ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার শেখর ইউনিয়নের তেলজুড়িতে নৌকাবাইচকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর এক গ্রামীণ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। তেলজুড়ি বাজার সংলগ্ন কুমার নদে প্রতি বছর বাংলা পঞ্জিকার হিসেবে বাংলা মাসের ৯ আশ্বিন এ নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এবার বাংলা ৯ আশ্বিন ১৪৩০ মোতাবেক ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ মঙ্গলবার এ আয়েজনের ১২৩ তম নৌকা বাইচ ও মেলা।
শতাব্দীকাল ধরে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নৌকা বাইচকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন পণ্যের পসারা নিয়ে ছোট-বড় প্রায় তিন শতাধিক দোকানদার তাদের অস্থায়ী দোকান গড়ে। গ্রামীণ এ মেলাটি মূলত একদিনের হলেও অনেক দোকানদার নৌকা বাইচ উপলক্ষে আয়োজিত মেলায় তাদের অস্থায়ী দোকান গড়ে তোলেন মেলার ১৫/২০ দিন আগে থেকেই। কোন কোন দোকান মেলার পরেও ৭/৮ দিন থাকে। ঐতিহ্যবাহী এ মেলায় মাদারীপুর, ঢাকা, খুলনা থেকেও দোকানদাররা আসেন। মেলায় ১০/১৫ দিন আগে থেকেই টাঙ্গাইল থেকে চপ বিক্রেতারা বোয়ালমারী এসে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে চপ বিক্রি করে।
মেলাকে কেন্দ্র করে কোন কোন মিষ্টির দোকান ১০-১৫ দিন আগে থেকে শুরু করে মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার পরেও ৭-৮ দিন থাকে।
এমনই এক মিষ্টি ব্যবসায়ী জিবরাইল বিশ্বাস।
তিন ভাইসহ জিবরাইল বিশ্বাসরা সারা বছর অন্য ব্যবসায় ব্যস্ত থাকলেও তেলজুড়ি মেলাকে কেন্দ্র করে মাসব্যাপী মিষ্টি ব্যবসায় ব্যস্ত থাকেন। জিবরাইল বিশ্বাসরা ৭ ভাই। এর মধ্যে জিবরাইল, ইস্রাফিল, রেজাউল, বাছির- এই চার ভাই মিলে তেলজুড়ির মেলাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর মিষ্টির দোকান দেন। তেলজুড়ি বাজারের উত্তর দিকে, বাবুরবাজার হয়ে তেলজুড়ি বাজারে ঢোকার প্রবেশমুখে মেলা উপলক্ষে বাঁশ ও টিন দ্বারা নির্মিত তাদের অস্থায়ী মিষ্টির দোকান। শতাব্দিকাল ধরে প্রতি বছরের বাংলা ৯ আশ্বিন অনুষ্ঠিত হয় নৌকা বাইচ এবং মেলা। কিন্তু মেলার আমেজ ছড়িয়ে পড়ে পনের-বিশ দিন আগে থেকেই। সারা বছর জিবরাইল তেলজুড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের ফটকে চটপটি, ফুচকার দোকান দেন। আরেক ভাই রেজাউল তেলজুড়ি বাজারে ঝাল, মুড়ি, আচারের দোকান দেন। আর অন্য ভাইদের মধ্যে ইস্রাফিল ও বাছির তেলজুড়ি বাজারে রাইচ মিল চালান। কিন্তু তারা তাদের এসব নিয়মিত পেশা ছেড়ে একমাসের জন্য পৈতৃক পেশায় ফিরে যান।
