ঢাকা , শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
Logo মিথ্যা চাঁদাবাজির অভিযোগ, প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন Logo দিনাজপুর জেলা প্রশাসকের ফুলবাড়ী উপজেলায় মতবিনিময় সভা Logo তানোরে যাতায়াতের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অভিযোগ Logo মাগুরাতে এসএমসি’র পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত Logo রূপগঞ্জে সাংবাদিকের উপর হামলাকারীদের গ্রেফতারের দাবীতে মানববন্ধন Logo অর্থনৈতিক শুমারি উপলক্ষে স্থায়ী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত Logo প্রত্যন্ত গ্রামে নারী ফুটবল প্রীতি ম্যাচ উপভোগ করলেন হাজারো দর্শক Logo বাঘায় উপজেলা শুমারি স্থায়ী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত Logo কুষ্টিয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশনের ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আলোচনা Logo ফরিদপুরে দুই দিনব্যাপী তথ্য মেলা অনুষ্ঠিত
প্রতিনিধি নিয়োগ
দৈনিক সময়ের প্রত্যাশা পত্রিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আপনি আপনার এলাকায় সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহী হলে যোগাযোগ করুন।

চোখের আলো নেই, তবু ছড়াচ্ছেন জ্ঞানের আলো

ফরিদপুরের বোয়ালমারী পৌরসদরের গণিতের অন্ধ শিক্ষক মো. শওকত আলী।

চোখের আলো হারিয়ে গেছে দেড় দশকের অধিক তবু দিয়ে যাচ্ছেন জ্ঞানের আলো।করোনার প্রাদ্যুর্ভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মানবেতর জীবন-যাপন করছেন এই মানুষ গড়ার কারিগর। ফরিদপুরের বোয়ালমারী পৌরসদরের গণিতের শিক্ষক মো. শওকত আলী, প্রাইভেট শওকত মাষ্টার নামে যিনি সর্বাধিক পরিচিত। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারনে নিজে পড়ালেখা করতে পারেননি বেশি দূর।
কিন্ত এ পর্যন্ত ২ থেকে আড়াই হাজার দূর্বল মেধা সম্পন্ন শিক্ষার্থীকে দিয়েছেন পথের দিশা। ২০০৫ সালে হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি হরিয়ে ফেলেন তিনি। চোখের রোটিনা নার্ভ ধিরে ধিরে শুকিয়ে যাওয়ায় অন্ধত্ব বরণ করেন এ মেধাবী শিক্ষক। বাংলাদেশ ও ভারতের মাদ্রাজে চিকিৎসা নিয়েছেন বেশ কয়েকবার, নিজের যা সঞ্চয় তার সবটা ঢেলে দিয়েও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি দৃষ্টিশক্তি।
অবশেষে অর্থের অভাবে আর চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। আত্মমর্যাদা বোধ প্রগাঢ়ভাবে বাঁধা দিয়েছে কারও কাছে হাত পাততে। তাই ভাল চিকিৎসার অভাবে ধিরে ধিরে অন্ধত্ব বরণ করে নিয়েছেন।কিন্তু থেমে নেই তার জ্ঞান ছড়ানোর ব্রত। অন্ধত্ব নিয়েও এখনও পড়ান তিনি। দিব্যি ব্লাকবোর্ডে কষে যান গণিতের জটিল জটিল সমাধান। শিক্ষার্থীর দূর্বল দিককে চিহ্নিত করে মেধানুযায়ী সহজ পাঠদান করে উপযুক্ত করে গড়ে তোলাই এ শিক্ষকের বড় সাফল্য।
এ জন্য অনেক অভিভাবক এখনও তাদের দূর্বল ছেলে-মেয়ের পথের দিশারী হিসেবে তাকেই বেছে নেন। গত শতকের আশির দশকে মাগুরা থেকে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে বোয়ালমারীতে আসেন তিনি। আত্মীয়তার সূত্রে উপজেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মরহুম শেখ আক্কাচ আলীর পরিবারের সদস্যদের পড়ানোর দায়ীত্ব নেন সে সময়। তার তত্ত্বাবধানে এ পরিবারের সবাই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে।
