বেআইনিভাবে চাকরিচ্যুতি, ক্ষতিপূরণ, ন্যায্য পাওনা আদায়সহ শ্রমিকসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে ভরসার জায়গা হচ্ছে শ্রম আদালত। তবে এখানেও শ্রমিকদের ভোগান্তির শেষ নেই। কর্মক্ষেত্রে যেমন ন্যায্যতা আর ন্যায্য প্রাপ্তির জন্য ঘাম ঝরাতে হয়, তেমনি আদালতেও তাদের ঘুরতে হয় বছরের পর বছর।
আইনজীবীরা এবং শ্রমিক নেতারা মনে করেন, যথেষ্ট বিলম্বে তারিখ ধার্য করা, প্রযুক্তিগত পশ্চাৎপদতা, একতরফা নিষ্পত্তির মামলা পুনরুজ্জীবিতকরণ, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ, আইনের অস্পষ্টতা, মালিক বা কর্তৃপক্ষের স্বার্থরক্ষায় আদালতের কর্মচারীদের দুর্নীতি বিচারকাজে তথা শ্রমিকের ন্যায্যতা নিশ্চিত করার পথে অন্তরায়।
সারা দেশে বিভাগীয় পর্যায়ে ১০টি শ্রম আদালতে ও ঢাকার একটি শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে উল্লিখিত বিষয়ে মামলার কার্যক্রম চলে। ঢাকায় দৈনিক বাংলা মোড়ে শ্রম ভবনে তিনটি আদালত রয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামে দুটি, খুলনায় একটি, রাজশাহীতে একটি, রংপুরে একটি, সিলেটে একটি ও বরিশালে একটি শ্রম আদালত রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও কুমিল্লায় শ্রম আদালতে বিচারকার্যক্রম চলার বিষয়টি এখানো প্রক্রিয়াধীন। শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালটির অবস্থান ঢাকার কাকরাইলে।
ছয় মাসের বেশি বিচারাধীন সাড়ে ১৯ হাজার মামলা : আদালত-সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত ১০টি শ্রম আদালতে ২৪ হাজার ৭টি মামলা বিচারাধীন। অন্যদিকে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে এ সময় পর্যন্ত অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা ১ হাজার ৪৯৪। ঢাকার প্রথম শ্রম আদালতে অনিষ্পন্ন মামলা রয়েছে ৮ হাজার ২৪৮টি। দ্বিতীয় শ্রম আদালতে বিচারাধীন ৭ হাজার ১৩৮টি মামলা। তৃতীয় শ্রম আদালতে বিচারাধীন মামলা ৪ হাজার ২৩৯টি। আর শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে ৭৬৭টি মামলা অনিষ্পন্ন রয়েছে। সব মিলিয়ে ১০টি শ্রম আদালত ও একটি আপিল ট্রাইব্যুনালে ছয় মাস বা তার আগে থেকে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১৯ হাজার ৬০৯। ঢাকার তিনটি শ্রম আদালত ও আপিল ট্রাইব্যুনালে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন ১৮ হাজার ৩৩১টি মামলা। ১০ বছর বা তার বেশি পুরনো অনেক মামলাও অনিষ্পন্নের তালিকায় রয়েছে।
সাড়ে ৬ হাজার টাকা পেতে সাড়ে ৫ বছরের অপেক্ষা : কুড়িগ্রামের চিলমারীর সবুজপাড়ার মো. জাহাঙ্গীর আলম। ২০১৭ সালের ১৬ আগস্ট শ্যামলীর ‘লাইক বিডি ওয়ার্ল্ড লিমিটেড’ নামের তৈরি পোশাক কারখানায় কাটিং মাস্টার হিসেবে যোগ দেন। পরের মাসের ১৬ সেপ্টেম্বর তাকে অর্ধেক বেতনের চেক দিয়ে চাকরিচ্যুত করা হয়।
ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে কোনো টাকা না থাকায় ৬ হাজার ৫০০ টাকা পেতে ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর ঢাকার প্রথম শ্রম আদালতে মামলা করেন জাহাঙ্গীর (৩৮)। শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ৩০ দিনের মধ্যে তাকে পাওনাসহ চাকরিতে ফিরিয়ে নেওয়ার আদেশ দেয় আদালত।
আদালতের আদেশ অমান্য করায় ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও করেন জাহাঙ্গীর। সমন ও পরোয়ানা জারির পরও তিনি পাওনা এখনো বুঝে পাননি। এখন তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি দর্জি দোকানে কাজ করেন।
গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘আমার নাকি স্থায়ী নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র কিছুই ছিল না। সামান্য কটা টাকার জন্য দিনের পর দিন ঘুরতে হচ্ছে। আমি গরিব মানুষ। যদি পাই। নিরাশার চেয়ে আশার মধ্যে থাকা ভালো।’
