ফরিদপুরের সদরপুরে হাইকোর্টের রায়কে আমান্য করে ১৯ জন মুক্তিযোদ্ধার ভাতা, সনদ, স্মার্ট কার্ড না দেওয়া ও মন্ত্রণালয়ে নানা অভিযোগ করে হয়রানি করছে মনির চক্র নামে একদল দুস্কৃতকারী। এর বিরুদ্ধে উপজেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এ. গফ্ফার মিয়া, মজিবর রহমান মাতুব্বর ও ডা. মহিউদ্দিন আহমেদ এর নেতৃত্বে সদরপুরের শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ভাঙ্গা উপজেলার নাজমুল কবির মনির, তাদের স্বপক্ষের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ও প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তা এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবী জানিয়েছে।
সম্প্রতি গত মঙ্গলবার (২জুন) দুপুরে উপজেলা পরিষদ সম্মেলন কক্ষে তারা ফরিদপুর-৪ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য ও যুবলীগের প্রেসিডিয়ম সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনের উপস্থিতিতে এই ক্ষোভ প্রকাশ করেন ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট উক্ত মনির গং এর বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগপত্র দায়ের করেন। এমপি মহোদয় মুক্তিযোদ্ধাদের এসব সমস্যা দ্রæত সমাধানে সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
মনির গং এর অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এ. গফফার মিয়া বলেন , নাজমুল কবির মনির পার্শ্ববর্তী ভাঙ্গা উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দা। সে ভাঙ্গায় সুবিধা করতে না পেরে বিশেষ সুবিধা হাসিলের উদ্দেশ্যে মাইগ্রেশনের মাধ্যমে সদরপুরে আসেন। এখানকার বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে সদরপুরের ১৯ জন মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মাধ্যমে ভাতা, স্মার্টকার্ড বিতরণ বন্ধ করার পক্ষে হস্তক্ষেপ করে আসছে।
আমরা তাদের (মনির গং এর) এ ধরণের ঘৃণ্য কাজের প্রতিবাদ ও অভিযোগ জানাতে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, মহামান্য হাইকোর্টের রায় বহাল থাকাবস্থায় ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধার সম্মিলিত তালিকা গেজেট, লাল মুক্তিবার্তা ও সম্মানী ভাতা কেন বাতিল করা হলো? এ বিষয়ে জামুকা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গৃহীত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য ইতোপূর্বে জামুকা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গৃহীত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সদরপুরের ভুক্তভোগী মুক্তিযোদ্ধারা হাইকোর্টে আপীল করে যার মামলা নং ১৫৪৭৩/২০১৭, ৩৮৫০ ও ৩৮৫১/২০১৯। এর মধ্যে ১৫৪৭৩/২০১৭ ও ৩৮৫০/২০১৯ মামলায় হাইকোর্ট ভুক্তভোগী মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে চূড়ান্ত রায় প্রদান করেন। অপর মামলা ৩৮৫১/২০১৯ চলমান থাকায় পুনরায় দুইটি আদেশে মহামান্য হাইকোর্ট মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তাদের নাম, গেজেট, লালমুক্তিবার্তা বহাল রেখে যথারীতি ভাতা প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আদেশ প্রদান করেন।
উক্ত রায়কে অমান্য করে মনির গংরা পুনরায় জামুকা, মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন দপ্তরে ধারাবাহিক ভাবে অভিযোগ দায়ের করে আসছে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের একাংশ মনির গংদের কথা মত তাদের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। যারা হাইকোর্টের রায়কে অমান্য করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান অপদস্ত ও আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থ করছে আমরা তাদেরও আইনি শাস্তি দাবী করছি। তিনি বলেন, হাইকোর্ট বড় না জামুকা বড়? বিষয়টি নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি। এখানকার বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধারা মামলা, হুমকি, ঘর বরাদ্দে চাঁদাবাজি, অপমান অপদস্ত ও ভাতা না পেয়ে বর্তমানে চরম দুঃখ কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। প্রশাসন মনির গংদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা না নিলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বরাবর স্বারকলিপি, মানববন্ধন ও গণ অনশন করার ঘোষণা দেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান মাতুব্বর অভিযোগ করে বলেন, সম্প্রতি গেজেটভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট বাতিলের এখতিয়ার জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) নেই উল্লেখ করে রায় ঘোষণা করে হাইকোর্ট। তবুও তাদের নাম গেজেট ও লাল মুক্তিবার্তা থেকে নাম কাটা হয়েছে। এটা মহামান্য হাইকোর্টকে অপমান করার শামিল নয় কি? অভিযুক্ত নাজমুল কবির মনির স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ৫ম শ্রেণীর ছাত্র ছিল। সে ভারতেও যায়নি। কী করে কিশোর বয়সে যুদ্ধকালীন গ্রæপ কমান্ডার হলো? তার অপর সহযোগী ইউছুফ আলী হাওলাদার ২০১০ সালে মুক্তিযোদ্ধার নাম লিখে গেজেট করে বর্তমানে সেও গ্রæপ কমান্ডার সেজেছে। আমরা এইসব দূর্ণীতিবাজদের বিভিন্ন অপকর্মের তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থার দাবী জানাচ্ছি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, মনির গংরা বিশেষ স্বার্থ হাসিলের জন্য ভাঙ্গা উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়া সত্বেও সদরপুর উপজেলায় এসে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মামলা, হয়রানি ও চাঁদাবাজি করে আমাদের জিম্মি করে রেখেছে। এ ধরণের দূর্ণীতিবাজ ও স্বঘোষিত মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়দানকারীদের প্রশাসন কি করে সহযোগীতা করে তা আমাদের বোধগম্য নয়। তিনি আরও অভিযোগ করেন উপজেলা বাছাই কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধাদের নামে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বীর নিবাস বরাদ্দ দেয়া হয়। তাদের মধ্যে ৫জনের নামে মনির গংরা অভিযোগ দিয়ে ঘর বরাদ্দ বাতিল করে দেয়। উক্ত সংবাদ শুনে ভারতীয় তালিকাভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা আঃ রব মিয়া সদরপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবনের ভেতরে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
পরবর্তীতে একইভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা আঃ মালেক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আঃ জলিল নিজ বাড়িতে মারা যান। আমরা উক্ত তিন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর সঠিক তদন্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানাচ্ছি। এ ছাড়া তাদের অভিযোগে ৭ জন মুক্তিযোদ্ধার সনদ ও স্মার্ট কার্ড আটক করে দিয়েছে প্রশাসন। আরও ৬২ জন মুক্তিযোদ্ধাদের নামে জামুকায় অভিযোগ দায়ের করেছিল মনির গংরা। তাহলে সদরপুরের সবাই কি অমুক্তিযোদ্ধা? শুধু মনির গংরাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা? ওদের বিভিন্ন অপকর্মের বিরুদ্ধে ফরিদপুর জেলা প্রশাসক অতুল সরকার ও উপজেলা প্রশাসন ৫.১২.২৯০০.০০৬.৯৯.২৩১.১৭.৭১১/৬ জুন ২০১৭ইং নং স্মারক বলে মনিরকে মুক্তিযোদ্ধার সকল সুবিধা সদরপুর উপজেলায় অবস্থান না করে তার নিজ উপজেলা ভাঙ্গা থেকে নেয়ার জন্য সুপারিশ করেন। কর্তৃপক্ষের কাছে উক্ত বিষয়ে তদন্তের জন্য জোর দাবী জানাচ্ছি।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল কবির মনিরের সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমার বিরুদ্ধে প্রশাসনের উক্ত অভিযোগ সত্য নয়। আমি ২০১৬ সাল থেকেই সদরপুর উপজেলার ব্রাহ্মন্দি গ্রামে বসবাস করছি।
অভিযুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ আলী হাওলাদার বলেন, সদরপুরের কোন মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে আমি অভিযোগ করেনি। নাজমুল কবির মনির আমার স্বাক্ষর জাল করে অভিযোগ দায়ের করেছে। আমি ওই সকল মিথ্যা অপকর্মের সাথে নেই।
তবে, উপজেলা নির্বাচন কমিশনের তথ্য মতে মনির ২০১৬ সালে সদরপুরের ভোটার হয়। সদরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাজী জাফর ও ৯ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য চর ব্রাহ্মন্দি গ্রামের আবু সাইদের সাথে কথা হলে তারা সাংবাদিকদের জানান, মনির প্রায় দুই বছর আগে এখানে একটি ঘর নির্মাণ করেছে। এখানে সে ও তার পরিবার-পরিজন কেউ থাকে না, ঘর তালাবদ্ধ থাকে।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আহসান মোহাম্মদ রাসেল এর সাথে কথা হলে তিনি জানান- আমি মনির গংদের করা অভিযোগের ভিত্তিতে উক্ত অভিযুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ও সনদ বিতরণ বন্ধ রেখেছি। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের আদেশ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রিন্ট