আসে নাই ফিরে ভারত-ভারতী?
মা’র কতদিন দীপান্তর?
পূণ্য বেদীর শূন্যে ধ্বনিল
ক্রন্দন –“দেড় শত বছর।”…
যুগশ্রেষ্ট,যুগ-মানস এবং যুগ-চেতনা আর জাতীয় চাহিদার রূপকার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম(১৮৯৯-১৯৭৬), স্বদেশ ও সমকালের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে তাঁর অনুভূতিতে লালন করেছিলেন, স্বদেশের মানুষের ও বিশ্বমানবের আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বরুপ। তাঁর সংগ্রামশীল জীবন ও বৈচিত্র্যময় রচনাবলীর দিকে তাকালে কবির বিদ্রোহী চেতনা, মানবতাবাদ, জাতীয়তাবোধ, ও স্বদেশ প্রেমের উৎস খুঁজে পাওয়া যায়।তিনি একাধারে সব্যসাচী লেখক, কবি, কথাশিল্পী,নাট্যকার,গীতিকার, প্রবন্ধকার,সুরকার ও সংগীত- স্রষ্টা।
বিশ শতকের বিশের দশকে সাহিত্য ক্ষেত্রে আবির্ভাবের স্বল্পকালের মধ্যে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর বাংলা সাহিত্যে তৃতীয় যুগ-শ্রষ্টা কবি হিসেবে ধুমকেতুর মতো আবির্ভূত হন কাজী নজরুল ইসলাম। রোমান্টিক মানসপ্রবণতা এবং স্বপ্ন ও সৌন্দর্যবোধের রূপকার-নজরুল স্বদেশপ্রেমকে বুকে ধারণ করে,পরাধীন স্বদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক মুক্তি-আন্দোলনের তথা ব্রিটিশ শাসনের শৃঙখল মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে, বিদ্রোহী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রচনা করেছিলেন অসামান্য কবিতা ‘বিদ্রোহী’। বলেছিলেন-
বল বীর –
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর –
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!…
বিদ্রোহী কবিতার মধ্যদিয়ে নজরুল একজন অত্যন্ত পরাক্রম এবং বিশাল ব্যক্তিত্ব ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় লাভ করেছিলেন।সাম্রাজ্যবাদী শক্তির জেল-জুলুম, নির্যাতন তাঁকে পিছু হঠাতে পারেনি। হরদম গেয়েছেন মুক্তির গান, শিকল ভাঙার গান।বিদ্রোহী কবিতা রচনার পূর্বে ‘ খেয়া পারের তরণী ‘,’শাত-ইল আরব’,কুরবানী’, মহররম’, ফাতেহা-ই দোয়াজদহম’, ‘কামাল পাশা’ ইত্যাদি সাড়া-জাগানো কবিতা লিখলেও ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়ই আগ্নেয়গিরির প্রচন্ড উত্তাপে অকস্মাৎ বোমা বিস্ফোরিত হয়ে দেখা দিলেন।যুগ যুগ ধরে বাংলার সঞ্চিত অভিমান, ক্রোধ আর দুঃসহ বেদনা নজরুলের কণ্ঠে মূর্ত হয়ে বেজেছিল।
সমালোচকের বক্তব্য হচ্ছে—‘ ওটা কবিতা তো নয় –ওটা আগুনের গোল্লা-পরাধীন মানুষের অন্তর্বেদনার এক জলন্ত প্রকাশ।'(লক্ষ্মণ কুমার,বিদ্রোহী কবি নজরুল)
নজরুল তাঁর আত্মোপলব্দিকে কখনো বিক্রি করেন নি অন্যায়ের কাছে।তাই তাঁর সকল সৃষ্টিতে নিজস্ব ভাবের চিহ্ন পাওয়া যায়।সমকালীন বিশ্বে তাঁর স্থানকে নিরূপণ করতে পেরেছিলেন নিজ অবলোকনের মাধ্যমে।নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে,একদম কাছ থেকে মানুষকে পড়তে পেরেছিলেন।তাই একজন শৌর্যবীর্য পৌরুষকে আহবান করে বলেছিলেন–
‘বিশ্বগ্রাসীর ত্রাস নাশি আজ আসবে কে বীর এসো
ঝুট শাসনে করতে শাসন,শ্বাস যদি হয় শেষও!
