে বিদেশ থেকে ডলার আসতে থাকলে রিজার্ভ পরিস্থিতিরও উন্নতি ঘটবে। আর এসব পদক্ষেপ সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংককেই সুচারুভাবে পালন করতে হবে। তবেই ডলারের চলমান ঊর্ধ্বগতিকে ধারাবাহিকভাবে দমানো সম্ভব হবে।

 

অর্থ মন্ত্রণালয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, বিশ্বব্যাংক, জাইকা, এডিবি, আইডিবিসহ কিছু দাতা সংস্থা ও দেশ থেকে সরকার ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার আশা করছে।

 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, প্রবাসীরা সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে ৪৮.২০ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১.৩৩ বিলিয়ন ডলার, যা ছিল গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ ছাড়া চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে দেশে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়েছে মোট ১ হাজার ৪৭৪ কোটি ৯০ লাখ (১৪.৭৫ বিলিয়ন) ডলারের। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ১৯ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সবশেষ অক্টোবরের মাসওয়ারি রপ্তানি আয়ের হিসাবে গত চার মাসে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ।

 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী স্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, সরকার চলমান অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে পরিকল্পভাবে গুচ্ছ পদক্ষেপ নিয়ে এগোচ্ছে। সেই পদক্ষেপেরই একটা সুফল হলো চলতি হিসাবের ভারসাম্যকে উদ্বৃত্তের ধারায় ফিরে আনা। সার্বিক পরিস্থিতি বলছে, এটা আর ঋণাত্মক বা নেতিবাচক হবে না। যাতে না হয়, সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক তা নিবিড়ভাবে মনিটরিংও করছে বলে তারা উল্লেখ করেন।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডলার সংকটে আমদানির জন্য এলসি খুলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। ডলারের জন্য বিভিন্ন ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন আমদানিকারকরা। এমন পরিস্থিতির মধ্যে ডলারের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। এ উদ্যোগের আওতায় রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম ৫০ পয়সা কমিয়ে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন থেকে রেমিট্যান্স ও রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতি ডলারে পাওয়া যাবে ১১০ টাকা। আর আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করা হবে ১১০ টাকা ৫০ পয়সায়।

ডলারের দাম যদি সত্যিকার অর্থে কমে তাহলে তো খুব ভালো কথা, এমন মন্তব্য করে বেসরকারি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এ উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন। তবে দাবি করেন, বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় সেটি একেবারেই কাগুজে ও নির্বাচনী উদ্যোগ বলে মনে হচ্ছে, যার প্রভাব বাজারে পড়বে না। কারণ, সেখানে এখনো ডলারের দাম ১২৩-২৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

 

এ বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ডলারের দাম কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। যেটা কমানো হয়েছে, সেটা সরকারিভাবে কমানো হয়েছে; কিন্তু বাজারে তো কমেনি। বর্তমানে এই দরে কেউ কেনাবেচা করছেন না। নির্বাচনের আগে একটা চাঞ্চল্যকর পরিবেশ তৈরি করার জন্যই সরকার এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, অর্থনীতির মৌলিক বিষয়ের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে হলে রিজার্ভ বাড়াতে হবে এবং ডলারের প্রবাহ বাড়াতে হবে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। টাকা পাচার কমাতে হবে। সেগুলো না হলে ডলারের প্রবাহ বাড়বে না। বাফেদা যে দর নির্ধারণ করেছে সেটা স্থায়ী হবে বলে মনে করেন না তিনি। তবে আশার বিষয় হচ্ছে আগামী ডিসেম্বরে আইএমএফের ঋণ পাওয়া যাবে। বিশ্বব্যাংক ও জাইকা থেকেও ঋণ পাওয়া যাবে। আবার একই সময়ে আমাদের দায়ও পরিশোধ করতে হবে। তিনি বলেন, চলতি হিসাবে আমাদের কিছুটা উদ্বৃত্ত রয়েছে, সেটা ভালো দিক। যদিও আর্থিক হিসাবে এখনো বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে গেছে। ফলে সেটাকে কমাতে হলে সেখানেও কাজ করতে হবে।

 

বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম এ বিষয়ে বলেন, আমাদের চলতি হিসাবে ঘাটতি কাটিয়ে এখন উদ্বৃত্ত হয়েছে। দেড় বছর আগেও প্রায় ১৮ বিলিয়ন ঘাটতি ছিল। বর্তমানে প্রায় ৯ বিলিয়ন উদ্বৃত্ত রয়েছে। সেই হিসাবে বাজারে ডলারের সংকট থাকার কথা নয়। বর্তমানে ডলার বাজারের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, সেটি প্রকৃত চিত্র নয়। তিনি আরও বলেন, এখন বাজারে ডলারের দর বাড়ার যে প্রবণতা, সেটি থাকার কোনো কারণ নেই।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, গতকাল বাফেদা ডলারের দাম ৫০ পয়সা কমিয়ে টাকাকে শক্তিশালী করেছে। মূলত বৈদেশিক মুদ্রার দাম নির্ধারিত হয় এর চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে। চাহিদার মূল ক্ষেত্র হচ্ছে আমাদের যেটা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, সেটার মূল্য পরিশোধ এবং আমাদের যে বৈদেশিক ঋণ এবং অন্যান্য দায়দেনা আছে, সেগুলোর পরিশোধও চাহিদার অংশ। গত কয়েক মাসে আমরা চাহিদার দিকটা খুব ভালোভাবে মনিটর করেছি। অর্থাৎ যেসব পণ্য এবং সেবা আসার কথা সেটা সঠিক মূল্যে আসছে কি না অর্থাৎ চাহিদাটা যেন সঠিক থাকে। এ ছাড়া অপ্রয়োজনীয় যেসব পণ্য এবং সেবা আছে, সেগুলোকেও কিছুটা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। একই সময়ে বিশ্ববাজারে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছিল। সব মিলিয়ে গত বছর আমাদের চাহিদা অনেক বেশি ছিল। যেটা গত কয়েক মাসে মনিটরিং করে একটা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে এসেছি। এ কারণে চলতি হিসাবে এক বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত আছে।

 

আমাদের আর্থিক হিসাব এখনো কিছুটা ঋণাত্মক হলেও সেটা ধীরে ধীরে সহনীয় পর্যায়ে চলে আসছে। আমাদের যে ফিন্যান্সিয়াল অবলিগেশনগুলো আছে, শর্টটাইম যে ডেটটা আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরে ছিল সেটা কমে ১৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে, যা ২০২২ এ ছিল সেটা গত সেপ্টেম্বরে ১২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বর্তমানে সেটা ৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার রয়েছে। আগামী দিনে এ দায় পরিশোধ আরও কমে আসবে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে সেটা হবে মাত্র ৪৯ মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া আগামী দিনে আমাদের খুব বেশি দায় তৈরি হবে না, কারণ বর্তমানে যেসব এলসি খোলা হচ্ছে, সেগুলোর বেশিরভাগই তাৎক্ষণিক এলসি। বর্তমানে বিশ্ববাজারে সুদের হার অনেক বেশি হওয়ায় ডেফার্ড পেমেন্টে (বিলম্ব পরিশোধে) যেতে পারছি না। তাই বর্তমানে বেশিরভাগ এলসি অ্যাট সাইটে বা তাৎক্ষণিক ভাবে পরিশোধ করতে হচ্ছে। আর এ দায় কমার কারণেই চলতি এবং আর্থিক হিসাব ইতিবাচক হচ্ছে।

 

অন্যদিকে জোগানের দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, জোগানের অন্যতম খাত রপ্তানিকারকদের রপ্তানি আয় সময়মতো প্রত্যাবাসিত হচ্ছে কি না। সেখানে দেখা যায়, ২০২২ সালের জুনে আমাদের বকেয়া অপ্রত্যাবাসিত রপ্তানি আয় ছিল ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, যা বর্তমানে কমে দাঁড়িয়েছে ১ বিলিয়ন ডলারে। আমাদের সার্বিক রপ্তানি আয় ৫০ বিলিয়নের ওপরে হয়ে থাকে। এর একটা অংশ সবসময়েই বকেয়া থাকে। সেই বকেয়া রপ্তানি আয়ও অনেকাংশে কমে এসেছে এবং বর্তমানে সেটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে।

 

