ফরিদপুরের সালথা উপজেলায় গত ২০২১-২২ অর্থবছরে হাট-বাজার উন্নয়নের নামে প্রায় অর্ধকোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে।
সরেজমিন ও কাগজ পত্র সূত্রে জানা যায়, হাট বাজার উন্নয়নের নামে ২০টি প্রকল্পের মাধ্যমে অন্তত ৪০-৫০ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছে সংশ্লিষ্টরা। এসব প্রকল্পের বেশির ভাগই কোনো কাজ করা হয়নি। অথচ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে দাবি করে বরাদ্দের সব টাকা তুলে নিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে জানা যায়।
গত এক সপ্তাহে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের বিভিন্ন হাট-বাজারে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাস্তবে কোন কাজ করা হয়নি শুধুমাত্র কাগজে-কলমে প্রতিটি প্রকল্প শেষ দেখানো হয়েছে। বাস্তবে এসব হাওয়াই প্রকল্পের কাজের কোনো অস্বিত্বই নেই।
উপজেলা পরিষদের একটি সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৬ জুন, ২০২১ তারিখ সকাল ১০ টায় অনুষ্ঠিত সভায় বাংলা ১৪২৪ থেকে ১৪২৮ সালের হাট-বাজার ইজারার আয়ের শতকরা ১৫ ও ১০ ভাগ টাকা দিয়ে উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজার উন্নয়নের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় হাট-বাজার উন্নয়ন প্রকল্প। গত অর্থ বছরেই এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। যথাসময়ে প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ দেখিয়ে ২০ প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দকৃত ৬১ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের বিভিন্ন হাট-বাজার উন্নয়নের নামে অর্থ বরাদ্দ করে উপজেলা পরিষদ। এর মধ্যে উপজেলা সদরে অবস্থিত সালথা বাজারে ৯টি প্রকল্পে ২৬ লাখ টাকা, গট্টি ইউনিয়নের বালিয়া হাটে ২টি প্রকল্পে ১২ লক্ষ ও ঠেনঠেনিয়া হাটে ৩টি প্রকল্পে ৬ লক্ষ, সোনাপুর ইউনিয়নের সোনাপুর বাজারে ১টি প্রকল্পে ২ লক্ষ, মাঝারদিয়া ইউনিয়নের মাঝারদিয়া হাটে ১ টি প্রকল্পে ২ লক্ষ ও কাগদী হাটে ২টি প্রকল্পে ৩ লক্ষ, আটঘর ইউনিয়নের নকুলহাটি ১টি প্রকল্পে ৫ লক্ষ ও জয়কালী ১টি প্রকল্পে ৫ লক্ষ টাকা মোট ৬১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
প্রকল্পগুলো পরিদর্শনে গিয়ে হাট উন্নয়নের তেমন কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। ২/৩ টা বাজারে নামমাত্র কিছু কাজ করলেও সিংহ ভাগ কাজই করা হয়নি।
উপজেলা সদরে অবস্থিত সালথা হাটের উন্নয়নের নামেই আলাদা করে ৯টি প্রকল্প দেখানো হয়। প্রতিটি প্রকল্পে সর্বনিম্ন দুই লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ দশ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়। ঐ ৯ প্রকল্পের আওতায় রয়েছে দুই লাখ টাকা ব্যয়ে সালথা বাজারে মহিলা মার্কেটের পিছনে সরকারী জায়গায় বালি দ্বারা ভরাট করণ, দুই লাখ টাকা ব্যয়ে সালথা বাজারে মহিলা মার্কেটের পিছনে জোসনা কর্মকারের ঘরের পূর্ব পার্শে সরকারী জায়গায় বালি দ্বারা ভরাট করণ, সালথা-ইউসুফদিয়া সড়কের (বাজার অংশ) সরকারী জায়গায় বালু ভরাট করণ, সালথা-ইউসুফদিয়া সড়কের (বাজার অংশ) পায়ে হাটা রাস্তা ইটের সলিং দ্বারা উন্নয়ন, দুই লাখ টাকা ব্যয়ে সালথা বাজারের মাংস বাজার সংস্কার, দুই লাখ টাকা ব্যয়ে সালথা বাজারের মাছ বাজার সংস্কার, দুই লাখ টাকা ব্যয়ে সালথা বাজারের পিঁয়াজের গলির রাস্তা সংস্কার, দশ লাখ টাকা ব্যয়ে সালথা বাজারের কাঁচা-বাজার গলি, মাছ-মাংস বাজার গলি বালুভরাট ও রাস্তা নির্মাণ এবং দুই লাখ টাকা ব্যয়ে পাট বাজারের রাস্তা এইচবিবি করণ।