কে আছে বীর এসো!
নজরুলের কবিতা শোষিত মানুষের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত। পরাধীনতার বন্ধন থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য তাঁর কলম ও প্রয়াস যেমন সক্রিয় ছিলো তেমনি শ্রমজীবী মানুষ –কৃষক,শ্রমিক,মেহনতী জনতার প্রিয় নির্ভরযোগ্য মুখপাত্র তিনি কবি নজরুল।’ প্রলয়শিখা, অগ্নিবীণা, বাঁধনহারা,বিষের বাঁশি,ফণী মনসা,ভাঙার গানে’র পাশাপাশি তিনি সাংবাদিক –লেখক ‘লাঙ্গল, ধূমকেতু, নবযুগ,সেবক পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে সমাজ যখন ভঙ্গুর,ধর্মীয় গোড়ামী জাতিকে পশ্চাৎপদ করে রেখেছিল তখন ইসলামী মূল্যবোধ এবং বিশালতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে,ঐক্যের ডাক দিতে গেয়েছেন সাম্যে- মৈত্রীর গান মানুষকে ভালোবেসে।কণ্ঠে তাঁহার মূর্ত হয়ে বেজেছিল- শতাব্দীর সঞ্চিত বেদনা-ক্রোধ যেনো অস্থির হৃদয়ের মহাকল্লোল,ক্ষুব্ধ প্রাণের মর্মর ধ্বনি, প্রচণ্ড অগ্নিস্রাব রচনায়– দিশেহারা মানুষ পেয়েছিল সম্বিত ।দ্রোহ ও প্রেম ছিলো অনুভূতিতে ঋদ্ধ, সম্পূরক।নজরুলের বলিষ্ঠ কণ্ঠের উচ্চারণ; ‘মম একহাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী,আর হাতে রণতূর্য।’
হিন্দু-মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। নজরুল তাঁর লেখায় মানব প্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন যা প্রতিনিয়ত তাঁকে কষ্ট দিত।১৯৪১ সালে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র রজত জুবিলী অনুষ্ঠিত হয়।…সভাপতিত্ব করেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর ভাষণের মধ্যথেকে আংশিক এখানে তুলে ধরছি–‘হিন্দু-মুসলমানে দিন-রাত হানাহানি,জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য,ঋণ,অভাব –অন্যদিকে লোভী অসুরের যজ্ঞের ব্যাঙ্কে কোটি কোটি টাকা-পাষাণ- স্তুপের মত জমা হয়ে আছে–অসাম্য এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম,আমার কাজে,সঙ্গীতে,কর্মজীবনে অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম—অসুন্দরকে ক্ষমা করতে, অসুরকে সংহার করতে এসেছিলাম–তোমরা সাক্ষী, আর সাক্ষী আমার পরম সুন্দর।আমি যশ চাই না,খ্যাতি চাই না,প্রতিষ্ঠা চাই না, নেতৃত্ব চাই না–তবু তোমরা আদর করে যখন নেতৃত্বের আসনে বসাও,তখন অশ্রু সম্বরণ করতে পারি না– তাঁর আদেশ পাই নি, তবু রুদ্রসুন্দররূপে আবার তোমাদের নিয়ে এই অসুন্দর, এই কুৎসিত অসুরদের সংহার করতে ইচ্ছা করে।
যুগ-শ্রষ্টা নজরুল আমাদের জাতীয় কবি।তাঁর লেখা কবিতা,প্রবন্ধ, নাটক,গল্প,গান আমাদের মনে প্রেরণা যোগায়।তাঁর’লক্ষ্যভ্রষ্ট’ নিবন্ধে বলেছেন–‘ সকল দেশের,সকল মানুষের সেই একমেবাদ্বিতীয়ম — লা- শরীক আল্লাহ যদি এক লক্ষ্য হন, তাহা হইলে আর মানুষেরা লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া এই অভিশপ্তের (পারস্পরিক কলহ,হানাহানি) জীবন বহন করিবে না।’
প্রিন্ট