এ ছাড়া রেমিট্যান্সেও আমরা এখন পর্যন্ত ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে রয়েছি। চলতি মাসের এই পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, যা গত মাসের একই সময়ে ছিল ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আমাদের চাহিদা এবং জোগান দুদিকেই বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, যা আগামী দিনে আরও ইতিবাচক হবে।

 

এ ছাড়া বর্তমানে ব্যাংকগুলোর নেট ওপেন পজিশনও ইতিবাচক অবস্থায় রয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে যেখানে ব্যাংকগুলো ৪২৫ মিলিয়ন ডলার ঘাটতিতে বা শর্টে ছিল, এই বছরের একই সময়ে সেটা ১৯২ মিলিয়ন উদ্বৃত্ত বা লং পজিশনে রয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর চাহিদার চেয়ে ডলার বেশি কেনা রয়েছে। গতবছর ৩১টি ব্যাংকে এই লং পজিশন ছিল, যা এই বছর ৩৯টি ব্যাংক লং পজিশনে রয়েছে। সেক্ষেত্রে জোগানের ক্ষেত্রেও একটা বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। অর্থাৎ চাহিদা এবং জোগানের প্রতিটি দিক মিলিয়ে বর্তমানে আমরা একটা ইতিবাচক অবস্থায় রয়েছি, যা আগামী দিনেও অব্যাহত থাকবে। সেই বিবেচনায় বাফেদা গতকাল ডলারে দাম কমিয়ে টাকাকে শক্তিশালী করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি সঠিক বলেই মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

Tag :
এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

লন্ডনে শহীদ জননীর জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান

error: Content is protected !!

কাটছে সংকট

ডলারের দাম আরও কমার আভাস

আপডেট টাইম : ০৬:০৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৩
দেশে চলমান ডলার সংকট কেটে যাচ্ছে। শক্তিশালী হতে যাচ্ছে টাকা। এরই মধ্যে ৫০ পয়সা কমানো হয়েছে ডলারের দর। একই সঙ্গে সরবরাহ ক্রমাগত বৃদ্ধি ও দাম আরও কমে আসার আভাসও মিলছে। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বাজারে ডলারের দামে নৈরাজ্যের মধ্যে এ দাম কমানোর উদ্যোগকে আগামী অর্থনীতির জন্য স্বস্তির বার্তা বলে উল্লেখ করেছেন অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী নেতা ও সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল।

তারা বলছেন, এমনটিই হওয়ার ছিল। কারণ, দেশে বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি কমে এসেছে। একইভাবে ঋণাত্মক অবস্থা থেকে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স বা চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও এখন সেপ্টেম্বরের হিসাবে ১ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্তে ফিরে এসেছে। নানামুখী পদক্ষেপের কারণে আগামীতে চলতি হিসাবের ভারসাম্য ইতিবাচক অবস্থাতেই থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।

 

স্বস্তির খবর হচ্ছে—ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার প্রতিশ্রুত ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ঋণ ছাড় হতে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, আইডিবিসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থাগুলোর প্রতিশ্রুত ও পুঞ্জীভূত ঋণের অর্থ ছাড়ের গতি ও ধারাবাহিকতা বাড়তে থাকবে। এ নিয়ে সরকার দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে অব্যাহতভাবে দেনদরবার করে যাচ্ছে। তদুপরি সরকারও এ মুহূর্তে বৈদেশিক ঋণনির্ভর প্রকল্পগুলোতেই বেশি জোর দিচ্ছে। ফলে বিভিন্ন দেশ ও উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে গত চার মাসে নতুন করে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে ৪৬২ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের। একইভাবে এই সময় উন্নয়ন সহযোগীরা ছাড় করেছে ১৬২ কোটি ৬১ লাখ ডলারের ঋণ।

 

এদিকে সংকট কাটিয়ে প্রণোদনায় ভর করে এরই মধ্যে অক্টোবরে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহের হারও বেড়েছে। এ মাসে প্রবাসীরা ১.৯৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা গত চার মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যৌক্তিক কারণেই আগামীতে রেমিট্যান্স প্রবাহের হার বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। এর বিপরীতে ধারাবাহিকভাবে আমদানি কমছে লক্ষণীয়ভাবে। এতেও ডলারের সাশ্রয় হচ্ছে। রপ্তানিও আছে প্রবৃদ্ধির ধারায়। এর পাশাপাশি আগামী ৭ জানুয়ারির পর নির্বাচনী অনিশ্চয়তা কেটে গেলে দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রবণতা বাড়বে। এতে বেসরকারি স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রবৃদ্ধিও গতিশীল হবে। এর সবকিছুর হিসাব ডলারে সমন্বয় হবে এবং এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়বে।