কুষ্টিয়ার মিরপুরের পোড়াদহের মো. সফিউদ্দিন মেকানিক ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন আরিচার ‘ফাইন ক্রাফট লিমিটেড’ নামে প্রতিষ্ঠানে। ২০০৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তাকে চাকরিচ্যুত করে কর্তৃপক্ষ। বকেয়া মজুরি ও অন্যান্য ভাতাসহ ১ লাখ ২০ হাজার ৯২৩ টাকা পেতে ঢাকার প্রথম শ্রম আদালতে করা মামলার রায় তার পক্ষে যায়।
২০১০ সালের ১৪ জানুয়ারি করা মামলায় ২০১১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর রায় হয়। আজ পর্যন্ত তিনি পাওনা বুঝে পাননি। রায় অমান্য করায় ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ৭ মার্চ ফৌজদারি মামলা করেন তিনি। পরে একাধিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করলেও এখন তিনি বেকার। স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে গাজীপুরে ভাড়া বাসায় থাকেন।
তিনি বলেন, ‘আমার অনেক কষ্টের উপার্জন। পাওয়ার আশা তো করতেই পারি। এ দুনিয়ায় না পেলে আখেরাতে নিশ্চয়ই পাব।’
উল্লিখিত দুই ভুক্তভোগীসহ হাজারের বেশি শ্রমিককে আইনগত সহযোগিতা জোগাচ্ছে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন। সংগঠনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, ‘শ্রম আদালতগুলোর অবস্থা খুব করুণ। রায় হলেও অনেক প্রতিষ্ঠান তা মানে না। শ্রমিকরা প্রথমে ভুক্তভোগী হন কর্মস্থলে। প্রতিকার পেতে আদালতে এসেও একই অবস্থা হয় তাদের। আইনের সংস্কার যেমন জরুরি, তেমনি আদালতের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।’
আইনের অস্পষ্টতায় অনানুষ্ঠানিক আপিল ট্রাইব্যুনাল : শ্রম আইনের ২১৭ ধারা অনুযায়ী, শ্রম আদালতের রায়, সিদ্ধান্ত, রোয়েদাদ বা দ-ের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ পক্ষের আপিলে আপিল ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত গণ্য হবে। ২১৮ ধারা অনুযায়ী, শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালকে হাইকোর্টের মতো আদালত গণ্য করতে হবে। সব শ্রম আদালতের ওপর ট্রাইব্যুনালের নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্ব থাকবে।
আইনজীবীরা এবং ও শ্রমিক নেতারা বলেন, শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ অনেকেই সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী হাইকোর্টে রিট করেন। আইনে একদিকে ট্রাইব্যুনালকে বলা হচ্ছে চূড়ান্ত, অন্যদিকে সাংবিধানিক পন্থা হিসেবে যে কেউ উচ্চ আদালতে যেতে পারে।
আইনটি অস্পষ্ট উল্লেখ করে আইনজীবীরা বলেন, যদি হাইকোর্টে প্রতিকার পেতে হয় তাহলে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের আদেশ ও রায়ের কার্যকারিতা কতটুকু? আদালতসংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, বিচারাধীন ২৪২টি মামলা রয়েছে যেগুলো হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। এগুলোর কবে নিষ্পত্তি হবে তা অনিশ্চিত।
অন্যদিকে শ্রম আইনের ২১৬ ও ২১৮ ধারার বিধান অনুযায়ী, মামলা গ্রহণের ৬০ দিনের মধ্যে সম্ভব না হলে আরও ৯০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ মোট ১৫০ দিনের মধ্যে শ্রম আদালতের রায় বা সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আইনজীবীরা বলেন, এ সময়ে মামলার নিষ্পত্তি হয় না বললেই চলে। এই সময়ে নিষ্পত্তি না হলে কী হবে তাও আইনে স্পষ্ট নয়। শুধু নিষ্পত্তি না হওয়ার উপযুক্ত কারণ দেখাতে হয়।