১৯৮৬ তে এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া ১০জন শিক্ষার্থীর দায়ীত্ব নিয়ে কোচিং করোনতে পরবর্তী বছর প্রত্যেকে ভাল ফলাফল করলে নাম ছড়িয়ে পড়ে তার। এরপর থেকে পিছু তাকাবার অবসর পাননি তিনি। থেকে যান বোয়ালমারীতেই। পেশা হিসেবে বেছে নেন প্রাইভেট শিক্ষকতা। সে সময় প্রতিবছর মেধাবী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এসএসসিতে অকৃতকার্য দূর্বল শিক্ষার্থীদের ভিড় জমত থাকতো। দূর্বল শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের নিকটও ভরসারস্থল হয়ে দাঁড়ায় শওকত আলী।
দূর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য নিজ ভাড়া বাসায় গড়ে তুলেন আবাসিক কোচিং ব্যবস্থা। আবাসিক অনাবাসিক মিলে কোন কোন বছর একশত থেকে ১৩০জন শিক্ষার্থীকে ব্যাচ করে পাঠদান দিতে হতো। শিক্ষার্থীদের ভিড়ে এক সময় গোসল খাওয়ার সময় না পেলেও অন্ধত্ব বরণের পর থেকে ধিরে ধিরে কমে আসে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা। বর্তমানে ১০/১২জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়িয়ে কষ্টেসৃষ্টে দিনপাত করন তিনি।
তার হতে শিক্ষার আলো নেয়া অনেকেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত, এর মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকজন বিসিএস ক্যাডার, এমবিবিএস ডাক্তার, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংক কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, পুলিশ অফিসার, সাংবাদিকসহ নানা শ্রেনিপেশার মানুষ। করোনার প্রাদ্যুর্ভাবে সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় স্বাভাবিক ভাবেই শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে আসে। এখন মাত্র ১০/১২ জন শিক্ষার্থীকে পড়ান তিনি। এতে প্রাপ্ত বেতনে বাসাভাড়া দিয়ে বেশ কষ্টেসৃষ্টে স্ত্রীকে নিয়ে দিনপাত করতে হয় তাকে।
১ ছেলে ও ১ মেয়ে রয়েছে এ শিক্ষকের, মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে কয়েকবছর। ছেলেও বিয়ে করে বৌও নিয়ে ঢাকায় থাকে, একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করলেও যা বেতন পায় তাতে তার সংসারী চলাতে কষ্ট হয়। ইচ্ছা ছিল একটুকরো জমি ক্রয় করে নিজের একটা বাড়ি করার। কিন্তু চোখের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সঞ্চিত টাকার সবটাই শেষ হয়ে গেছে। ভাল চিকিৎসা কর গেলে হয়তো আবার চোখের আলো ফিরে আসতো। কিন্তু অর্থের অভাবে ভারত ছাড়া দেশের বাইরে কোথাও যাওয়া সম্ভব হয়নি। ধিরে ধিরে চোখের রোটিনা নার্ভ শুকিয়ে ক্ষীণ আশাটিও এখন মৃতপ্রায়।
এখন ছাত্রছাত্রী কমে যাওয়ায় বাসা ভাড়ার টাকাও পরিশোধ করতে কষ্ট হয় বলে জানান এই শিক্ষক। শিক্ষক শওকত আলী জানান- “শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে নিজের বা সংসারের কথা চিন্তা করিনি। কয়েকশত গরিব ছেলে-মেয়েকে বিনা বেতনে পড়িয়েছি।
এসএসসিতে ফর্ম-ফিলাফ করতে অপারগ ছাত্রছাত্রীদের নিজের টাকা দিয়ে ফর্ম ফিলাফ করতে সহযোগীতা করেছি। এখন নিজেই চলতে পারিনা। সত্যি বলতে কী আমি ভীষণ কষ্টে আছি। কষ্টে আছি! আমি যেন সেই বাতিওয়ালা, পথে পথে যে আলো জ্বালিয়ে ফেরে, অথচ নিজের ঘরেই নেই যার আলো জ্বালাবার সামর্থ্য!