জানা গেছে, ঘাটতির কারণে বর্তমানে ২১ ব্যাংক ডলার সংকটে রয়েছে, আর ৩৯টি ব্যাংক রয়েছে উদ্বৃত্তে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক, ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) দায়িত্বশীলরা আভাস দিয়েছেন—সামনে ডলারের দাম ক্রমাগত কমতে থাকবে। সে ধরনের পরিস্থিতি এখন দেশে তৈরি হয়েছে। এখন দরকার পরিকল্পিত ছক ধরে এগোনোর। তাহলে অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলারের সরবরাহ ঘাটতি দূর হবে। সরবরাহ বাড়বে। এতে কার্ব মার্কেটেও দামও কমে আসবে, যার প্রভাব অত্যাবশ্যকীয় ভোগ্যপণ্য, মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামালের আমদানিতে পড়বে। এতে এলসি জটিলতা দূর হবে এবং ডলারের দাম কমার দরুন গতি আসবে ব্যবসা-বাণিজ্যে, যা এই সময়ের অর্থনীতির জন্য চরম স্বস্তিদায়ক বার্তা।

 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম জানান, অসহনীয় মূল্যস্ফীতিসহ অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে আজকের যে চক্রাকার সমস্যা তৈরি হয়েছে, তার প্রধানতম কারণ হচ্ছে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ঘাটতি। এতে ডলার দুর্লভ হয়ে উঠেছে এবং দাম বেড়েছে লাগামহীন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। ভুক্তভোগী হয়েছে ক্রেতা-ভোক্তা। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ডলারের দাম কমে আসা নিঃসন্দেহে অর্থনীতির জন্য সুখবর। এটা ধারাবাহিকভাবে কমলে এর উপকারভোগী হবে দেশই। এতে ব্যবসায় ডলার নামক আতঙ্ক ও জটিলতা কমবে, এলসির গতি বাড়বে।

 

তিনি বলেন, বৈদেশিক ঋণের ছাড়, রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি ও রপ্তানি আয়ে ধারাবাহিক গতিশীলতা ধরে রাখতে হবে। একই সঙ্গে আমদানিতে বিলাস দ্রব্য কিংবা এ মুহূর্তের অর্থনীতিতে যেটার দরকার নেই, তার আমদানি কঠোরভাবে রোধ করতে হবে। তবেই ডলার সাশ্রয় হবে। এর সঙ্গে বিদেশ থেকে ডলার আসতে থাকলে রিজার্ভ পরিস্থিতিরও উন্নতি ঘটবে। আর এসব পদক্ষেপ সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংককেই সুচারুভাবে পালন করতে হবে। তবেই ডলারের চলমান ঊর্ধ্বগতিকে ধারাবাহিকভাবে দমানো সম্ভব হবে।

 

অর্থ মন্ত্রণালয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, বিশ্বব্যাংক, জাইকা, এডিবি, আইডিবিসহ কিছু দাতা সংস্থা ও দেশ থেকে সরকার ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার আশা করছে।

 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, প্রবাসীরা সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে ৪৮.২০ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১.৩৩ বিলিয়ন ডলার, যা ছিল গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ ছাড়া চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে দেশে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়েছে মোট ১ হাজার ৪৭৪ কোটি ৯০ লাখ (১৪.৭৫ বিলিয়ন) ডলারের। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ১৯ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সবশেষ অক্টোবরের মাসওয়ারি রপ্তানি আয়ের হিসাবে গত চার মাসে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ।