বিলম্বিত শুনানিতে বিচারে দীর্ঘসূত্রতা : শ্রমিক নেতারা ও ভুক্তভোগীরা বলেন, শ্রম আদালতের মামলার দীর্ঘসূত্রতার বড় কারণ বিলম্বে শুনানির তারিখ। এর সুবিধা পায় মালিক বা কর্তৃপক্ষ। আদালতের কর্মচারীদের অনৈতিক কার্যকলাপের দিকেও অভিযোগ তাদের। শ্রম আদালতে নিয়মিত মামলা পরিচালনা করেন এমন একজন আইনজীবীর সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার শ্রম ভবনে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।
নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি বলেন, ‘বিবাদীপক্ষ যদি শুনানির তারিখ বিলম্বে চায় তাহলে আমরা শুধু পেশকার ও পিয়নদের ওপর ভরসা করতে পারি। সংশ্লিষ্ট সব কাজ তারাই করেন।’ গত বৃহস্পতিবার একটি মামলায় বিবাদীপক্ষ চার মাস সময়ের পর তারিখ নির্ধারণ করিয়েছেন বলে জানান তিনি।
শ্রম আদালতে নিয়মিত মামলায় শুনানি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নেসার আহমেদ আলীম। তিনি বলেন, ‘গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা এখন পুঁজিবাদ ও মালিকদের অনুকূলে। আদালতে তাদের প্রভাব থাকাই স্বাভাবিক। শ্রমিকদের ন্যায্যতার বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা না হলে তারা নিগৃহীত হতেই থাকবে।’
মানবাধিকার ও আইনি সহায়তা সংস্থা ব্লাস্টের (বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট) ট্রাস্টি অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, ‘কর্মস্থলে যেমন মালিকপক্ষের স্বার্থরক্ষার জন্য ঘাম ঝরান শ্রমিকরা তেমনি প্রতিকার পেতে গিয়েও মানসিক যাতনার স্বীকার হন তারা। টাকা না দিলে তাদের পক্ষে কেউ কথা বলে না। কিছু বিচারক এজলাসে বসেন তাদের মর্জিমতো। অনেক আইনজীবীও শ্রমিকের পক্ষে থাকেন না।’
তিনি বলেন, ‘আদালতগুলো হওয়ার কথা ছিল নিপীড়িত শ্রমিকদের। কিন্তু কিছু অসৎ লোকের কারণে এগুলো এখন শ্রমিকবিরোধী হয়ে পড়ছে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুুফিয়ান বলেন, ‘শ্রমিকদের কথা চিন্তা করেই কিন্তু আমরা আদালত বাড়িয়েছি। তারা যাতে দ্রুত বিচার ও প্রতিকার পায় সেজন্য আদালতগুলোকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। উল্লিখিত আইনটি সংশোধনের বিষয়ে কাজ চলছে। মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষসহ সব অংশীজনের মত নিয়ে সংশোধন করা হবে।’
আজ মহান মে দিবস : আজ মহান মে দিবস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল এই দিনে। দীর্ঘ বঞ্চনা ও শোষণ থেকে মুক্তি পেতে ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে হে মার্কেটে জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। ৩ মে তাদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে বেশ কয়েকজন শ্রমিক মারা যান। শ্রমিকের বুকের রক্ত ঝরানোর মধ্য দিয়ে কর্মদিবস আট ঘণ্টা প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে প্রতি বছর ১ মে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়। বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালিত হয়। এবার মে দিবসের প্রতিপাদ্য : ‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি’।
মে দিবস উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব শ্রমজীবী মানুষকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘শিল্প ও শ্রমবান্ধব বর্তমান সরকার শ্রমিকের সার্বিক কল্যাণ সাধনে ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে ও কল্যাণে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।’
মে দিবস উপলক্ষে আজ সরকার ঘোষিত ছুটির দিন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। শ্রমিক সমাবেশ, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন রয়েছে। এই দিনে জাতীয় পত্রিকাগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেগুলো বিশেষ অনুষ্ঠান ও টকশো সম্প্রচার করবে।
প্রিন্ট