এখানে চমকপ্রদ তথ্য দেখা যাচ্ছে অত্র বাজারের মহিলা মার্কেটের পিছনের প্রকল্পে। সেখানে একই জায়গা এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বালু ভরাট করার নামে শুধু (১ম অংশ) ও জোসনা কর্মকারের ঘরের পাশে (২য় অংশ) উল্লেখ করে সমুদয় টাকা লোপাট করা হয়েছে।
প্রকল্পগুলোর কাজের খোঁজ নিতে গেলে হাটের দোকানি ও স্থানীয় বাসিন্দারা বিস্ময় প্রকাশ করে তারা জানায়, এমন প্রকল্পের ব্যাপারে তাদের জানা নেই। তবে ২০২১-২২ অর্থ বছরের পরে এসে অপরিকল্পিত ভাবে কাজের স্টিমেট ছাড়াই সালথা বাজারের কাঁচা-বাজার গলি, মাছ-মাংস বাজার গলি বালুভরাট ও রাস্তা নির্মাণ কাজ করতে দেখা যায়। যা উক্ত প্রকল্পের আওতাধীন নয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নামমাত্র প্রকল্পগুলো থাকলেও সেসব প্রকল্পের কোনো কাজই করা হয়নি। একই অবস্থা দেখা গেছে উপজেলার গট্টি ইউনিয়নের ঠেনঠেনিয়া ও বালিয়া বাজারসহ আটঘর ইউনিয়নের নকুলহাটি, জয়কালী বাজারের প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রেও। সেখানে কাজ না করেই লক্ষ লক্ষ টাকা করে বরাদ্দ দেখানো হয়। অথচ ওই হাটের কোনো কাজ না করেই সম্পূর্ণ টাকাই আত্মসাৎ করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পে যেসব রাস্তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে আগে থেকেই ইট বিছানো অবস্থায় রয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের হাট-বাজারের নামে গৃহীত প্রকল্পগুলোতেও একইভাবে টাকা লোপাট করা হয়েছে।
সালথা উপজেলা পরিষদের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, উপজেলা পরিষদ থেকে দুই লাখ টাকার বেশি যেকোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হলেই উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে কাজ করার বিধান। আর দরপত্র আহ্বান করে কাজ দিলে তা বুঝে নিতেই হবে। এ কারণে কৌশলের আশ্রয় নিয়ে একই হাট এলাকায় একাধিক প্রকল্প তৈরি করে টাকাগুলো ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়া হয়েছে। এসব হাওয়াই প্রকল্পের বিষয়ে দরপত্র না হওয়ার কারণে কেউ কিছু জানতেও পারেনি।
সালথা উপজেলা প্রকৌশলী তৌহিদুর রহমান জানান, এই সংক্রান্তে আমার কাছে কোন ফাইল নাই। এ বিষয়ে সাবেক ইউএনও ও উপজেলা চেয়ারম্যান জানেন।
সালথা উপজেলার সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ হাসিব সরকার এর সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগা করলে তিনি জানান, এ অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। সরেজমিনে যা কাজ হয়েছে তার সকল প্রমান অফিসে সংরক্ষিত আছে।
সালথা উপজেলার বর্তমান উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোসা.তাছলিমা আকতার এর কাছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমি যোগদানের পূর্বে হাটের উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়ন হয়েছে। আমি যোগদানের পরে কোন হাটের উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়নি। আমার জানা মতে, আমি যোগদানের আগের সকল প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে সমাপ্ত হয়েছে।
প্রিন্ট