 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী স্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, সরকার চলমান অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে পরিকল্পভাবে গুচ্ছ পদক্ষেপ নিয়ে এগোচ্ছে। সেই পদক্ষেপেরই একটা সুফল হলো চলতি হিসাবের ভারসাম্যকে উদ্বৃত্তের ধারায় ফিরে আনা। সার্বিক পরিস্থিতি বলছে, এটা আর ঋণাত্মক বা নেতিবাচক হবে না। যাতে না হয়, সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক তা নিবিড়ভাবে মনিটরিংও করছে বলে তারা উল্লেখ করেন।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডলার সংকটে আমদানির জন্য এলসি খুলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। ডলারের জন্য বিভিন্ন ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন আমদানিকারকরা। এমন পরিস্থিতির মধ্যে ডলারের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। এ উদ্যোগের আওতায় রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম ৫০ পয়সা কমিয়ে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন থেকে রেমিট্যান্স ও রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতি ডলারে পাওয়া যাবে ১১০ টাকা। আর আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করা হবে ১১০ টাকা ৫০ পয়সায়।

ডলারের দাম যদি সত্যিকার অর্থে কমে তাহলে তো খুব ভালো কথা, এমন মন্তব্য করে বেসরকারি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এ উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন। তবে দাবি করেন, বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় সেটি একেবারেই কাগুজে ও নির্বাচনী উদ্যোগ বলে মনে হচ্ছে, যার প্রভাব বাজারে পড়বে না। কারণ, সেখানে এখনো ডলারের দাম ১২৩-২৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

 

এ বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ডলারের দাম কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। যেটা কমানো হয়েছে, সেটা সরকারিভাবে কমানো হয়েছে; কিন্তু বাজারে তো কমেনি। বর্তমানে এই দরে কেউ কেনাবেচা করছেন না। নির্বাচনের আগে একটা চাঞ্চল্যকর পরিবেশ তৈরি করার জন্যই সরকার এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, অর্থনীতির মৌলিক বিষয়ের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে হলে রিজার্ভ বাড়াতে হবে এবং ডলারের প্রবাহ বাড়াতে হবে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। টাকা পাচার কমাতে হবে। সেগুলো না হলে ডলারের প্রবাহ বাড়বে না। বাফেদা যে দর নির্ধারণ করেছে সেটা স্থায়ী হবে বলে মনে করেন না তিনি। তবে আশার বিষয় হচ্ছে আগামী ডিসেম্বরে আইএমএফের ঋণ পাওয়া যাবে। বিশ্বব্যাংক ও জাইকা থেকেও ঋণ পাওয়া যাবে। আবার একই সময়ে আমাদের দায়ও পরিশোধ করতে হবে। তিনি বলেন, চলতি হিসাবে আমাদের কিছুটা উদ্বৃত্ত রয়েছে, সেটা ভালো দিক। যদিও আর্থিক হিসাবে এখনো বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে গেছে। ফলে সেটাকে কমাতে হলে সেখানেও কাজ করতে হবে।

 

বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম এ বিষয়ে বলেন, আমাদের চলতি হিসাবে ঘাটতি কাটিয়ে এখন উদ্বৃত্ত হয়েছে। দেড় বছর আগেও প্রায় ১৮ বিলিয়ন ঘাটতি ছিল। বর্তমানে প্রায় ৯ বিলিয়ন উদ্বৃত্ত রয়েছে। সেই হিসাবে বাজারে ডলারের সংকট থাকার কথা নয়। বর্তমানে ডলার বাজারের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, সেটি প্রকৃত চিত্র নয়। তিনি আরও বলেন, এখন বাজারে ডলারের দর বাড়ার যে প্রবণতা, সেটি থাকার কোনো কারণ নেই।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, গতকাল বাফেদা ডলারের দাম ৫০ পয়সা কমিয়ে টাকাকে শক্তিশালী করেছে। মূলত বৈদেশিক মুদ্রার দাম নির্ধারিত হয় এর চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে। চাহিদার মূল ক্ষেত্র হচ্ছে আমাদের যেটা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, সেটার মূল্য পরিশোধ এবং আমাদের যে বৈদেশিক ঋণ এবং অন্যান্য দায়দেনা আছে, সেগুলোর পরিশোধও চাহিদার অংশ। গত কয়েক মাসে আমরা চাহিদার দিকটা খুব ভালোভাবে মনিটর করেছি। অর্থাৎ যেসব পণ্য এবং সেবা আসার কথা সেটা সঠিক মূল্যে আসছে কি না অর্থাৎ চাহিদাটা যেন সঠিক থাকে। এ ছাড়া অপ্রয়োজনীয় যেসব পণ্য এবং সেবা আছে, সেগুলোকেও কিছুটা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। একই সময়ে বিশ্ববাজারে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছিল। সব মিলিয়ে গত বছর আমাদের চাহিদা অনেক বেশি ছিল। যেটা গত কয়েক মাসে মনিটরিং করে একটা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে এসেছি। এ কারণে চলতি হিসাবে এক বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত আছে।