প্রিন্ট
Tag :
এই অথরের আরো সংবাদ দেখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

মিথ্যা চাঁদাবাজির অভিযোগ, প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন

error: Content is protected !!

চোখের আলো নেই, তবু ছড়াচ্ছেন জ্ঞানের আলো

আপডেট টাইম : ০৬:৩৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ অগাস্ট ২০২১
আমীর চারু বাবলু, বোয়ালমারী,ফরিদপুরঃ :
চোখের আলো হারিয়ে গেছে দেড় দশকের অধিক তবু দিয়ে যাচ্ছেন জ্ঞানের আলো।করোনার প্রাদ্যুর্ভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মানবেতর জীবন-যাপন করছেন এই মানুষ গড়ার কারিগর। ফরিদপুরের বোয়ালমারী পৌরসদরের গণিতের শিক্ষক মো. শওকত আলী, প্রাইভেট শওকত মাষ্টার নামে যিনি সর্বাধিক পরিচিত। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারনে নিজে পড়ালেখা করতে পারেননি বেশি দূর।
কিন্ত এ পর্যন্ত ২ থেকে আড়াই হাজার দূর্বল মেধা সম্পন্ন শিক্ষার্থীকে দিয়েছেন পথের দিশা। ২০০৫ সালে হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি হরিয়ে ফেলেন তিনি। চোখের রোটিনা নার্ভ ধিরে ধিরে শুকিয়ে যাওয়ায় অন্ধত্ব বরণ করেন এ মেধাবী শিক্ষক। বাংলাদেশ ও ভারতের মাদ্রাজে চিকিৎসা নিয়েছেন বেশ কয়েকবার, নিজের যা সঞ্চয় তার সবটা ঢেলে দিয়েও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি দৃষ্টিশক্তি।
অবশেষে অর্থের অভাবে আর চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। আত্মমর্যাদা বোধ প্রগাঢ়ভাবে বাঁধা দিয়েছে কারও কাছে হাত পাততে। তাই ভাল চিকিৎসার অভাবে ধিরে ধিরে অন্ধত্ব বরণ করে নিয়েছেন।কিন্তু থেমে নেই তার জ্ঞান ছড়ানোর ব্রত। অন্ধত্ব নিয়েও এখনও পড়ান তিনি। দিব্যি ব্লাকবোর্ডে কষে যান গণিতের জটিল জটিল সমাধান। শিক্ষার্থীর দূর্বল দিককে চিহ্নিত করে মেধানুযায়ী সহজ পাঠদান করে উপযুক্ত করে গড়ে তোলাই এ শিক্ষকের বড় সাফল্য।
এ জন্য অনেক অভিভাবক এখনও তাদের দূর্বল ছেলে-মেয়ের পথের দিশারী হিসেবে তাকেই বেছে নেন। গত শতকের আশির দশকে মাগুরা থেকে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে বোয়ালমারীতে আসেন তিনি। আত্মীয়তার সূত্রে উপজেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মরহুম শেখ আক্কাচ আলীর পরিবারের সদস্যদের পড়ানোর দায়ীত্ব নেন সে সময়। তার তত্ত্বাবধানে এ পরিবারের সবাই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে।
১৯৮৬ তে এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া ১০জন শিক্ষার্থীর দায়ীত্ব নিয়ে কোচিং করোনতে পরবর্তী বছর প্রত্যেকে ভাল ফলাফল করলে নাম ছড়িয়ে পড়ে তার। এরপর থেকে পিছু তাকাবার অবসর পাননি তিনি। থেকে যান বোয়ালমারীতেই। পেশা হিসেবে বেছে নেন প্রাইভেট শিক্ষকতা। সে সময় প্রতিবছর মেধাবী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এসএসসিতে অকৃতকার্য দূর্বল শিক্ষার্থীদের ভিড় জমত থাকতো। দূর্বল শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের নিকটও ভরসারস্থল হয়ে দাঁড়ায় শওকত আলী।