মেলা উপলক্ষে তারা সারা সেপ্টেম্বর মাসই ব্যস্ত থাকেন মিষ্টির দোকান নিয়ে, বিশেষত ‘আমেত্তি’ নামক মিষ্টি বানানোয়। তারা শুধুমাত্র তেলজুড়ি মেলাকে কেন্দ্র করে এক মাস নিজ গ্রামে মিষ্টির দোকান দেন, তারা অন্য কোথাও মেলা উপলক্ষে কোন দোকান দেন না। জিবরাইল বিশ্বাসের বাবা নুরুউদ্দিন বিশ্বাস তেলজুড়ির নৌকা বাইচের মেলা উপলক্ষে প্রতি বছর মিষ্টির দোকান দিতেন। ১৮ বছর আগে তিনি মারা গেছেন। এখন ছেলেরা পৈতৃক ব্যবসা ধরে রেখেছেন। দুই প্রজন্মের ৬০/৬৫ বছর ধরে এ ব্যবসা। জিবরাইল বিশ্বাস যে জায়গায় মেলা উপলক্ষে দোকান দেন, সে জায়গার মালিককে ভাড়া বাবদ এখন হাজার তিনেক টাকা দিতে হয়। আগে জায়গার মালিককে মিষ্টি দিলেই চলতো।
চিনির মূল্য বৃদ্ধির কারণে এবার আমেত্তির দামও একটু বেশি। গত বছর আমেত্তি কেজি প্রতি ১৫০-১৮০ টাকায় বিক্রি করলেও এবার ২০০ টাকায় বিক্রি করছেন জিবরাইল ও তার ভাইয়েরা। মাসকলাইয়ের ডাল ও এরারুট পাওডার দিয়ে তৈরি করা হয় আমেত্তি। চার ভাগ মিশ্রণে তিন ভাগ মাসকলাইয়ের ডালের সাথে এক ভাগ এরারুট পাওডার মেশানো হয়। ব্লেন্ডারে প্রথমে মাসকলাইয়ের ডাল গুঁড়ো করা হয়। পরে এরারুট নামক পাইডারের সাথে মেশানো হয়। এরপর খাওয়ার যোগ্য রং মেশানো হয় সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য। এরপর জ্বলন্ত চুলায় রাখা কড়াইয়ের ডুবন্ত তেলে পিঠা ছাড়া হয়। কাপড়ের মধ্যে মিশ্রণ নিয়ে গোল বলের মতো করে কাপড়ের অগ্রভাগে ছিদ্র করে চাপ দিয়ে এ নকশাসমৃদ্ধ মিষ্টি ‘আমেত্তি’ তৈরি করা হয়। শেষে ডুবন্ত তেলে ভেজে চিনির মিশ্রণে ভিজিয়ে রাখা হয়। যদি কেউ রং ছাড়া আমেত্তি নিতে চায় তাও বানিয়ে দেয়া হয়। প্রতি কেজিতে ১২-১৪ পিস হয়। আমেত্তি ছাড়াও জিবরাইল বিশ্বাস ও তার ভাইয়েরা মিষ্টির দোকানে গজা, দানাদার, রসগোল্লা, কালোজাম, জিলিপিও বিক্রি করেন। কিন্তু এ মেলায় আমেত্তিই মূল মিষ্টি।
জিবরাইল বিশ্বাস বলেন, ‘প্রতি কেজি আমেত্তি এবার ২০০ টাকায় বিক্রি করছি। এতে প্রতি কেজিতে ১৫-২০ টাকা লাভ হয়। দূরবর্তী স্থান থেকেও লোকেরা মিষ্টি কিনতে আসেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে জিবরাইল বিশ্বাস বলেন, ‘ ৯ আশ্বিন (২৬ সেপ্টেম্বর) মেলার দিন ৫০০/৭০০ কেজির মতো আমেত্তি বিক্রি হয়। আর মেলার আগে পরে প্রতিদিন ৫০-৭০ কেজির মতো বিক্রি হয়।’
নাজিমুদ্দিন সিকদার নামের এক মিষ্টি ক্রেতা বলেন, ‘জিবরাইল বিশ্বাসের আমেত্তি প্রতি বছরই খাওয়া হয়। পরিবারের জন্যও কেনা হয়। এমনকি আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতেও পাঠানো হয়। এবারও কিনেছি।’
বোয়ালমারীতে অবস্থিত একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ের স্কুল শিক্ষক মুকুল বসু বলেন, ‘আমেত্তি খাওয়ার জন্য শুক্রবার রাতে তেলজুড়ি গিয়েছিলাম। জিবরাইল বিশ্বাসের আমেত্তি আসলেই বেশ মানসম্মত।’
মেলা আয়োজক কমিটির সভাপতি গণমাধ্যম কর্মী লিটু সিকদার বলেন, ‘দশকের পর দশক ধরে তেলজুড়ি বাজার সংলগ্ন কুমার নদে অনুষ্ঠিত হয় নৌকা বাইচ এবং গ্রামীণ মেলা। আর মেলা উপলক্ষে নৌকা বাইচের ১৫-২০ দিন আগে থেকেই দোকানদাররা তাদের পণ্যসামগ্রী নিয়ে তেলজুড়ি বাজারে দোকান দিয়ে থাকেন। আর জিবরাইল বিশ্বাসের মিষ্টি সারা সেপ্টেম্বর ও অক্টোবার মাস জুড়েই পাওয়া যায়। জিবরাইল বিশ্বাসের আমেত্তি যেন তেলজুড়ির মেলার প্রাণ।
প্রিন্ট