 

আমাদের আর্থিক হিসাব এখনো কিছুটা ঋণাত্মক হলেও সেটা ধীরে ধীরে সহনীয় পর্যায়ে চলে আসছে। আমাদের যে ফিন্যান্সিয়াল অবলিগেশনগুলো আছে, শর্টটাইম যে ডেটটা আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরে ছিল সেটা কমে ১৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে, যা ২০২২ এ ছিল সেটা গত সেপ্টেম্বরে ১২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বর্তমানে সেটা ৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার রয়েছে। আগামী দিনে এ দায় পরিশোধ আরও কমে আসবে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে সেটা হবে মাত্র ৪৯ মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া আগামী দিনে আমাদের খুব বেশি দায় তৈরি হবে না, কারণ বর্তমানে যেসব এলসি খোলা হচ্ছে, সেগুলোর বেশিরভাগই তাৎক্ষণিক এলসি। বর্তমানে বিশ্ববাজারে সুদের হার অনেক বেশি হওয়ায় ডেফার্ড পেমেন্টে (বিলম্ব পরিশোধে) যেতে পারছি না। তাই বর্তমানে বেশিরভাগ এলসি অ্যাট সাইটে বা তাৎক্ষণিক ভাবে পরিশোধ করতে হচ্ছে। আর এ দায় কমার কারণেই চলতি এবং আর্থিক হিসাব ইতিবাচক হচ্ছে।

 

অন্যদিকে জোগানের দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, জোগানের অন্যতম খাত রপ্তানিকারকদের রপ্তানি আয় সময়মতো প্রত্যাবাসিত হচ্ছে কি না। সেখানে দেখা যায়, ২০২২ সালের জুনে আমাদের বকেয়া অপ্রত্যাবাসিত রপ্তানি আয় ছিল ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, যা বর্তমানে কমে দাঁড়িয়েছে ১ বিলিয়ন ডলারে। আমাদের সার্বিক রপ্তানি আয় ৫০ বিলিয়নের ওপরে হয়ে থাকে। এর একটা অংশ সবসময়েই বকেয়া থাকে। সেই বকেয়া রপ্তানি আয়ও অনেকাংশে কমে এসেছে এবং বর্তমানে সেটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে।

 

এ ছাড়া রেমিট্যান্সেও আমরা এখন পর্যন্ত ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে রয়েছি। চলতি মাসের এই পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, যা গত মাসের একই সময়ে ছিল ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আমাদের চাহিদা এবং জোগান দুদিকেই বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, যা আগামী দিনে আরও ইতিবাচক হবে।

 

এ ছাড়া বর্তমানে ব্যাংকগুলোর নেট ওপেন পজিশনও ইতিবাচক অবস্থায় রয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে যেখানে ব্যাংকগুলো ৪২৫ মিলিয়ন ডলার ঘাটতিতে বা শর্টে ছিল, এই বছরের একই সময়ে সেটা ১৯২ মিলিয়ন উদ্বৃত্ত বা লং পজিশনে রয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর চাহিদার চেয়ে ডলার বেশি কেনা রয়েছে। গতবছর ৩১টি ব্যাংকে এই লং পজিশন ছিল, যা এই বছর ৩৯টি ব্যাংক লং পজিশনে রয়েছে। সেক্ষেত্রে জোগানের ক্ষেত্রেও একটা বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। অর্থাৎ চাহিদা এবং জোগানের প্রতিটি দিক মিলিয়ে বর্তমানে আমরা একটা ইতিবাচক অবস্থায় রয়েছি, যা আগামী দিনেও অব্যাহত থাকবে। সেই বিবেচনায় বাফেদা গতকাল ডলারে দাম কমিয়ে টাকাকে শক্তিশালী করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি সঠিক বলেই মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।