দূর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য নিজ ভাড়া বাসায় গড়ে তুলেন আবাসিক কোচিং ব্যবস্থা। আবাসিক অনাবাসিক মিলে কোন কোন বছর একশত থেকে ১৩০জন শিক্ষার্থীকে ব্যাচ করে পাঠদান দিতে হতো। শিক্ষার্থীদের ভিড়ে এক সময় গোসল খাওয়ার সময় না পেলেও অন্ধত্ব বরণের পর থেকে ধিরে ধিরে কমে আসে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা। বর্তমানে ১০/১২জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়িয়ে কষ্টেসৃষ্টে দিনপাত করন তিনি।
তার হতে শিক্ষার আলো নেয়া অনেকেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত, এর মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকজন বিসিএস ক্যাডার, এমবিবিএস ডাক্তার, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংক কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, পুলিশ অফিসার, সাংবাদিকসহ নানা শ্রেনিপেশার মানুষ। করোনার প্রাদ্যুর্ভাবে সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় স্বাভাবিক ভাবেই শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে আসে। এখন মাত্র ১০/১২ জন শিক্ষার্থীকে পড়ান তিনি। এতে প্রাপ্ত বেতনে বাসাভাড়া দিয়ে বেশ কষ্টেসৃষ্টে স্ত্রীকে নিয়ে দিনপাত করতে হয় তাকে।
১ ছেলে ও ১ মেয়ে রয়েছে এ শিক্ষকের, মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে কয়েকবছর। ছেলেও বিয়ে করে বৌও নিয়ে ঢাকায় থাকে, একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করলেও যা বেতন পায় তাতে তার সংসারী চলাতে কষ্ট হয়। ইচ্ছা ছিল একটুকরো জমি ক্রয় করে নিজের একটা বাড়ি করার। কিন্তু চোখের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সঞ্চিত টাকার সবটাই শেষ হয়ে গেছে। ভাল চিকিৎসা কর গেলে হয়তো আবার চোখের আলো ফিরে আসতো। কিন্তু অর্থের অভাবে ভারত ছাড়া দেশের বাইরে কোথাও যাওয়া সম্ভব হয়নি। ধিরে ধিরে চোখের রোটিনা নার্ভ শুকিয়ে ক্ষীণ আশাটিও এখন মৃতপ্রায়।
এখন ছাত্রছাত্রী কমে যাওয়ায় বাসা ভাড়ার টাকাও পরিশোধ করতে কষ্ট হয় বলে জানান এই শিক্ষক। শিক্ষক শওকত আলী জানান- “শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে নিজের বা সংসারের কথা চিন্তা করিনি। কয়েকশত গরিব ছেলে-মেয়েকে বিনা বেতনে পড়িয়েছি।
এসএসসিতে ফর্ম-ফিলাফ করতে অপারগ ছাত্রছাত্রীদের নিজের টাকা দিয়ে ফর্ম ফিলাফ করতে সহযোগীতা করেছি। এখন নিজেই চলতে পারিনা। সত্যি বলতে কী আমি ভীষণ কষ্টে আছি। কষ্টে আছি! আমি যেন সেই বাতিওয়ালা, পথে পথে যে আলো জ্বালিয়ে ফেরে, অথচ নিজের ঘরেই নেই যার আলো জ্বালাবার সামর্থ্য!

প্রিন্ট