মোঃ জিয়াউর রহমানঃ
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ছামসুল আরেফিনের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে। যোগদানের পর থেকেই প্রাইভেট ক্লিনিক নিয়েই ব্যস্ত থাকেন তিনি।
স্বয়ংক্রিয় উপস্থিতি নিশ্চিত করা, আর মাঝেমধ্যে হাসপাতালে নিজের চেম্বার অলংকৃত করা ছাড়া তিনি তেমন কিছুই করেন না। স্থানীয় হয়েও দীর্ঘদিন একই হাসপাতালে চাকরি করার কারণে তিনি এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন।
এছাড়া সিন্ডিকেটও নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। জানা গেছে, ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতালে বিভিন্ন সরকারি উন্নয়নের নানা উদ্যোগ নিলেও প্রতিবারই তা বিফলে গেছে। প্রায় ৫’শ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ৫০ শয্যার এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন উপজেলার ৭ লাখের বেশি মানুষ। অথচ নেই পর্যাপ্ত জনবল ও যন্ত্রপাতি।
সংকটের ভেতর আবার “মরার ওপর খাঁড়ার ঘা” হয়েছেন আরএমও—এমনটাই মন্তব্য করেছেন হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগী ও স্বজনেরা। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, কয়েক বছর আগেও এখানে ১৮ থেকে ২০ জন চিকিৎসক ছিলেন, এখন মাত্র ৪ থেকে ৫ জন।
হাসপাতালের নতুন ভবনে বহির্বিভাগে রোগী দেখার করিডোরেই বসার ঘর হাসপাতালটির আরএমও ছামসুল আরেফিনের। অনুসন্ধানের প্রথম দিন ঘরে ঢুকে কোনো চিকিৎসকই পাওয়া যায়নি, তবে ঘরে-বাইরে টিকিট হাতে সেবা প্রত্যাশী রোগীর ভিড় দেখা গেছে। দ্বিতীয় দিন তিনি আছেন জানা গেলেও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
উপজেলার হোসেনাবাদ এলাকা থেকে আসা সবুজ আলী জানান, ৫ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে এক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর জানতে পারেন চিকিৎসক ছামসুল আরেফিন ভিতরে নেই। আসবেন কি-না তাও জানা নেই। আরেক অভিযোগের প্রেক্ষিতে অনুসন্ধান করা হলে দেখা যায়, আরএমও’র কক্ষে রোগী দেখেন অন্যকোনো ব্যক্তি। আবার একেকদিন একেকজনকেও দেখা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের একজন স্টাফ জানান, স্ত্রীর মালিকানায় দৌলতপুরে তিনি শুরু থেকেই গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বেসরকারি হাসপাতাল। সেখানেই রোগী দেখা ও সার্বিক ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত সময় দিতে হয় তাঁকে।
চিকিৎসা নিতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হওয়া স্থানীয় তরুণ সামি বলেন, “খোদ কর্মকর্তারা স্থানীয় ছেলে। তাই সিন্ডিকেটই বড় সিন্ডিকেট। আরএমও নিজের চাকরির দায়িত্বের চেয়ে তার ব্যবসাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। এখানে তার নিজস্ব হাসপাতাল আছে। তিনি সেখানেই ডিউটি করেন। নিজস্ব দালাল সিন্ডিকেট দিয়ে বাইরের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চালান।”
দৌলতপুরের স্বাস্থ্যসেবা তার (ছামসুল আরেফিনের) রামরাজত্ব বলেও মন্তব্য করেন এই তরুণ। স্থানীয় যুবক শরীফুল জানান, “আওয়ামীলীগের সময় স্থানীয় নেতাদের আশীর্বাদে নিজ এলাকায় বদলি পাওয়া কর্মকর্তারা এখানে দীর্ঘ সময় ধরে আছে। আরএমও যতদিন আছেন, অতীতে এখানে কখনো কোনো কর্মকর্তা এত দীর্ঘ মেয়াদে থাকেননি। স্থানীয় হওয়ায় জনসাধারণের কাছে জবাবদিহিতার প্রয়োজন মনে করেন না।”
আওয়ামীলীগের প্রভাব খাটিয়ে একাধিকবার বদলি ঠেকিয়েছেন তিনি। টিএইচও এবং আরএমও দুজনেই এই এলাকার ছেলে। অভ্যন্তরীণ গাফিলতির বিষয়ে আরএমওকে জবাবদিহিতায় রাখতে প্রধান কর্মকর্তা টিএইচও সক্ষম নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
দূর থেকে আসা নুরুন্নাহার নামের এক রোগী সেবা নিতে না পেরে ফিরে যাচ্ছিলেন। জানা গেলো, চিকিৎসা না পেয়ে এমন ফিরে যাওয়ার সংখ্যাও কম নয়।
হাসপাতালের খোদ টিকিট বিক্রেতা মোহাম্মদ সজীব জানান, ডাক্তার ছামসুল আরেফিনের অনুপস্থিতিতে অন্য ডাক্তারদের ওপর কাজের চাপ বেড়ে যায়। এমনিতেই চিকিৎসক কম, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকটি বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, নামে বেনামে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন ডাক্তার ছামসুল আরেফিন। সেগুলো নিয়েই মূলত ব্যস্ত থাকেন তিনি। এছাড়া হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন টেন্ডারেও তার ঘনিষ্ঠজনদের নিয়মিত দেখা যায়।
এ বিষয়ে হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ছামসুল আরেফিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমি নিয়মিত হাসপাতালে রোগী দেখি। খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।”
হাসপাতালের এসব প্রসঙ্গে কথা বললে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তৌহিদুল হাসান তুহিন তুলে ধরেন নানা সংকটের কথা।
আরএমও’র দায়িত্বে অবহেলা প্রসঙ্গে বলেন, “তাকে হাসপাতালের বাইরেও সরকারি অন্য জায়গায় অপারেশনের ডিউটি করতে হয় নিয়মিত। পাশাপাশি তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রোগী দেখেন। আমরা বায়োমেট্রিকে উপস্থিতি নিশ্চিত করি। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোয়ার্টারে কেউ থাকেন না।”
এদিকে, এমন অভিযোগ খতিয়ে দেখে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন কুষ্টিয়ার নবাগত সিভিল সার্জন শেখ মোহাম্মদ কামাল হোসেন।
প্রিন্ট